রয়টার্স বিশ্লেষণ: পশ্চিম তীর ইসরায়েলের সম্ভাব্য 'তৃতীয় ফ্রন্ট'?

গাজা উপতক্যায় দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েল বাহিনীর ক্রমাগত বোমাবর্ষণে  সহিংসতা বেড়েই চলেছে। একইসঙ্গে লেবানন সীমান্তেও হিজবুল্লাহর সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে ইসরায়েল বাহিনীর। আর এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ বাড়ার পাশপাশি যে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে তা হলো এ সংঘাতের ফলে ফিলিস্তিনি অঞ্চলটি একটি সম্ভাব্য তৃতীয় ফ্রন্টে পরিণত হতে পারে!

ইসরায়েল গাজা অঞ্চলটিতে হামাস গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে তাও বহুদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পরে ২০০৫ সালে ইসরায়েলি বাহিনী এবং বসতি স্থাপনকারীরা গাজা থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। তবে ইসরাইয়েল এখনও পশ্চিম তীর তাদের দখলে রেখেছে। ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের পর থেকেই  ইসরায়েল এ অঞ্চলটি তাদের কব্জায় নিয়ে নেয়। 

গাজা নিয়ন্ত্রণকারী হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর এক আকস্মিক হামলায় ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করে। আর এর পালটা জবাবে ইসরায়েল বাহিনীর বোমাবর্ষণে গাজার সাড়ে তিন হাজার নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে হামাসকে পরিপূর্ণ নির্মুল করতে গাজায় পূর্ণ মাত্রায় স্থল হামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে ইসরাইল।

এদিকে লেবাননের ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ বাহিনী দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসাবে পশ্চিমতীরে হামাসদের সহায়তায় এগিয়ে আসার পর ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমা দেশগুলো এ অঞ্চল ঘিরে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কা করছে। আর এর মধ্যদিয়েই পশ্চিমতীরকে ইসরায়েলি মিডিয়া এটিকে সম্ভাব্য তৃতীয় ফ্রন্ট হিসাবে দেখছে।

ইসরায়েলি সেনা ও গাজা এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষ ইতোমধ্যেই প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া হামলায় পশ্চিম তীরে ৮০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহতের পাশপাশি ৯০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েল বাহিনী। 

ইসরায়েলি বাহিনী বৃহস্পতিবার পশ্চিম তীরের একটি ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে স্থল ও বিমান হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১২ জনকে হত্যা করে বলে জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা। অন্যদিকে ইসরায়েলি পুলিশের ভাষ্য, অভিযানের সময় তাদের একজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।

এমন সহিংসতা ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) উভয়ের জন্যই বড় একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, কারণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একমাত্র ফিলিস্তিনি গভর্নিং বডির সদর দফতরও সেখানেই অবস্থিত। 

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে যে, তারা পশ্চিম তীরে হামাস জঙ্গিদের হামলার মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন কনরিকাস রয়টার্সকে বলেন, হামাস লেবাননের সীমান্ত এবং পশ্চিম তীর সহ "ইসরায়েলকে দুই বা তিন-ফ্রন্ট যুদ্ধে নিপতিত করার" চেষ্টা করে চলেছে। "এমন হুমকি আমাদের কাছে রয়েছে আর এটিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছি" বলেও জানান তিনি। 

'মানুষকে অস্ত্র দাও, সংঘর্ষ শুরু হতে দাও'

পিএ’র ক্ষমতাসীন ফাতাহ পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বীরা রামাল্লায় সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য হামাসের সামরিক শাখাকে সমর্থন করে এই সপ্তাহে একটি বিরল স্লোগানে মুখরিত করে তুলে এ অঞ্চলটি। তাদের মুখে একটাই কথা উচ্চারিত হচ্ছে- "মানুষকে অস্ত্র দিন, তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হোক। আমরা দেখাব আমরা কী করতে পারি"- সালাহ নামের ২০ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারীর মুখে এ স্লোগান ক্রমেই আরও বেশি প্রকম্পিত করে তুলেছে এ অঞ্চলটিকে। 

ফাতাহর এক কর্মকর্তা মোওয়াফাক সেহওয়েল রয়টার্সকে বলেন: "আমাদের লাগাম ছেড়ে দেওয়া উচিত এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে কোনও উপায় ব্যবহার করা উচিত।"

একটি আর্কিটেকচার ফার্মের মালিক নিজার মুগরাবি বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় তিনি বিরক্ত কিন্তু বন্দুক তুলতে প্রস্তুত নন।

তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে উল্লেখ করে বলেন, "নেতানিয়াহু যুদ্ধ করতে চান, হানিয়া যুদ্ধ করতে চান। তাদের বন্দুক মরুভূমিতে রেখে একে অপরকে গুলি করতে দিন।" 

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা এবং ইসরায়েলি বিশ্লেষকরা বলছেন যে বেশ কয়েকটি কারণ উভয় গোষ্ঠীকেই যুদ্ধের জন্য আরও উত্তেজিত করতে সহায়তা করছে, তবে বিপরীতভাবে এটিও সত্য যে আপাতত তাদের সুযোগও সীমিত আকারে রয়েছে। 

অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো শতাধিক ইসরায়েলি এরইমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে তাই এখনই এতটা বিস্তার লাভের সুযোগ কম দেখছেন বিশ্লেষকরা।  গ্রেপ্তারের বিষয়ে ৫২ বছর বয়সী সালাহ আল-খাজা, নামের এক বসতিবিরোধী কর্মী বলেন, "গাজায়, সামরিকভাবে সংগঠিত হওয়ার জন্য (হামাসের জন্য) যথেষ্ট সময় রয়েছে।" 

তিনি বলেন, "এখানে ইসরায়েল বাহিনী তাদের দৈনিক দখলদারিত্ব চালিয়ে যেতে পারে দমনের মধ্যদিয়ে, তবে তাতে করে তাদেরকে সামরিক বা রাজনৈতিক বাহিনী গড়ে তোলার কোন জায়গা ছেড়ে দিবে না গাজাবাসীরা।"

ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং একটি জটিল সমীকরণ 

হামাস যখন গাজা অবরোধ করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল, তখন পশ্চিম তীরের পাহাড়ি শহর, ইসরায়েলি বসতি এবং সেনা চেকপয়েন্টগুলোর মধ্যে এমন  একটি জটিল প্যাচওয়ার্ক নির্মিত হয়েছে যা ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়গুলোকে বিভক্ত করতে আরও বেশি সহায়তা করেছে। 

ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডটি দখল করে এর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা বৃহৎ অঞ্চলকে ছোট ছোট এলাকায় ভাগ করে নিয়ে একাংশ ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় আর ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। তবে রামাল্লা এবং দরিদ্র জনবসতি এলাকাগুলোয় নিজেদের ক্ষমতার আসনের মধ্যে লড়াইয়ের পাশপাশি সহিংসতা ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়েও তাদের মধ্যে একাধিক মতামত রয়েছে।

তবে সহিংসতা থামানোর আরেকটি মূল কারণ হল ৮৭ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের পিএ’র সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তা চুক্তি। আব্বাস গাজায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেছেন এমন সময়ে যখন তার নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের দমন শুরু করেছেন। 

ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক হানি আল-মাসরি বলছেন, "পিএ শান্তি বজায় রাখতে চায় এবং তারা চিন্তিত যে হাজার হাজার মানুষের মিছিল দ্রুত কয়েক কয়েক লাখে পরিণত হতে পারে।"

তিনি বলেন, পিএ কর্মকর্তারা আর্থিকভাবে ভাল অবস্থানে থাকতে এবং তাদের বেতন-ভাতাদি আদায়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন। আরও বলেন, আব্বাসের ভাবনা যদি তিনি তার বৃদ্ধ বয়সে তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন বা অসুস্থ হয়ে পড়েন তবে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। 

নিঃসঙ্গ নেকড়ে 

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সেবা শিন বেটের প্রাক্তন কর্মকর্তা লিওর আকেরম্যান বলেন, হামাসের যুদ্ধের আগে পশ্চিম তীরের অস্থিরতার আশঙ্কা ছিল।

তিনি বলেন, হামাস বছরের পর বছর ধরে "পশ্চিম তীরে সন্ত্রাসীদের সক্রিয় করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে আসছে।"

আকেরম্যান স্বীকার করেন, গাজায় বোমা হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তারের কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নাও হতে পারে।

তিনি জানান, "গত রাতে সেনাবাহিনী... পশ্চিম তীরে প্রায় ১০০ জন সন্ত্রাসীকে ধরেছে। এখন হতে প্রতিদিন... শিন বেট কেবল তাদেরই গ্রেফতার করবে যাদের সম্পর্কে সন্ত্রাসী হামলার প্রস্তুতির বিষয়ে তথ্য রয়েছে। 

সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য জনসমর্থন দেখিয়েছে, যার মধ্যে স্থানীয় মিলিশিয়ারা রয়েছে যা ঐতিহ্যগতভাবেই বিচ্ছিন নানা দলের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে যাচ্ছে।

ইসরায়েল সামরিক অভিযান জোরদার করেছে এবং ইসরায়েলিদের লক্ষ্য করে ফিলিস্তিনিরাও তাদের হামলার ছক কষে যাচ্ছে। 

জাতিসংঘ বলছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর প্রথম দিনেই ২২০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পক্ষান্তরে ইসরায়েলে কমপক্ষে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //