১০২তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শামসুল হক: ইতিহাসের বিস্মৃত নায়ক

‘১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমরা ঠিক করলাম, শামসুল হক সাহেবকে অনুরোধ করবো মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্তু টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবেরও টাকা নেই, আর আমাদেরও টাকা নেই। তবু যেই কথা সেই কাজ। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইলে চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করতে চেষ্টা করলাম। কয়েক শত টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিলো।’
-অসমাপ্ত আত্মজীবনী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জননেতা শামসুল হক ছিলেন অবিভক্ত ভারতের প্রগতিশীল রাজনীতির দিকপাল, মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার, উপমহাদেশের এক যুগ স্রষ্টা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাঙালির উজ্জ্বল ইতিহাসের এক কঠিন অধ্যায়ের কালজয়ী জননায়ক। শামসুল হকের জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯১৮ সালে, টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার এক নিভৃত মাইঠান গ্রামে। এটা তার মামার বাড়ি। তার বাবার বাড়ি ছিলো একই উপজেলার টেউরিয়ায়। বিস্মৃত নায়ক শামসুল হকের এ বছর ১০২তম জন্মদিন।

রাজনীতির ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত নাম শামসুল হক; যিনি ছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগই ১৯৫৫ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’-এ রূপান্তরিত হয়। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হয়েও রাজনীতিতে প্রায় অনুল্লেখ থেকে গেছেন শামসুল হকের নাম।

শামসুল হক যখন যৌবনে পদার্পণ করেন তখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তুঙ্গে। সেই সময় ঢাকার নেতারা টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের এলাসিনে নেমে নৌকায় অথবা টমটম গাড়িতে হক সাহেবের মাইঠানের বাড়িতে, তারপর মওলানা ভাসানীর সন্তোষ, এরপর টাঙ্গাইল শহরে আসতেন। বিভিন্ন সময় শেখ মুজিব, আতাউর রহমান, আবুল হাশিম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খন্দকার মোশতাক, জিল্লুর রহমান ও কফিল উদ্দিনরা তার বাড়িতে এসেছেন। সন্তোষ জাহ্নবী হাইস্কুল পড়–য়া শামসুুল হকের দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পা-িত্য দেখে প্রধান শিক্ষক বৈরাম আলী তার প্রতি মনোযোগী হন। এরপর তিনি তার পড়াশুনা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা দেখে তাকে নিজ বাড়িতে লজিং শিক্ষক হিসেবে রাখেন। সাংগঠনিক ক্ষমতা আর বক্তৃতার জন্য তিনি স্কুল জীবনেই ব্যাপক জনপ্রিয় এবং পরিচিতি পান বাগ্মি হিসেবে। ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি করটিয়ার সা’দত কলেজ ভর্তি হলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর সুদৃষ্টি লাভ করেন। তিনি ছাত্র সংসদ গঠন করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা ভিপি পদ লাভ করেন।

শামসুুল হক প্রথমে কংগ্রেস এবং পরবর্তীতে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকেন। ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৯ সালের মার্চ/এপ্রিল মাসে টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তৎকালীন সরকারি দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রথম যে ব্যক্তি সরব অবস্থান জানান তিনি হলেন শামসুল হক। তখন তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা।

১৯৪৭-৫২ সালে অনেকেই শামসুল হককে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ চিফ মিনিস্টার বলে কল্পনা করতেন। কেননা তাকে তখন বলা হতো বেবী জিন্নাহ (ছোট জিন্নাহ) নামে। জিন্নাহ তাকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ অর্গানাইজার পদে ভূষিত করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে জয় লাভের পর তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় পরিণত হন। সেই নিরিখে তিনি তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের কুদৃষ্টিতে পড়েন। 

তৎকালীন রাজনীতিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন শামসুল হক। বিশেষ করে দেশভাগোত্তর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক অভিযাত্রা এবং পূর্ব পাকিস্তানে সরকার বিরোধী রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রথম সারির নেতা। ছিলেন পাকিস্তান গণপরিষদের সংসদীয় কমিটির সদস্য।

রাজনৈতিক কারণে প্রায়ই তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। ১৯৫৩ সালে কারামুক্তি ঘটলেও জেলখানায় অমানুষিক নির্যাতনের কারণে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ওই বছরই আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। দল থেকে বহিষ্কারের পর তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এরপর থেকে তাকে পথে পথে ঘুরতে দেখেছেন সেই সময়ের অনেকে। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বিনা চিকিৎসায় তিনি পথে পথে ঘুরেছেন। ১৯৬৪ সালে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। পথে পথে ঘুরে রোগ শোকে ভুগতে ভুগতে জীবন নিঃশেষ হয়ে যায় তার। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে তৈরি হয় রহস্যের মিথ। তিনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তা জানতেন না তার পরিবার এবং দলের লোকজনও। ফলে তাকে নিয়ে দলে বা পারিবারিক পর্যায়ে কোনো শোক বা স্মরণসভা করা হয়নি সেই সময়ে। 

ডা. আনসার আলী তালুকদার নামের জনৈক ব্যক্তি ২০০৭ সালে টাঙ্গাইল শহরের ব্যাপারীপাড়ায় মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে উদ্ঘাটন করেন শামসুল হকের মৃত্যুরহস্য। তার বরাতে জানা যায়, সেখানে এক বাড়িতে রঙিন একটি ক্যালেন্ডারে শামসুল হকের ছবি দেখতে পান তিনি। ক্যালেন্ডারে তার ছবির পাশে বাংলা হরফে লেখা ছিল ‘আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও ভাষা আন্দোলনের রূপকার’। ছবিটি দেখে ডা. আনসার আলীর ৪২ বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। ডা. আনসার আলী তালুকদার নিজেও তৎকালীন মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। রাজনীতি করার সুবাদে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন ও জানতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে শামসুল হকের ভাষণও শুনেছেন। এরপর তিনি বিষয়টি নিয়ে এলাকার প্রবীণ লোকদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর ৪২ বছর পর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা শামসুল হকের মৃত্যুরহস্য উন্মোচিত হয়।

শামসুল হক গবেষণা পরিষদের মাধ্যমে জানা যায়, ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে জোকারচর গ্রামের মহিউদ্দিন আনসারী নামের এক নামকরা কংগ্রেস নেতা কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে কোনো এক স্থানে মানসিক ভারসাম্যহীন ও ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় শামসুল হককে দেখতে পেয়ে তিনি বাড়িতে নিয়ে আসেন। সে সময় গ্রামের হাতেগোনা কয়েকজন সচেতন ও শিক্ষিত লোক ছাড়া শামসুল হককে কেউ চিনতেন না। অসুস্থ শামসুল হক মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়িতে ৭ দিন থাকার পর জ্বরে ভুগে ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় হোমিও চিকিৎসক শুকলাল দাস শামসুল হকের চিকিৎসা করেন। মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়ির সামনের ছোট মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর শামসুল হককে কদিমহামজানি কবরস্থানে দাফন করা হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শুরুর দিকে প্রায়ই উল্লিখিত হয়েছে এ মহৎ রাজনীতিপ্রাণ মানুষটির নাম। অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে শেখ মুজিব বারবার স্মরণ করেছেন তাকে। বায়ান্নর উত্তাল ভাষা আন্দোলনের সময়ে রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে জেলের অভ্যন্তরে। সেই সময় শামসুল হকের অনুপস্থিতি অনুভব করেছেন শেখ মুজিব। তিনি তার লেখায় শামসুল হককে নিয়ে প্রতি মুহূর্তের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিব লিখেছেন- ‘পাকিস্তান আন্দোলনে হক সাহেবের অবদানে যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাদের চেয়েও অনেক বেশি ছিল তার অবদান। বাংলাদেশের যে কয়েকজন কর্মী সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন তাদের মধ্যে শামসুুল হক সাহেবকে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী বললে বোধহয় অন্যায় হবে না। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের কুঠিরে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। অথচ স্বাধীনতার সাত দিনের মাথায়ই তিনি মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। একেই বলে মন্দ কপাল’। (পৃষ্ঠা : ২৩৬)

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল ঐতিহাসিক টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচনের জয়ের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে বাংলার মধ্যমণিতে পরিণত হন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তার নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, তার অনুরোধে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হন সভাপতি এবং জেলখানায় বন্দী অবস্থায় ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে শেখ মুজিবুরের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাবনা ছিল হক সাহেবের। অর্থাৎ নিজের জীবন বাজি রেখে তিনি এ দলটি করেছিলেন।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে কারাগারে হক সাহেবকে ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়। চক্রান্তের মাধ্যমে স্ত্রী অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুন ও তার মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করা হয়। মুক্তি লাভের পূর্বেই তার স্ত্রী দুই কন্যাসহ পিএইচডি করার জন্য সরকারের বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা পাড়ি জমান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী ও তার চোখের মণি কন্যাদ্বয়কে দেখতে না পাওয়ায় তার মানসিক রোগ দেখা দেয়।

এই অজুহাতে তাকে তড়িঘড়ি করে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন প্রতিক্রিয়ায় দেশে মুসলিম লীগ বিরোধী যে গভীর ক্ষোভ ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে, তাকে পুঁজি করেই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পূর্ববঙ্গের মাটি থেকে মুসলিম লীগকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। শামসুুল হকের নিজ হাতে গড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্র ও পূর্ববঙ্গ উভয় স্থানে (যুক্তফ্রন্ট) সরকার গঠিত হয়। অথচ আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সেই আনন্দঘন দিনেও শামসুুল হকের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা হয়নি। দীর্ঘ ১২ বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি অনাদরে, অনাহারে, নিজ দলের অত্যাচার, মুসলিম লীগের তিরস্কার, প্রিয়তমা স্ত্রী আফিয়া ও দুই কন্যাসহ বিদেশ পলায়ন এবং নিজ পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা না পেয়ে অভিমানে ১৯৬৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হন।

শামসুল হকের বড় মেয়ের নাম উম্মেবতুল ফাতেমাজ জহুরা (শাহীন) এবং ছোট মেয়ের নাম উম্মেবতুল তাহেরা (সোয়েফা)। বর্তমানে তারা দু’জনেই পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত। সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করেন। মেয়েরা একবার টাঙ্গাইলে খুঁজে পাওয়া বাবার কবর দেখতে এসেছিলেন। তাদের নাকি বলা হতো তোমাদের পিতা একজন বদ্ধ উন্মাদ, তার কাছে গেলে সে তোমাদের মেরে ফেলতে পারে।

নিজ দলের শীর্ষ নেতারা কখনো হক সাহেবের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে এতটুকুও উৎকণ্ঠা প্রকাশ বা খোঁজ খবর নেননি। উপরন্তু তার ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে তাকে আল্লাহর ওলী বানিয়ে নিরুদ্দেশের খবরটি আড়াল করে ছিল। হক সাহেবের বংশধররা সেটি মেনে নিল সুদীর্ঘ ২০০৭ সাল পর্যন্ত। ২০০৭ সালে অর্থাৎ নিখোঁজ হওয়ার ৪২ বছর পর তার মৃত্যুর খবর ও তার কবরের সন্ধান মেলে যমুনার তীরঘেঁষা কদিমহামজানী কবরস্থানে। পরিবারের পক্ষে ডা. স্বপন সাংবাদিক মহব্বত হোসেন ও সাংবাদিক মাছুম ফেরদৌসর বৎসরব্যাপী অনুসন্ধানের পর ডা. আনছার আলীর সহায়তায় বেরিয়ে আসে অমোঘ লুকায়িত সত্যটি।

শামসুল হকের বিশেষ ভূমিকাগুলো নিম্নরূপ:

১.নবাবদের দালান কোঠার বাইরে সর্ব সাধারণের মধ্যে রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়া।

২.উপনির্বাচনে (১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল) জয়ী হবার পর মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে হকের নেতৃত্বে পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগ গঠন।

৩.বাংলা ভাষা আন্দোলনকে সর্ব সাধারণের কাছে বিস্তৃত করা। (১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি)

৪.পাকিস্তানের প্রাথমিক অবস্থায় জিন্নাহ পরবর্তী মুসলিম লীগের কায়েমী স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটের সমাধান রূপে ‘মূল দাবি প্রণয়ন’।

বাঙালি ইতিহাসে এই চারটি বিষয় বড় ধরনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে বিরাজ করছে। এসব ইতিহাস লিখতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে শামসুল হকের নাম। অর্থাৎ অকাল প্রয়াত এই মহান জননেতা আমাদের ইতিহাসের অত্যন্ত নাজুক, গুরুত্বপূর্ণ ও সঙ্কটাকীর্ণ অংশের ভারবাহী মহান পুরুষ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, প্রগতিবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনে এক দশকেরও বেশি সময় বড় ঈগলের মতো ক্ষিপ্র গতিশীল ছিলেন তিনি।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেল ৩টায় ঢাকার কেএমদাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’ সম্মেলন শুরু হলো। উপস্থিত ২৫০ থেকে ৩০০ জন। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে শুরু হলো সম্মেলন। তারা আলাপ-আলোচনা করে তৈরি করলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। নামকরণ করলেন ভাসানী স্বয়ং। তাদের যুক্তি ছিল, তারা সবাই মুসলিম লীগার। তবে আকরাম খাঁ-নূরুল আমীনদের মুসলিম লীগ হলো সরকারি মুসলিম লীগ, তাদেরটা হবে আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ। তাদের লক্ষ্য হলো, ‘স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লোকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকার জনগণের মুসলিম লীগ গড়ে তোলা।’

গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস তাকে বিস্মৃত হতে দেবে না, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে বাঙালি থাকবে। তার দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা স্বত্ত্বেও তার স্মরণে কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় না।

একজন শামসুল হকের উত্থান ও সঠিক মৃত্যু রহস্যের উদ্ঘাটন ইতিহাস রচনা করার প্রত্যাশা তো সুদূর পুরাহত। তবুও প্রত্যাশা করি এ কাজটি করবে সমাজের রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব তথা সংগঠন যারা তার সুস্থ ধারার আদর্শ ও ত্যাগের গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //