ভূমিকম্পের ভেতর থেকে জেগে উঠছে মারাকেশ

মরক্কোর মারাকেশ শহরের অন্য সবার মতোই ৩৯ বছর বয়সী জাকারিয়া লামনিচরি ছয় মাস আগে ভূমিকম্পের সময় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। শহরের কেন্দ্রস্থলে তার দোকান। সেখানে বসে তিনি সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা রোমন্থন করেন যখন ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প কাছাকাছি পর্বতগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। 

জাকারিয়া বলেন, ‘ওই মুহূর্তগুলো যারা পার করেছেন, তারাই শুধু এর ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন। আমার স্ত্রী এবং ছেলে পাহাড় থেকে দূরে ছিল। আমি এখানে তাদের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তাদের জন্য সেই ভয়াবহতা কয়েক দিন ধরে চলেছিল। উদ্ধারকারীরা ছোট, বিচ্ছিন্ন গ্রামে পৌঁছানোর জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করছিল। অ্যাটলাস পর্বতমালার অনেকের মতো আমার পরিবারও ছিল এমন এক জায়গায়, যেখানে শুধু গাধা বা ছোট মোটরসাইকেল বা মোপেডে চড়ে যাওয়া যায়। কেউ এমন অবস্থার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। কেউ জানত না কী করতে হবে। যা আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে, তা হলো অন্য লোকজনের মানবিক সংকট। অনেক ধনী ব্যক্তির আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অনেকে সন্তান হারিয়েছেন।’

যদিও ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলটি প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে; কিন্তু মারাকেশ ছিল ধ্বংসযজ্ঞের কেন্দ্র। তবে পর্যটকরা আবারও ফিরে এসেছেন উত্তর আফ্রিকার শহরটিতে; যা মারাকেশের ধ্বংসাবশেষ থেকে জীবনের পথে ফেরার বার্তা বহন করে। যদিও পাহাড়ে বা সমতল এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য এখানে স্থায়িত্বের অনুভূতি হারিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আগামীতে অতীতের মতো একই রকম ফল তারা পাবে, এমন আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরেছে।

ইতিহাসের সমাপ্তি
মারাকেশের পুরনো শহরকে বলা হয় ‘মদিনা’। আরবিতে এর অর্থ শহর। ভূমিকম্পের পর মদিনায় যাতায়াতের ১২ শতকের পথগুলো বিশাল পাথরের টুকরোতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা হয়েছে। এখানকার পুরনো বাড়ি ও স্থাপনাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইহুদি অধ্যুষিত এলাকা মেল্লাহতেও একই অবস্থা। যেখানে একসময় বাড়ি ছিল, সেখানে যেন আলগা পাথরের জমি দাঁড়িয়ে আছে।

পুরনো শহরের বাসিন্দা করিম নাসিরের বাড়িও ভূমিকম্পে আক্রান্ত হয়। স্ত্রী ও সাত বছরের ছেলেসহ তিনি দীর্ঘসময় অন্ধকারে আটকে ছিলেন। ২৭ বছর বয়সী মসলা বিক্রেতা আব্দুল সামাদ বলেন, ‘অনেক পরিবার বাড়ি পরিবর্তন করেছে। অনেক পরিবার এখান থেকে চলে গেছে। এক মুহূর্তে তাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আমার পরিবারও বাড়ি পরিবর্তন করেছে।’ দেয়ালের ফাটলগুলো তার কথার সত্যতার জানান দিচ্ছে। 

যদিও ক্ষয়ক্ষতি মদিনার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে, এমনকি ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা কুতুবিয়া মসজিদও ব্যাপক আকারে ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তবে মেল্লাহ জুড়ে যে বাড়িগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রক্ষা করা হয়েছিল, সেগুলো আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাসিন্দারা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া গুদামঘরে থাকতে বাধ্য হন। 

পর্যটকরা ফিরে এসেছে
ভূমিকম্পের খবর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে পর্যটকরা তাদের ভ্রমণ বাতিল করে। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। এটি মরক্কোর অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ যা বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির সময় থমকে গিয়েছিল। কঠোর নিয়ম-নীতি উঠে গেলে পর্যটকরা ফিরে আসতে থাকে। ধ্বংস ও প্রাণহানি সত্ত্বেও ২০২৩ সালে একটি রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক এসেছে। এ খাতে গত বছর এর আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এমনকি ফেব্রুয়ারিতে, পর্যটন মৌসুম না থাকলেও পর্যটকদের আগমন খুব কম ছিল না। ইহুদি জেলা মেল্লাহর বাসিন্দা ২৬ বছর বয়সী নুরদ্দিন ইদার পশু-পাখির শোপিসের দোকান চালান। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর পর্যটকদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে যায়। তবে কয়েক সপ্তাহ পর তারা আবার ফিরে আসতে থাকে।’ তবে মদিনা যে ছিন্নভিন্ন রয়ে গেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পর্যটকদের এখন মদিনার অভ্যন্তরীণ সীমানাগুলো খুঁজে বের করতে হবে।

এই ভূমিকম্প জীবন সম্পর্কে অনেক মারাকেশবাসীর চিন্তা-চেতনাও বদলে দিয়েছে। জাকারিয়া বলেন, ‘এখানে যা ঘটেছে তারপর, আমরা বুঝতে পেরেছি, যে আমরা কিছুই নই। আমাদের এখন যা আছে, তা আমরা এক সেকেন্ডে হারাতে পারি। এটি পরিবার সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি দিয়েছে। আপনি জানেন, মানুষকে মরতে হবে। এ জীবন চিরস্থায়ী নয়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //