অর্থনৈতিক সংকটে নাজেহাল মিশর

গত এক বছর ছিল মিশরে রেকর্ড মূল্যস্ফীতির আর বাণিজ্য ঘাটতির বছর। দেশটির মুদ্রা পাউন্ডের অবমূল্যায়ন হয়েছে নজিরবিহীন। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ফুরিয়ে আসছে। বাড়ছে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি। আমদানি-রপ্তানি নীতি ঠিকমতো কাজ না করায় বাণিজ্য ঘাটতি প্রকট হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট আরও বেড়েছে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায়। 

আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিশরে বর্তমানে প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ মানুষের বাস। দেশটির সঙ্গে গাজা ও ইসরায়েল উভয়ের সীমান্ত রয়েছে। মিশরে ক্ষমতাসীন একনায়ক আল-সিসি সরকার এখন তাদের সব দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের ওপর। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছিল। প্রসঙ্গত, চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন সপ্তম সপ্তাহে গড়িয়েছে, যা অনিশ্চয়তা ও ভয়ের জন্ম দিয়েছে অঞ্চলটিতে। তবে মিশরের অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঢেকেছে এ যুদ্ধের জন্য নয়; বরং একনায়ক প্রশাসনের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং উন্নয়নের ভ্রান্ত নীতিই এর মূল কারণ। গত অক্টোবরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তার অনেক আগে থেকেই মিশর খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করছিল। দেশটির বিদেশি ঋণ ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার এবং বার্ষিক আমদানি বিল ৯ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশটির মুদ্রার বিনিময় হার কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। আর মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্লেষকদের মতে, অতিরিক্ত ঋণ, অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল মেগাপ্রকল্প, স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের ওপর অধিক নির্ভরতা এ সংকটের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। ব্যবসায়ীদের মতে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে কালোবাজারে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৫১ পাউন্ড, যা ব্যাংক রেট থেকে ২০ পাউন্ড বেশি।

ডলারের বড় ধরনের সংকট আমদানিকে কঠিন করে তুলেছে। অনেক পণ্য বন্দরে পড়ে রয়েছে, যার আবার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় শিল্পের ওপর। বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের বিষয়টি মিশরের জন্য ব্যাপক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ২০২৪ সালে ঋণ পরিশোধের জন্য দেশটির ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ প্রয়োজন। রিজার্ভ ঘাটতির কারণে বন্দরে আটকে থাকা আমদানি পণ্যের ৫০০ কোটি ডলার বকেয়া পড়ে রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ ফেরত দিতে সমস্যা হচ্ছে।

কায়রোর এক শিল্পপতি জানান, আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে আটকে থাকা আমদানিকৃত পণ্য খালাস করতে কালোবাজার থেকে তিনি ডলার কিনেছেন। ব্যাংকে অফিসিয়াল রেট প্রযোজ্য হওয়ায় তাকে অনেক টাকা খোয়াতে হয়েছে। তেল ও গ্যাস খাতের বাইরে বিদেশি বিনিয়োগ সামান্যই পায় মিশর। ফলে অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে হচ্ছে প্রবাসী আয়, সুয়েজ খাল থেকে পাওয়া অর্থ এবং পর্যটনের মতো খাতকে। দেশটির পর্যটন খাতও বর্তমানে কঠিন সময়ের মুখোমুখি। দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। প্রতিবেশী দেশে যুদ্ধ-নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে গিজা পিরামিড বা মিশরীয় জাদুঘরের জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বুকিং বাতিল করেছে বিদেশিরা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে একজন ট্যুর গাইড জানান, তারা প্রায় ২০ শতাংশ বুকিং বাতিলের মুখোমুখি হয়েছেন।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা মাদবৌলি সম্প্রতি জানান, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি একটি ক্ষণস্থায়ী সংকট, এটি শিগগির কেটে যাবে। যদিও তিনি এ আশাবাদের পেছনে কোনো কারণ উল্লেখ করেননি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণাকে সমালোচকরা ‘নিছক কথার কথা’ বলে মন্তব্য করেছেন।

মিশরের অর্থনৈতিক শোচনীয় অবস্থায় উপসাগরীয় দেশগুলো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে বলে ধারণা করছেন অনেকে। যদিও দেশগুলোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি। এর আগে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতারের মতো দেশগুলো মিশরের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে মিশরীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলার আমানত রেখেছে। এ ছাড়া দেশটির অন্যান্য খাতে আরও এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়ে রেখেছে। তবে এসব প্রণোদনা তেমন কাজে আসছে না।

এমন খারাপ অবস্থার মধ্যেও গত অর্থবছরে মিশরের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তা প্রায় ৪ থেকে ৫ শতাংশের মতো। সমস্যা হলো, এই প্রবৃদ্ধির সুফল মানুষ পাচ্ছে না। অনেক মিশরীয় বলেন, তাদের জীবনযাত্রার মান কেবল খারাপই হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, স্থানীয় মুদ্রাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখা, সম্পদের অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং মাথাভারী প্রশাসন ও বিশাল সেনাবাহিনী- এমন অনেক কিছুর কারণেই প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হয়নি। তৈরি হয়নি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশও। ভর্তুকির নামে যা হয়েছে, তা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য নয়; বরং শুধু বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তা করা হয়েছে। মিশরের ৬০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে কিংবা এই সীমার কাছাকাছি বাস করে বলে ধারণা করা হয়। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার একটি অংশ ধসে পড়ার মুখে রয়েছে। স্নাতকদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে যেতে চান।

মিশরের ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। তবে বিশ্লেষকেরা ঠিক একমত নন যে এই ঋণ কতটা ঝুঁকি তৈরি করছে। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় জিডিপির ৯৩ শতাংশে। কয়েক বছর ধরে এই হার বাড়ছে। তবে সরকারের লক্ষ্য, ২০২৬ সালে এটি কমিয়ে ৭৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। ঋণের বোঝা, ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা সুদের হার এবং দুর্বল মুদ্রার কারণে ঋণ পরিশোধে সরকারের খরচ বাড়ছে। জুনে শেষ হওয়া বছরে আদায় করা রাজস্বের ৪৫ শতাংশ কেবল ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হয় বলে জানা যায়। বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের কারণে বৈদেশিক তহবিলে ঘাটতি বাড়ছে। আগামী তিন বছরে মিশরকে অবশ্যই আইএমএফকে এক হাজার ১৪০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে।

সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের মতো নিয়মিত খরচের বাইরে সিসির শাসনাধীনে থাকা মিশর অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে গৃহ নির্মাণ, নতুন শহর গড়ে তোলা ও একের পর এক সড়ক তৈরি। সবচেয়ে বড় মেগা প্রজেক্ট হলো কায়রোর পূর্ব দিকে মরুভূমির মধ্যে একটি নতুন রাজধানী শহর নির্মাণ। এক কর্মকর্তা জানান, শহর নির্মাণে ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের খরচ জোগাতে ভূমিও বিক্রি করা হচ্ছে।

গত এক দশকে মিশরের অস্ত্র আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (সিপরি) মতে, অস্ত্র আমদানিকারকদের তালিকায় মিশর তৃতীয় স্থানে রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, তারা গরিবদের জন্য সামাজিক খাতে খরচ বাড়িয়েছেন। এর মধ্যে একটি হলো ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সাহায্য দেওয়া। তবে বিশ্লেষকদের মতে, জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে এই সাহায্য খুব একটা কাজে আসছে না। মিশর তার প্রধান খাদ্য-সামগ্রীর ৬৫ শতাংশ আমদানি করে এবং প্রধানত ডলারে মূল্য পরিশোধ করে। এর ফলে ভোক্তারা দোকান থেকে উচ্চহারে নগদ মূল্য দিয়ে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর যখন তারা মিশরীয় পাউন্ড দিয়ে পণ্য কিনছেন, তখন তাদের জীবন আরও দুঃসহ হয়ে উঠছে।

দেশের এই খারাপ অবস্থার জন্য প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি অবশ্য প্রায়ই দায়ী করেন ২০১১ সালের আন্দোলন-পরবর্তী অস্থিরতা এবং জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে মিশরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৭ শতাংশ। আর ২০২০ সাল থেকে কর্তৃপক্ষ আরও দুটি কারণের কথা উল্লেখ করে- করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ। তবে মিশরীয় পাউন্ডের দাম ধরে রাখার জন্য ব্যয়বহুল পদক্ষেপ, শেয়ারবাজারে অস্থির বিদেশি বিনিয়োগ এবং কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রমে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

মিশরের রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী সাইদ সাদেক বলেন, ‘মিশর এবং অন্য অনেক আরব দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের থেকে অন্যতম প্রধান খাদ্য গম ক্রয় করে। এই গম দেশগুলোর অর্থনীতির নিয়ামক। গমের দাম এবং আরও কিছু খাদ্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মুল্যবৃদ্ধির কারণে, গত বছর মূল্যস্ফীতির হার কম-বেশি ২০ শতাংশ বেড়েছে। এটা দেশটির অর্থনীতিকে চাপে ফেলে দিয়েছে।’

আটলান্টিক কাউন্সিলের ওয়াশিংটনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক পল সালিভান বলেন, ‘সাধারণ মিশরীয়দের জীবন কঠিনতর হয়ে উঠছে। এদের বেশিরভাগই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। পশুখাদ্যসহ বিবিধ পণ্য আমদানি অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। আর আমদানির জন্য ডলার পাওয়া সাম্প্রতিক অতীতের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //