প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা দরকার

বাংলাদেশ সরকার ষষ্ঠ একটি প্রণোদনা প্যাকেজের কথা বিবেচনা করছে। এতে দরিদ্র নাগরিকদের নগদ অর্থ প্রদান এবং কৃষি খাতের দিকে মনোযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই দুই দফায় প্রণোদনা হিসেবে ২৫ মার্চ ৫০০০ কোটি টাকা এবং ৫ এপ্রিল ৬৭,৭৫০ কোটি টাকা সম্বলিত ৫টি প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন। ৫ এপ্রিলের ঘোষণায় ছিলো ৪টি প্যাকেজ। 

এই সব প্রণোদনা প্যাকেজের আকার বড় হলেও তা যে দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের জন্যে কোনো রকম সাহায্যে আসবেনা তা অনেকেই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। 

প্রথম প্যাকেজে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে। কিন্ত ইতিমধ্যেই এই নিয়ে মালিকরা এবং সরকার এক ধরনের অচলাবস্থার মধ্যে আছে; আর তার ফাঁকে অনেক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকেই শ্রমিকদের ছাটাই করার খবর বেরিয়েছে। কবে নাগাদ এই বিষয়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দেখা যাবে এবং কবে নাগাদ শ্রমিকরা তাদের বেতন পাবেন তা এখনো খুব খোলাসা নয়। শ্রমিকদের চাকুরি সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই । 

অন্য প্যাকেজগুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে যেখানে এটা দেখানো হয়েছে এগুলো ধনিক শ্রেনীর একাংশের জন্যে লাভজনক ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন প্যাকেজের বিবেচনা ইতিবাচক। এই প্যাকেজে অতি দরিদ্র মানুষদের হাতে নগদ অর্থ দেয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকার ২০১৪ সালে করা বস্তি এবং ভাসমান জনগোষ্ঠীর ওপরে করা একটি জরিপকে ভিত্তি হিসেবে ধরে তার সঙ্গে এখনকার অবস্থা মিলিয়ে প্রতি পরিবারের জন্যে তিন মাস ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা দেয়ার কথা বিবেচনা করছে। 

ওই জরিপে দেশে বস্তিতে ৫ লাখ ৯৫ হাজার পরিবার আছে বলা হয়েছিল। অন্যান্য বিবেচনা সংযুক্ত করে তা এখন ৩৪ লাখ পরিবার বলে হিসেব করা হচ্ছে। আগের এই চার প্যাকেজে যে এই সবচেয়ে দুর্বল গোষ্ঠীর বিষয়টি অবজ্ঞা করা হয়েছে সেটা আমি সম্প্রতি এক লেখায় উল্লেখ করেছি (দেখুন, ‘Bangladesh’s COVID-19 stimulus: Leaving the most vulnerable behind’, Atlantic Council, ৮ এপ্রিল ২০২০)। নোবেল বিজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিত বন্দোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিকভাবেই দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের হাতে নগদ অর্থ দেয়াকেই যথাযথ পদক্ষেপ বলে অভিমত দিয়েছেন। 

দেশের বিরোধী দল বিএনপি ৪ এপ্রিল যে প্যাকেজ প্রস্তাব করেছিলো তাতেও এই ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল। অন্যান্য দেশেও বিভিন্ন মাত্রায় সেটাই করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দেরিতে হলেও এই পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেটা নিশ্চয় ইতিবাচক। কিন্ত এই কর্মসূচির স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং যথাযথ লোকদের হাতে তা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা বিধান করা দরকার। 

সরকারের এই নতুন প্যাকেজে কৃষি খাতের জন্যে যে ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছে তা হচ্ছে দুই শতাংশ সুদে কৃষি ঋণ দেয়া। 

আমি যে চারটি খাতের দিকে সরকার নজর দেয়নি বলে উল্লেখ করেছিলাম তার মধ্যে কৃষি খাত একটি। কিন্তু সরকার অন্যান্য খাতের মতোই এখানেও ঋণ দেয়ার কথাই ভাবছে। যেখানে লকডাউন এবং বাজারে চাহিদা হ্রাসের কারণে  কৃষকরা বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে শুরু করেছেন এবং তাদের ওপরে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেখানে কৃষকদের জন্যে অন্যান্য শিল্পের মতো ঋণের ব্যবস্থা যথোপযুক্ত বলে মনে হয়না। 

ছোট ও মাঝারি কৃষকরা এ থেকে লাভবান হবেন নাকি আরো বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বেন সেটা ভাবা দরকার। এটা মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশে বড় আকারের শিল্প ঋণ গ্রহীতারা আইনের ঊর্ধ্বেই থাকেন, তারা ঋণ খেলাপি হলেও তাদের কিছুই অসুবিধা হয় না; তাদের ঋণ অবলোপন হয়। 

অন্যদিকে সামান্য কৃষি ঋণের কিস্তি না দিতে পারলে কৃষকদের কোমরে দড়ি বাধা হয়। ফলে কৃষকদের ঋণের বদলে এককালীন বা মাস ভিত্তিক সাহায্য দেয়া যায় কিনা সেটা এখনই বিবেচনা করা দরকার। (আমি আমার পুর্বোক্ত লেখায় স্বাস্থ্য খাতের বিষয় এবং দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি নজর না দেয়ার বিষয় উল্লেখ করেছি, বিবেচনাধীন প্যাকেজেও এই বিষয়গুলো নেই)।

সরকার এইসব প্যাকেজের জন্যে দেশের বাইরে থেকে অর্থ ধার দেনা করছে। তার বিকল্পও নেই। 

তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভবিষ্যৎ বন্ধক দিয়েই এখনকার সংকট মোকাবেলা করা হচ্ছে। সেই জন্যেই নাগরিকদের জানা দরকার কিভাবে এই সব অর্থ ব্যয় হবে, কী ভাবে স্বচ্ছতা তৈরি করা হবে। সরকার যেমন এই সব প্যাকেজ ঘোষণা করছেন তেমনি তার ওপরে এটাও দায়িত্ব যে তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। সেটা আলোচনা করা দরকার। অন্য যে কোনো সময়ে সরকারের যে কাঠামো আছে তা এই সময়ের জন্যে যথেষ্ট নয়। এটি একটি অভূতপূর্ব সময়। সেই বিবেচনায় স্বাধীন, নিরপেক্ষ নজরদারির ব্যবস্থা করা এবং তার দাবি তোলা দরকার।

লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //