‘যা কিছু মৌলিক, তার ক্ষয় নেই’

রাহুল আনন্দ- একাধারে গায়ক-অভিনেতা-চিত্রশিল্পী। গান গাওয়ার পাশাপাশি বাজাতে পারেন বহু ধরনের বাদ্যযন্ত্র। নিজেই তৈরি করেছেন অনেক মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট। করোনাকালেও অনলাইনে দর্শক-শ্রোতাকে গান শুনিয়ে গেছেন। 

সংগীত নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেছেন নাসরিন জেরিনের সাথে কথোপকথনে

প্রচলিত এত বাদ্যযন্ত্র থাকার পরও জলের গানের জন্য আপনাদের স্বউদ্ভাবিত বাদ্যযন্ত্রের দরকার পড়ল কেন?

সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের যে জীবনাচরণ, সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই প্রচলিত দেশি বাদ্যযন্ত্রগুলোকে আমরা আমাদের প্রয়োজন উপযোগী তৈরি করে নিয়েছি। আমাদের মা, দাদি-নানির রান্না করা পায়েসে নতুন উপকরণ হিসেবে পেস্তা, কাজু মিশিয়ে আমরা তা আরো সুস্বাদু করে থাকি, এটাও অনেকটা তেমন ব্যাপার।

বর্তমানের গানে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে যেভাবে ভোকাল মিক্সিং, প্রসেসিং করা হয়- ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

প্রযুক্তির ব্যবহার সব সময় সঠিক হতে হবে। নইলে ব্যাপারটা দাঁড়াবে রেশমী সুতা দিয়ে সুচিকর্মের পরিবর্তে পাগলকে বেঁধে রাখার মতো। যা আদৗও সম্ভব না। প্রযুক্তি জীবনকে সহজ করতে পারে বা গানেও প্রযুক্তির নানা সাহায্য নিয়েই আমরা শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছি। এখন কেউ যদি নানান প্রযুক্তির সাহায্যে কণ্ঠকে ব্যবহার করে তা আসলে স্থায়ী হবে না। যা কিছু মৌলিক, তার ক্ষয় নেই। তাই এখনো দেখবেন সারাদেশে প্রযুক্তিনির্ভর গানের চেয়ে মৌলিক গানের সংখ্যা অনেক বেশি। গিটারের চেয়ে বেশি বাজে দোতরা। 

লকডাউনের সময়টিতে কী করলেন?

লকডাউনের প্রথম দিকটাতে অন্য অনেকের মতো আমিও জড়সড়, ভীত ও বিমর্ষ ছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েই কাজ শুরু করি। নিজের মতো করে একটা বোধের জন্ম হয়েছে। আমি লাইভে গান করেছি, বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশ নিয়েছি, যতটুকু পারি সাহায্য সহযোগিতার চেষ্টা করেছি অসহায় মানুষদের জন্য। একসময় লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন জায়গায় যে সাহায্যগুলো যাচ্ছে, সেখানে শিশুখাদ্যের কোনো ব্যবস্থা নাই। এই জায়গাটা ধরে আমি বেশ কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। যতটুকু পারি চেষ্টা করেছি শিশুখাদ্যের জন্য ফান্ড গঠন করতে। অবশ্য শুরু থেকেই আমাদের জলের গানের উপার্জিত অর্থের ১০ শতাংশ টাকা আমরা টিনের বাক্সে জমা রাখি, বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার জন্য। এগুলো কেউ জানেও না। এবারের এই দুঃসময়ে আমরা সেখান থেকেও মানুষকে সহযোগিতা করেছি। এর বাইরে ১০-১৫টি গান তৈরি করেছি এই সময়ে। 

আমাদের সংগীতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?

আমাদের উপমহাদেশের মহান সব সংগীতজ্ঞ যেমন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিসমিল্লাহ খান, শচীন দেব বর্মণ... তারা তাদের সময়ে গান করে গেছেন। তাই বলে আর কিছুর দরকার নেই, তা কিন্তু না। সংগীত কখনো পরিপূর্ণ হবে না। আমরা সব সময় নতুনের অপেক্ষা করি। সংগীতে নতুন নতুন মুখ আসবে, নতুন পথ তৈরি করবেন তারা। 

বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমার অভিযোগ নেই, তবে আক্ষেপ আছে রাষ্ট্র ও সমাজের স্বীকৃতির জায়গাটিতে। এই যে আমরা শিল্পীরা লকডাউনের সময়টিতে কোনো স্টেজ পারফর্ম করতে পারলাম না, কাজ না করে ঘরে বসে থাকতে হলো... এসব শিল্পীর কীভাবে দিন কাটছে, কেউ খবর রাখেনি। এই অবস্থা তো প্রত্যাশিত নয়, এভাবে শিল্পীদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে দিনের পর দিন।

আপনি গান করেন, সংগীত পরিচালক, মঞ্চে অভিনয় করেন, ছবি আঁকেন। কোন কাজটি করতে সবচেয়ে ভালো লাগে?

একসময় এই প্রশ্নটা আমাকে খুব বিব্রত করত। কারণ বহুদিন ধরেই আমি মঞ্চে কাজ করি। ছবি আঁকি। গান গাই। নাটক সিনেমাতেও অভিনয় করেছি। এর মধ্যে কোনটা আসল আমি, তা নিয়ে নিজেও বিভ্রান্ত হতাম; কিন্তু এখন আর হই না। কারণ, আমি যখন যেটা করি তাতে আমার শতভাগ নিবেদন, সমর্পণ থাকে। ভালোবাসা থাকে। সবই আমার ভালোবাসার জায়গা। কেউ একটা কাজ করেই সন্তষ্ট থাকে। আর আমি সবই ভালোবাসা নিয়ে করি।

পাঠকদের জন্য আজকের সাক্ষাৎকারের শেষ কথা কিছু বলুন?

শেষ বলে কিছু নেই। আছে কেবল শুরু। যতদিন বেঁচে আছি, কাজ করে যাব। পাখি যেমন গান গেয়ে যায়... কেউ শুনুক বা না শুনুক। আমিও তেমনি আমার গান গেয়ে যাব কোনো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তোয়াক্কা না করেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //