ভঙ্গুর সৌদি রাজতন্ত্র

একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) আগে থেকেই অন্য ক্ষমতাধর রাজন্যদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, অথবা গ্রেফতার করে কারাগারে ছুড়ে ফেলেছেন।

এবার রাজত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাও সরিয়ে দিয়েছেন। গত ৭ মার্চ তার নির্দেশে মুখোশপরা পুলিশ সদস্যরা আটক করে সৌদি বাদশাহ সালমানের একমাত্র আপন ভাই প্রিন্স আহমেদ বিন আবদুল আজিজকে। আটক করা হয় সৌদি সিংহাসনের আরেক দাবিদার সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফসহ আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ প্রিন্সকে। তাদের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ বা অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। 

এমবিএসের বাদশাহ হওয়ার পথ মসৃণ হলেও এর মধ্য দিয়ে সৌদি রাজতন্ত্রের ভঙ্গুরতাও স্পষ্ট হয়।

রাজপরিবারে প্রিন্স আহমেদ বিশেষ মর্যাদা বহন করেন। কারণ তিনি বাদশাহ সালমানের একমাত্র জীবিত আপন ভাই। রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হাইয়াতুল বাইয়ার তিন সদস্যের একজন প্রিন্স আহমেদ। এর আগে নিজের ভাইকে সিংহাসনের উত্তরসূরি মনোনয়ন দিতেন সৌদি শাসকরা। কিন্তু রাজা সালমান ২০১৭ সালে ঊর্ধ্বতন প্রিন্সদের সরিয়ে সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ বা যুবরাজ হিসেবে তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম ঘোষণা করেন।

এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন প্রিন্স আহমেদ ও প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফ। যুবরাজ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর রাজপরিবারে বড় ধরনের আটক অভিযান চালান এমবিএস। এতে সৌদি রাজপরিবারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্যকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ আটক করে রাখা হয়েছিল। তবে এই ঘটনার আগেই ব্রিটেনে পালিয়ে যান প্রিন্স আহমেদ। পরে এমবিএসের আশ্বাসে ২০১৮ সালের অক্টোবরে দেশে ফিরে আসেন তিনি। রাজপরিবারের যেসব সদস্যকে ‘অবাধ্য’ হিসেবে বিবেচনা করছেন যুবরাজ, তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, প্রিন্স আহমেদের ক্ষেত্রে প্রথমে তেমনটি ঘটতে দেখা যায়নি। তিনি অনেকটা স্বাধীনভাবেই দেশে ফিরে আসা ও চলাচলের সুযোগ পান।

এর আগে লন্ডনে বসে তিনি সৌদি সরকারের সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। ২০১৫ সালে মোহাম্মদ বিন সালমানের ইয়েমেন আগ্রাসনের কড়া সমালোচক ছিলেন প্রিন্স আহমেদ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকট চলছে। এর পেছনে সৌদি আরবের ভূমিকার সমালোচনা করে প্রায় দুই মিনিটের একটি ভিডিও তিনি অনলাইনে প্রচার করেছিলেন ২০১৮ সালে। 

সেখানে তিনি বলেছিলেন, ইয়েমেনে যা হচ্ছে তার জন্য সৌদি রাজপরিবারের সবাই নন, বরং নির্দিষ্ট দু-একজনই দায়ী; আর তারা হলেন- বাদশাহ, যুবরাজ ও রাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তা। 

এদিকে বাদশাহ সালমানের ভাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ বিন নায়েফ সিংহাসনের আরেক দাবিদার। তিনি ছিলেন সৌদি আরবের সাবেক যুবরাজ। ২০১৭ সালে তাকে সরিয়েই যুবরাজ হিসেবে এমবিএসের নাম ঘোষণা করা হয়। মোহাম্মদ বিন নায়েফ যুবরাজ থাকার সময়েই তাকে সব ধরনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তাকে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনিতে আবদ্ধ করা হয়। তবে এ নিরাপত্তার নামে কার্যত তাকে নজরবন্দি করে ফেলেন এসবের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। 

মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ক্ষমতা কাঠামো থেকে দূরে ঠেলে দেয়াই ছিল এই কথিত নিরাপত্তার মূল লক্ষ্য। এরপর একদিন নায়েফকে যুবরাজের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আদেশ দেন বাদশাহ সালমান। তাকে গৃহবন্দি করা হয়। ৭ মার্চ আটকের আগ পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দিই ছিলেন। তাই সিংহাসন দখলে তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা অসম্ভব বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাকে দীর্ঘ সময় আটক রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নায়েফের সম্পদ জব্দ করা হয়। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়- তিনি নাকি ব্যথানাশকে আসক্ত!

এবারের ধরপাকড়ের পেছনে আরো একটি উদ্দেশ্য হলো- এর মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কেউ যদি ভবিষ্যতে তার পথের কাঁটা হতে চায়, তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়ংকর। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা র‌্যান্ড করপোরেশনের বিশ্লেষক বেকা ওয়াসের সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সব হুমকি ইতোমধ্যে সরিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে এটা তার আরো বড় পদক্ষেপ। তাকে যাতে অতিক্রম করার চেষ্টা করা না হয়, রাজপরিবারের সদস্যদের তিনি সেই বার্তা দিতে চেয়েছেন নতুন এই ধরপাকড়ের মাধ্যমে।’

আল জাজিরার সাংবাদিক জামাল এলশায়াল বলেন, ‘যে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা সৌদি আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্যতম। দীর্ঘ সময় তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। কাজেই অভ্যুত্থান চেষ্টার যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তা অসম্ভব। তারা আগে থেকেই মারাত্মক বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছেন।’

রাজন্যহীন রাজতন্ত্র

এর আগে সৌদি রাজতন্ত্রে সিংহাসনের লড়াই এমন তীব্র হয়ে ওঠে ১৯৬০ এর দশকে- তখন বাদশাহ সৌদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেন তৎকালীন যুবরাজ ফয়সাল। সে সময় বাদশাহ সৌদ ও তার সন্তানদের বাদে অন্য রাজন্যদের সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। ধর্মীয় নেতাদের সমর্থনে ফতোয়া জারি করে সৌদ ও তার সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করা হয়। 

তবে বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান রাজন্য, ধর্মীয় নেতা বা সমাজের অভিজাতদের সমর্থন অর্জন করতে পারেননি। এমবিএসের প্রতি একমাত্র নিরঙ্কুশ সমর্থন রয়েছে বৃদ্ধ বাদশাহর। যে কারণে বাদশাহর জীবদ্দশায় যুবরাজ বিরোধীদের উচ্ছেদ করে ক্ষমতার পথ মসৃণ করতে চাইছেন। এমনটা করতে গিয়ে তিনি কার্যত পুরো রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই খারিজ করে দিয়েছেন।

নারীদের কথিত অধিকার প্রদান, কনসার্ট, বক্সিং ম্যাচ আয়োজনের কারণে যে জনসমর্থন পাওয়ার কথা এমবিএস প্রচার করছেন; তার মূলে রয়েছে আর্থিক মন্দায় দেউলিয়া হয়ে পড়া সৌদি রাজতন্ত্র। তিনি এসব পপুলিস্ট সংস্কারের নামে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে ক্ষমতা পোক্ত করতে চাইছেন। 

তবে এবারের সংকট আর্থিক নয়, রাজনৈতিক। অন্য প্রিন্স ও রাজন্যদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে বয়সের ভারে ন্যূজ হয়ে পড়া বাদশাহ সবসময় তাকে সমর্থন দিতে পারবেন না। রাজার মৃত্যুর পর এমবিএস যখন রাজত্ব পাবেন, তখন তাকে সমর্থন দেয়ার মতো কোনো রাজন্যই আর অবশিষ্ট থাকবে না। রাজত্ব পাওয়ার পথ মসৃণ করলেও, এ ভঙ্গুর রাজত্ব চালানোটা কোনোভাবেই মসৃণ হবে না।

জনগণের সাথে বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক মাদাবি আল-রশিদ বলেন, ‘সৌদি রাজতন্ত্রে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। ক্ষমতা পোক্ত করতে গিয়ে রাজন্যরা জনগণকে একটি মুক্ত সমাজ, রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে- যেখানে ধর্মকে আশ্রয় করা রাজনীতির একমাত্র রূপ রাজতন্ত্র। ভঙ্গুর রাজতন্ত্রের এ নাটকে দেশটির জনগণ শুধুই দর্শক।’

২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি দূতাবাসে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার পর আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে আসেন মোহাম্মদ বিন সালমান। খাসোগি বরাবরই সৌদি যুবরাজ ও তার নীতির সমালোচক ছিলেন। হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তার বিচারের দাবি উঠলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে রাজতন্ত্রের বিরোধিতাকারী ধর্মীয় নেতা, অধিকারকর্মী ও ব্যবসায়ীদের ধরপাকড় করা হয়েছে। 

বর্তমান বাদশাহর বয়স ৮৪ বছর। উত্তরসূরি হিসেবে তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানকে সব ধরনের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, প্রতিরক্ষা থেকে অর্থনীতি- সব ক্ষেত্রে যুবরাজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে মোহাম্মদ বিন সালমানের বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অদূরদর্শী অবস্থান ও জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ফলে বাদশাহ সালমানের তাকে যুবরাজের পদ থেকে অপসারণ করার সম্ভাবনাও ছিল। গত ৭ মার্চের ধরপাকড়ের মধ্য দিয়ে সেই আশঙ্কা নস্যাৎ করতে চেয়েছেন এমবিএস। 

তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রিন্সদের সরিয়ে দিয়ে সৌদি রাজতন্ত্র এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে; আর ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকেই যাচ্ছে এমবিএসের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //