যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে ইফতার যেমন

রমজান মাস এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন গাজা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ এ বিশ্ব দেখেনি। উপত্যকায় ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে পড়ছে বোমা। নেই স্বাস্থ্যকর ইফতার বা সেহরি তৈরির ব্যস্ততা। সর্বত্র বোমা আর মৃত্যু আতঙ্ক। মৃত্যুই যেন জীবনের উপলক্ষ। এর মাঝেও জীবন প্রবহমান।

সূর্যাস্তের সময় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি কংক্রিটের স্ল্যাবের উপর কম্বল বিছিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসেছিলেন ছয় সন্তানের পিতা খালিদ আল-নাজি। তারা ইফতারের জন্য সামান্য টাটকা খাবার সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। আগের কয়েক দিন ইফতারের জন্য তাদের কিছুই ছিল না। খালিদ বলেন, ‘আপনি সন্তানদের কেবল সামান্য কিছু খাওয়াত পারবেন এবং সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকবেন, যে কোনো সময় বোমা পড়তে পারে। গাজা উপত্যকায় আমাদের জন্য এখন যে অবস্থা, তাতে মৃতদেরও হিংসা হয়। এই বছর আমরা আসলে রমজান মাসে নেই, আমাদের হয়তো এর নাম পরিবর্তন করা উচিত। আমরা এখন আছি মৃত্যু মাসের মধ্যে।’

দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে বসবাস করতেন ৩৭ বছর বয়সী নারী হানা আল মাসরি। প্রায় আড়াই মাস আগে ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। স্বামী ও ছয় সন্তানকে নিয়ে এখন আছেন রাফাহর অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরের জীর্ণ এক তাঁবুতে। রমজান মাসে তারা বরাবরই বাড়িতে আলোকসজ্জা করতেন, স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু খাবার বানাতেন সেহরি আর ইফতারের জন্য। এবার সবকিছুই অন্যরকম। হানা বলেন, ‘আমার মেয়েরা সাজসজ্জার জন্য একটু একটু করে অর্থ সঞ্চয় করত এবং প্রতিবছর আমি একটি নতুন লণ্ঠন কিনতাম। পুরো রমজান মাসে পরিবারের জন্য পনির, জ্যাম, মটরশুঁটি ও ডিম দিয়ে একটি খাবার তৈরি করতাম।’ 

রমজান মাসে নতুন সাজে সেজে ওঠার কথা ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সড়ক। ইসরায়েলি হামলা সেই আলো কেড়ে নিয়েছে। গাজার দীর্ঘশ্বাস গিয়ে মিশেছে পশ্চিম তীরেও। রমজানের সময় পুরনো জেরুজালেম শহরের সরু সরু গলিতে অন্য সময়ের চেয়ে ভিড় বেশি থাকে। গলিতে গলিতে থাকে আলোকচ্ছটা। এবার তার কোনো কিছুই নেই। স্থানীয় বাসিন্দা উম আম্মার বলেন, ‘এবার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। সবার মনে একটি বিষয়ই কেবল ঘুরছে, গাজার সংঘাত। আমরা তো ইফতার করব; কিন্তু গাজায় হয়তো হাজার হাজার মানুষ কিছু খেতেই পাবেন না। সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। গাজায় যারা বসবাস করেন, তারা আমাদের লোক। তারা কষ্ট পাচ্ছেন। তাই আমরাও রমজানে কোনো আনন্দ করব না।’

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানাচ্ছে, গত প্রায় তিন মাস ধরে গাজার বেশিরভাগ মানুষই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। রমজান মাস এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে, যখন ‘গাজার সর্বত্র ক্ষুধা’। রোজার মাসে ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি’র আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে উপত্যকায় ক্ষুধা সইতে না পেরে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৩ জন শিশু রয়েছে।

ইউএন উইমেন বলেছে, পরিবারে না খেয়ে থাকাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই মায়েরা। তারা বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য অন্তত এক বেলা না খেয়ে থাকছেন। ১০ জনের মধ্যে ৯ জন নারী জানিয়েছেন, পুরুষদের তুলনায় খাবার পাওয়া তাদের জন্য অনেক কঠিন। কেউ কেউ এখন ধ্বংসস্তূপের নিচে, ডাম্পস্টারে বা অন্যান্য স্থানে খাবারের জন্য খোঁজাখুঁজি করছেন। 

তবু বেঁচে আছে প্রাণ। উপত্যকার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে বেশিরভাগই বর্তমানে রাফাহ এলাকায় তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে। মৌলিক চাহিদা ও খাদ্যের তীব্র সংকটের কষ্ট সত্ত্বেও ইসরায়েল তাদের সবকিছু কেড়ে নিতে পারেনি। রমজানকে স্বাগত জানাতে রাফার অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে ছেঁড়া তাঁবু সাজিয়ে চলেছে সেখানকার শিশুরা। শরণার্থী শিবিরের সরু পথে তারা কাগজের ফুল আর শুভেচ্ছা কার্ড বানাতে ব্যস্ত। এভাবেই মৃত্যু বাস্তবতার মাঝেও জীবনের গান গাইছে গাজাবাসী।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //