মারওয়ান বারঘৌতিকে নিয়ে অস্থির ফিলিস্তিনের রাজনীতি

ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ মারওয়ান বারঘৌতিকে প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার নেতা বলে গণ্য করা হয়। পৃথক পাঁচটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে তিনি এখন ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি। 

সম্প্রতি তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন, যা ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক অঙ্গনকে ব্যাপকভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে। জনমত জরিপেও তিনি এগিয়ে আছেন। নির্বাচনে জয়ী হলে তা নিশ্চিতভাবেই ফিলিস্তিনের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে। সেইসাথে এটি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতেও অনুপ্রেরণা জোগাবে বলেও মনে করা হচ্ছে। 

উল্লেখ্য, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গত মাসে ঘোষণা করেন, ফিলিস্তিন আইন পরিষদ (পিএলসি) নির্বাচন আগামী ২২ মে ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। ইয়াসির আরাফাত ২০০৪ সালে মৃত্যুবরণ করার পর মাহমুদ আব্বাসকে পিএলও চেয়ারম্যান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ও আব্বাস ২০০৫ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শান্তিপ্রক্রিয়ার ব্যর্থতা ও অব্যাহত ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের উত্থান ঘটে।

মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ পার্টি ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিন আইন পরিষদ বা পার্লামেন্ট নির্বাচনে ১৩২ আসনের মধ্যে মাত্র ৪৫টি ও হামাস ৭৪টি আসনে জয়লাভ করে। এরপর একাধিকবার নির্বাচন ও ঐকমত্যের সরকার গঠনের প্রচেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। ১৫ বছর পর আবারো নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলো। আব্বাস আশা করছেন, নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে হয়তো ফিলিস্তিনিদের অবস্থান ও মর্যাদা আরো সুদৃঢ় ও সমুন্নত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই ফিলিস্তিন ইস্যুতে পরিবর্তনের আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। মাহমুদ আব্বাসও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা বদলের পরই ফিলিস্তিনি সাধারণ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বহু তৃপ্তিদায়ক ও ভালো ভালো কথা বলে গেলেও ফিলিস্তিনিদের শান্তি, এমনকি আরব বিশ্বের জন্য তিনি তাৎপর্যপূর্ণ বা উল্লেখযোগ্য কোনো কিছু করতে পারেননি। ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তির পরিবর্তে তার দু’মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বরং গাজায় তিনটি ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন হয়ে থাকবে। এরপর গেল রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী আমল, যেখানে ‘মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা’ থেকে শুরু করে ইসরায়েলি দখলীকৃত এলাকাগুলো সমন্বিত করতে ও অবৈধ বসতি নির্মাণ অব্যাহত রাখতে উদাত্ত সমর্থন দিয়ে গেছে গোটা মার্কিন প্রশাসন। ফলে ওবামা ও ট্রাম্প যে বোঝা রেখে গেছেন, বাইডেনকে তা বহন করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন এক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত জবাব নয়; বরং এর ফলে ইসরায়েলি আগ্রাসন, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে নতুন দরজা খুলে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। আর তাই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে এগিয়ে আছেন ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি নেতা মারওয়ান আল বারঘৌতি। নির্বাচনে বারঘৌতি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হচ্ছেন অশীতিপর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও তার অনুসারীদের পক্ষ থেকে, যারা গত দুই দশক ধরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন। তবে ৬১ বছর বয়সী কারাবন্দি নেতা বারঘৌতির জন্য হয়তো স্বাধীন ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে বিপ্লবী ভাবাবেগে আপ্লুত করার এটিই শেষ সুযোগ।

ফিলিস্তিনে আসন্ন নির্বাচন আরও গুরুত্বপূর্ণ এর কারণ, গত ১৬ বছরে এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও গত ১৫ বছরে সংসদীয় নির্বাচন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ইসরায়েল কর্তৃক বাধার কারণে অনুষ্ঠিত হয়নি। যারা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ, তারাই শুধু অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন; আর বাকি ফিলিস্তিনিরা দখলদারিত্বের অধীনস্ত হয়ে তীব্র দারিদ্র্যের মুখোমুখি। ওই ধনী নেতাদের জন্য তাই দখলদার ইসরায়েলের কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রাজনৈতিক বন্দি মারওয়ান বারঘৌতি এক বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি নির্বাচিত হলে স্বাধীন ফিলিস্তিন গড়ার সংগ্রামে এটি একটি ‘গেম চ্যাঞ্জার’ প্রমাণিত হতে পারে। অমানবিকভাবে দখলদার বাহিনীর কারাগারে হাজারো রাজবন্দির বাস্তবতা উঠে আসবে এক মারওয়ান বারঘৌতির মধ্য দিয়ে, যিনি গত ১৯ বছর ধরে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।

দশকের পর দশক কথিত শান্তি প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের নির্বাচন করে কথিত গণতান্ত্রিক চর্চা স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার উপদেশ দেয়া হয় পশ্চিমা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে। ফিলিস্তিনিরা তেমনটিই করেছে ও এর বিপরীতে তারা পেয়েছে দখলদারিত্ব, আরও অবৈধ বসতি ও আরো বেশি বিভক্তি। ইসরায়েল জন্মের ৭২ বছর অতিবাহিত হয়েছে- ফিলিস্তিন আজও ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি। বারঘৌতি সেই বন্দিত্বেরই জীবন্ত উদাহরণ। 

দখলদারিত্বের মাঝে নির্বাচনের মানে এটি নয় যে, এখানে কে কতটা গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল; বরং এর মানে হলো- চলমান কথিত সাম্যাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা; বৃদ্ধ, অচল, একঘেয়ে নেতৃত্বের বিপরীতে নতুন, শক্তিশালী ও সাহসী নেতৃত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। বারঘৌতি নির্বাচনে জয়লাভ করলে এমনই এক চিত্র দেখা যেতে পারে, যা আব্বাস ও তার অনুসারীদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ফাতাহ ও হামাসের মধ্যকার সম্পর্কেও সামনের দিনগুলোতে নতুন বাস্তবতা ও সমঝোতা সৃষ্টি হতে পারে। আর এ সম্ভাবনা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আন্দোলন ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে একটি বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //