দেশের বর্তমান সিনিয়র সিটিজেনরা (৬০+) শৈশব থেকে যেসব কালজয়ী শিল্পীদের গান শুনে আসছেন তারা হচ্ছেন- হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, সতিনাথ মুখার্জি, শ্যামল মিত্র, পিন্টু ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখার্জি, প্রতিমা ব্যানার্জি আরতি মুখার্জি এবং হিন্দিতে মো. রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ, লতা মুঙ্গেশকর ও আশা ভোঁশলে।
প্রজন্মটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তাদের পছন্দের তালিকায় যুক্ত হয়েছে মেহদী হাসান, গুলাম আলী, জাগজিৎ সিং ও অনুপ যালোটার মনভোলানো গজল। দেশীয় শিল্পীদের মধ্যে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, সুবীর নন্দী, আব্দুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর ও তপন চৌধুরীর মিষ্টি গানগুলো শোনা হতো, এখনো শুনি। ফলে উঁচু মানের কন্ঠের বৈশিষ্ট সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা আছে বৈকি।
আফসোসের বিষয় হলো, জনপ্রিয় শিল্পীরা অনেকেই অকালে পরপারে চলে গেছেন। শুধুমাত্র গজল সম্রাট মেহদী হাসান ও বাংলার দোয়েল মান্না দে বহুদিন ভক্তদের গান শোনাতে পেরেছিলেন। তারা দুজনই বেশ দীর্ঘজীবী ছিলেন। আমরা এখনো নিয়মিত তাদের প্রাণজুড়ানো গানগুলো শুনি। আলোচ্য শিল্পীদের প্রায় সব গান ইউটিউবে পাওয়া যায়, সেগুলোই শোনা হয়। ফলে, বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নেই। তথাপি, ক্যাজুয়ালি শোনা হয় শ্রীকান্ত, শ্রেয়া ঘোষাল ও সনু নিগমের গান।
সম্প্রতি কেকে নামে এক জনপ্রিয় শিল্পীর অকাল মৃত্যুতে সারা ভারতবাসীর গভীরভাবে মুষড়ে পরা দেখে কৌতুহলী হয়ে তার গাওয়া কয়েকটি গান শুনলাম। এককথায় চমৎকার শিল্পী। পুরো নাম কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ, সংক্ষেপে কেকে। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। উঁচুমানের শিল্পীর সব বৈশিষ্ট্যই ছিল তার। কন্ঠটি শ্রুতিমধুর, সুরেলা, ভরাট, দরদভরা ও অনেক উঁচুতে সাবলিল ওঠানামার দক্ষতাপূর্ণ। অথচ তিনি সংগীতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি।
লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন চাকরি করে তা ছেড়ে দিয়ে তার প্রিয় কাজ অর্থাৎ গান গাওয়া শুরু করেন। প্রথম দিকে হোটেল-রেস্তোরাঁয় গাইতেন। তারপর শুরু করেন বিজ্ঞাপনে জিঙ্গেল গাওয়া। তিনি মোট সাড়ে তিন হাজার জিঙ্গেল গেয়েছেন। সিনেমায় প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে তাকে প্রথম সুযোগ দেন এ আর রহমান। জহুরী অমূল্য রত্ন চিনতে ভুল করেননি। তারপর থেকে কেকে গেয়ে গেছেন অজস্র হৃদয়হরা গান।
তার অকাল প্রয়াণ সংগীতজগতে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। ভক্তরা সবাই তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।
কেকে’র মৃত্যু নিয়েও কিছু তথ্য জানা যাচ্ছে যা ভেবে দেখার মতো। তার অসময়ে চলে যাওয়ার পিছনে কোনো পরিকল্পিত ক্রাইম খোঁজার সুযোগ নেই। তবে, বেশ কিছু গাফিলতি ছিল বৈকি!
জানা যায় তিনি মাত্র দু’দিন বিরতি দিয়ে অনুষ্ঠান করেছিলেন। কলকাতার যে অডিটোরিয়ামে সেদিন তিনি লাইভ প্রোগ্রাম করছিলেন, সেটির ভেতর ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ বেশি মানুষ প্রবেশ করেছিল। ফলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করছিল না। অর্থাৎ, ভেতরে তৈরি হওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড ভালোভাবে বের হচ্ছিল না। তার উপর মঞ্চে ধোঁয়া ও যান্ত্রিক বাজনা পরিবেশটিকে শ্বাসরুদ্ধকর বানিয়ে ফেলেছিল।
কেকে’র বয়স ছিল ৫৩ বছর, এ বয়সটি হৃদরোগ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনিও হয়তো সে রোগে আক্রান্ত ছিলেন। অনুষ্ঠানের ফুটেজে দেখা যায় তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন, পানি পান করছেন এবং ঘাম মুছছেন। তথাপি তিনি পেশাদারের মতো এক ঘণ্টার প্রোগ্রামটি শেষ করে বের হন। তখন তাকে বেশ অসুস্থ লাগছিল। হোটেলে ফেরার পথে গাড়িতে তিনি ঠান্ডা ও গরম দুটোই অনুভব করছিলেন যা তিনি বলেছেন। সম্ভবত সবচেয়ে বড় গাফিলতিটি তখন ঘটে যায়। সে অবস্থায় তাকে হোটেলে না নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলেই এই মহাবিপর্যয়টি হয়তো এড়ানো যেতো।
তথ্যগুলো ইউটিউবে প্রাপ্ত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কুনাল সরকারের ভিডিও থেকে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে সরকারকেই কঠোর হতে হবে। আয়োজকদের বলে লাভ নেই। তারা হিসেব করেন ব্যবসার, শিল্পীর শারীরিক অবস্থার দিকে নজর দেয়ার সময় কোথায়!
এর মধ্যে ওপার বাংলার একজন গায়ক সম্প্রতি কেকে সম্মন্ধে কটু মন্তব্য করে বিতর্কিত হন। বোঝাই গেলো সেটি এসেছে পরশ্রীকাতরতা থেকে। তার সেই মন্তব্য আমাকে পীড়া দেয়নি, পীড়া দিয়েছে ভক্তদের কাছে তার নিজের ছোট হয়ে যাওয়া। তার মন্তব্যই আমার মতো হয়তো আরো অনেককেই কেকে সম্পর্কে জানতে বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছে! কেবল বাঙালিরাই কেন এই রোগে ভোগেন বুঝি না!
পশ্চিম বাংলার আরেক প্রখ্যাত শিল্পী এর আগে কুমার শানু পাকিস্তানি শিল্পী আতিফ আসলাম প্রমুখ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন। মনের এই রোগটির উপস্থিতি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে, সবার সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারা উচিত।
কেকের মতো শিল্পী রোজরোজ আসেন না। তার গানের মধ্যেই তিনি ভক্তদের কাছে বেঁচে থাকবেন বহুযুগ।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh