দুয়া আল-কারওয়ান

চলচ্চিত্র সংস্কৃতিরই আয়না। তাতে ভাষা ও মানুষের রুচিবোধ ফুটে ওঠে। জীবনের প্রভাব অপূর্ব কায়দায় প্রদর্শন হতে পারে। ফলে পৃথিবীজুড়ে নানা দেশে নানা ভাষায় যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে, আরবি চলচ্চিত্রও তাতে অগ্রগণ্য। অধুনা আরব বিশ্বে যদিও এর একটা নতুন বৈপ্লবিক সূচনা হয়েছে। তবে সংখ্যায় স্বল্প হলেও বিশ্ব চলচ্চিত্রে বেশকিছু মাস্টারপিস সিনেমা উপহার দিয়েছে আরব বিশ্ব। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ কাজ করেছে মিশর। কেবল সিনেমাই নয় বরং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সবক্ষেত্রেই পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে দেশটি। সেই প্রাচীনকালে যেমন নীল নদের ধারে গড়ে উঠেছিল মিশরীয় সভ্যতা। হাজার বছরে তাতে মিশেছে অসংখ্য জনজীবনের স্রোত। তেমনি আধুনিক সময়ে এসেও এই দেশ তার আবশ্যিকতা ধরে রেখেছে।

যে কোনো প্রগতিশীল কর্মকান্ড ও সংস্কারে তারা আরব ভূখণ্ডের অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে থেকেছে। তাদের মেধা আর মননের বিকাশও প্রোজ্জ্বল। ফলে সাহিত্যে যেমন তারা সমগ্র আরব বিশ্বের উপর ছড়ি ঘুরায়, তেমনি সিনেমাতেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের আছে অসংখ্য সেরা চলচ্চিত্র। তালিকা করতে গেলে অবশ্যই যেখানে জায়গা করে নেবে বিখ্যাত ‘দুয়া আল-কারওয়ান (The Nightingale’s prayer)।’ এ লেখায় আজ আমরা দারুণ এই সিনেমাটি নিয়েই আলোচনা করব। 

সবারই জানা, একটা সেরা চলচ্চিত্র নির্মাণে অবশ্যই প্রয়োজন একটা সেরা চিত্রনাট্য। গল্পই মূলত একটা সিনেমার প্রধান বিষয়। তারপর তাতে প্রাণ আসে চরিত্রদের মুনশিয়ানায়। হয়ে ওঠে মানুষেরই জীবনের আখ্যান। ফলে এ সময়ে যদিও বহুবিধ যন্ত্র, টুলস এবং নানা আধুনিক কারসাজিতে একটা সিনেমায় প্রাণ দেয়া হয়; কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছর আগে এসব বিষয়আশয় ছিল না। সেসময় মূলত একটা সিনেমা হতো গল্পনির্ভর। তাই যদিও তাতে অত রঙ ছিল না, ছিল জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতা। অকৃত্রিম রহস্যে মোড়ানো জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত আর বাঁক বদল। অতএব, বিগত শতকের দশটি প্রধান আরবি সিনেমাকে আলাদা করা হলে ‘দুয়া আল-কারওয়ান’ বা ‘The Nightingale’s prayer’ সেই দশটির একটি। এটি এমন এক সিনেমা, যাতে গত শতাব্দীতে আধুনিক মিশরের বিস্ময়কর দুটি মেধা এক হয়ে গিয়েছিল। একজন সাহিত্যের, অন্যজন চলচ্চিত্রের। একজন মহান ত্বহা হুসাইন, অন্যজন গ্রেট হেনরি বারাকাত। আদতে ত্বহার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দুয়া আল-কারওয়ানের’ উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে গত শতকের গুরুত্বপূর্ণ এই আরবি সিনেমা। 

আরেকটু বিস্তারিত বললে, বারাকাতকে বলা হয় ধ্রুপদী আরবি সিনেমার প্রভু। আর ত্বহা হলেন ‘দ্য ব্লাইন্ড প্রফেসর অব অ্যারাবিক লিটারেচার।’ ফলে বুঝতেই পারছেন, এমন দুজন মহান ব্যক্তি যখন কোনো শৈল্পিক কাজে একতাবদ্ধ হন, তখন তাতে কী ঘটে! তাই নিশ্চয় তাতে কেবলই দৃশ্যের ঘোরাঘুরি নয়, বরং জীবনের নিগূঢ় সত্য ও টানাপড়েনকেই তুলে ধরে এ সিনেমা।

যা হোক, আমরা এবার সিনেমার অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। এ ছবির প্রধান একটি চরিত্র আমনা। যার বড় বোনকে তার মামা পারিবারিক সম্মানের দোহাই দিয়ে তার মা ও তার সামনেই হত্যার অভিপ্রায়ে ছুরিকাঘাত করে। তাদের কোনোরূপ সহযোগিতা না করে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে। অথচ এই মৃত্যুতে আমনার পরিবার তেমন কোনো গা-ই করে না। মায়ের আচরণে আমনা বুঝতে পারে, যেন তার হতভাগ্য বোনটির এ মৃত্যু প্রাপ্যই। কেননা মায়ের ভাষ্য অনুযায়ী সে তাদের পরিবারের অসম্মান করেছে; কিন্তু তাদের এই কুযুক্তি কোনোভাবেই আমনা মানে না। সে বিশ্বাস করে, বোনের মৃত্যুসহ সামগ্রিকভাবে তাদের এই পারিবারিক দুর্দশার জন্য তার মামাই দায়ী। ফলে প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলে ওঠে সে। এবং সেই প্রকৌশলীর ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়, যে তার বোনকে প্ররোচিত করেছিল। তাকে মিথ্যা বলেছিল এবং মামার আঘাতের পর ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় তার মৃত্যু হয়েছিল।

বোনের মৃত্যুর পর প্রতিশোধ নিতে আমনা ছদ্মবেশ ধারণ করে। পরিচারিকার কাজ করতে সেই প্রকৌশলীর বাড়িতে প্রবেশ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বারকয়েক তাকে বিষ খাওয়ানোরও চেষ্টা করে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার সমস্ত পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়। অগত্যা বুঝতে পারে যে, তাকে খুন করা তার পক্ষে অসম্ভব। অন্যদিকে আবার সে প্রকৌশলী ক্রমশই তাকে অন্তরঙ্গ করার চেষ্টা করে; কিন্তু আমনা তার সর্বোচ্চ দিয়ে তা প্রতিরোধ করে। যা প্রকৌশলীকে তার প্রতি আরও আকৃষ্ট করে তোলে। 

এভাবে দিনের পর দিন আমনা একইভাবে ব্যর্থ হয়। তখন ভাবে, এবার আর প্রতিরোধ নয়। বরং ভালোবাসার অভিনয় করেই তার জীবন ধ্বংস করবে সে। কিন্তু না! গল্পের এই পর্যায়ে নতুন এক সাসপেন্স আসে এতে। প্রতিশোধ রূপ নেয় প্রেমে। ক্রোধের বিরুদ্ধে আসে মায়া। সময়ের আবর্তে, প্রকৌশলীর প্রতি অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে তার। ধীরে ধীরে অপ্রত্যাশিতভাবে তার চিন্তাতে যেন প্রকৌশলীর প্রতি অনুরাগ জন্মে। অসহায় আমনা নিজের এসব চিন্তাকে প্রাণপণে দূর করে। নতুনভাবে ফন্দি আঁটে। এভাবে বহু প্রচেষ্টার পরও সে ব্যর্থ হয় এবং তারা দুজনই অনুরাগের সমুদ্রে নিপতিত হয়। ফলে আমনা প্রকৌশলীকে তার সমস্ত সত্যপরিকল্পনার কথা বলে দেয়। জানায়, কে সে? এবং স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে তাই প্রকৌশলীকে ছেড়ে চলে যাবে; কিন্তু ইতোমধ্যে তার সে মামা গুপ্তচরের মাধ্যমে এই পুরো ঘটনাটি আবিষ্কার করে যে, অ্যাদ্দিনে আমনা কীসব কর্মকাণ্ড করেছে। তাই পরিবারের সম্মানহানি হয়েছে বলে, সেই চাচা তার বোনের মতো আবার তাকেও খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে গল্পের শেষাংশে আমনা যখন প্রকৌশলীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে, ঠিক সেই মুহূর্তে তার মামা বন্দুক নিয়ে এসে হাজির হয়। বিনাবাক্যে তার প্রতি গুলি ছুড়লে প্রকৌশলী তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের জীবন উৎসর্গ করে। যেন নিজের প্রাণ দিয়েই আমনার ভালোবাসাকে পরিপূর্ণতা দিল সে। আমনার বিদ্বেষ, বেদনা ও প্রেমপূর্ণ কোলেই মৃত্যুর সুধা পান করল।

গল্পের এমন পটপরিবর্তনে পুরো সিনেমাজুড়ে আদতে দুটি চরিত্রই দর্শককে আটকে থাকতে বাধ্য করে। তারা ফাতেন হামামা ও আহমেদ মাজহার। ফাতেন থাকেন আমনার চরিত্রে, আর প্রকৌশলী চরিত্রে আহমেদ। তারা উভয়েই এতে এমন পারদর্শিতা দেখান, যাতে মুহূর্তের জন্য দর্শক তাদের চোখ সরাতে পারে না। বিশেষত ফাতেন হামামা ছিলেন এতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার সংলাপ, অঙ্গভঙ্গি, প্রতিশোধ, প্রেম এমনকি বেদনার চিত্রায়ণও ছিল এমনই অকৃত্রিম- সে সময় আরব বিশ্বের দর্শকরা যার অনিঃশেষ বন্দনায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এত অল্প বয়সে তার সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতাপূর্ণ অভিনয় সকলকেই বিস্মিত করে। যাতে কোনোকিছুই কল্পিত মনে হয়নি। কোনো ভূমিকাই নিস্তেজ লাগেনি। যেন দীর্ঘ সিনেমা-যাত্রার শুরুতেই তিনি তার আগমনী বার্তা দিলেন। ফলে নিঃসন্দেহ পরবর্তী সময় তিনি মহান তারকাই হয়ে উঠেছিলেন। 

সর্বোপরি, গল্প, অভিনয়, থিম, চিত্রনাট্য, মিউজিক ও নির্দেশনাসহ সব ক্ষেত্রেই এটি এমন এক ছাপ রাখা, আরব সিনেমার ইতিহাসে যা চিরস্মরণীয়। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৬ সালে, মিশরীয় সিনেমার শতবর্ষ উদযাপনকালে এটি সেরা ১০০ মিশরীয় চলচ্চিত্রের একটি বলে নির্বাচিত হয়। ২০২০ সালে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক পিটার ব্র্যাডশ এ সিনেমাটিকে সর্বকালের সেরা আফ্রিকান সিনেমার একটি বলে মন্তব্য করেন। এটিকে ‘an extravagant revenge melodrama, or Beauty-and-the-Beast fable’ বলেও আখ্যা দেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //