শীতকাহন

কবি কালিদাস ঋতুসংহারে শীত ঋতুর বর্ণনায় লিখেছিলেন, ‘হে সুন্দরী! শীত ঋতুর কথা শ্রবণ করো। এই ঋতু শালিধান ও আখের প্রাচুর্যে মনোহর, এখানে-ওখানে উপবিষ্ট ক্রৌঞ্চের (কোঁচবক) নিনাদ এখন সুন্দর, কাম প্রবল, এ ঋতু রমণীদের প্রিয়।’ 

‘বিষণ্ণ কাকের মতো শীতের হলুদ পাতা ভেজা রাদে,
ঘুমিয়ে পড়েছে;
আমি তার ঘ্রাণ নিয়ে চলে যাই সুনসান হৃদে
তখন বেজেছে ঘণ্টা দূরে কোনো বধির ইস্কুলে,
কে সেখানে পাঠ করে শীতের লেখা আত্মজীবনী’
-মহাদেব সাহা 

কোনো এক শীতের সকালে, কুয়াশা মোড়া সূর্যকে ভালোবাসা কী প্রশ্ন করলে, সূর্য বলেছিল, ‘আমার আলোয় উদ্ভাসিত এক ফোঁটা শিশির বিন্দুই ভালোবাসা।’

কুয়াশা ঢাকা হিম হিম বোধটা খুব আলাদা। শীত আসে- দূর থেকে ক্ষীণ শোনা যায় ট্রেনের বাঁশি, জমি থেকে খানিক উপরে ধুলোর পথ, হলদেটে আলোয় আধচেনা ট্রেনে বসে নৌকায় করে শীত আসে, রঙবেরঙের শালে, সোয়েটারে, টুপিতে, মোজায় করে, পিঠেয় খেজুর গুড়ের সুগন্ধ মেখে, জানালার ধারের নেতিয়ে পড়া শিউলি, ট্রাকে সার্কাসের তাঁবু মালসামানা নিয়ে, বইমেলার বই নিয়ে, পৌষ মেলা, মাঘ মেলা নিয়ে, আকাশে বাতাসে ধূসর আলোমাখা নরম রোদেলা সুবাস ছড়িয়ে। 

‘দারুণ মাঘ মাসের শীতে
হাওয়ায় কাঁপয়ে পরাণি।
পতাবরে উইঠ্যা খসম
যায় ক্ষেতে দিতে পারি
আগুন লয়্যা যাইরে আমি
সেই না ক্ষেতের পানে।
পরাব হইলে আগুন তাপাই
বাতরে বইস্যা দুই জনে’

প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকার ‘দেওয়ানা মদিনা’তে এভাবেই মাঘ মাসে নায়িকা মদিনা বলছে পৌষ-মাঘের শীতে চাষবাস ক্ষেত খামারের কথা। ময়মনসিংহ গীতিকার দেওয়ান ভাবনায় আছে
‘পৌষ মাসে পোষা আন্ধি অঙ্গ কাঁপে শীতে।
একেলা শয্যায় শুইয়া বন্ধু বৈদেশেতে।’

শীত গ্রীষ্ম আর আলো অন্ধকারের রহস্য সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের ভাবনার বিষয় হয়েছিল। শীতের কাঁপন, অন্ধকারের শীতলতা আর রহস্যময়তা মানুষকে যেমন ভাবিয়ে তুলেছে, তেমনি করেছে সন্ত্রস্ত। হিম শীতল শীত আর অন্ধকারকে মানুষ সবসময়ই তুলনা করত রহস্যময় মৃত্যুর সাথে। বাংলায়ও শীতকে তুলনা করা হয় থুত্থুড়ে বুড়ির সাথে। কে জানে হয়তো বা শীতের প্রকোপ ছিল বুড়ির মৃত্যুর মতোই ভয়াবহ ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
‘যদি শীত আসে, বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে?
শীত এল, এল শীত, ঠান্ডা বুড়ি গাইছে গীত।’

প্রাচীন ভারতীয় উপকথায় আমরা দেখতে পাই ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টির সময় আলো আর অন্ধকারকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন। আলো ছিল দেবতার জন্য আর অন্ধকারকে দিয়ে দিলেন অসুরদের। আর তখন থেকেই এই শীতকে তুলনা হয় অন্ধকার ও অপশক্তির সঙ্গে।

ছটি ঋতুর আবর্তনে মহাকাল এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের দেশে ছটি ঋতুর পার্থক্য খুব স্পষ্ট নয়। হেমন্ত এবং শীত ঋতুকে একত্রে ধরলে ঋতুর সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ। এবার বাংলা প্রবাদে শীত কথার একটু খোঁজ নেওয়া যাক।

‘ঊনো বর্ষায় দুনো শীত’, ‘এক মাঘে শীত যায় না’, ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’, ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’, ‘মাঘ, দুয়ারে বসে হাগ’, ‘ধান ভানতে শিবের গীত শিবের কি লাগছে শীত’, ‘ধান ভানা নয়কো ঠিক এক মাঘে যায় কি শীত’, ‘পৌষের শীত মহিষের গায় আর মাঘের শীত বাঘের গায়’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের ঋতুপর্যায়ের গানে শীত সৌন্দর্যবেদনার বৈভব হয়ে আছে-
‘এ কী মায়া লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে।
আমার সয় না, সয় না, সয় না প্রাণে, কিছু সয় না যে’, 

অথবা সেই বিখ্যাত উচ্ছল শীতের নাচন- ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে’ অথবা, ‘পৗষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয়।’

ঋতুসংহার কাব্যের শেষ স্তবকে আছে, ‘এখন গুড়জাত মিষ্টদ্রব্যের প্রাচুর্য, সুস্বাদু শালিধান ও আখে এই ঋতু রমণীয়। রতিক্রিয়া এখন প্রবল। কামদেব এখন গর্বিত। যাদের প্রিয়জন বিচ্ছিন্ন সেই রমণীদের কাছে এই ঋতু মনোবেদনার কারণ। এই শীতকাল সর্বক্ষণ তোমাদের কল্যাণময় হয়ে উঠুক।’
জাড়ের রাইতে পৌষ মাসে
বিছন্যা হইলো ঠার
তুই আইলিন্যারে বন্ধু
আমি কাইন্দা জারেজার
-নবাবগঞ্জের আলকাপ গান, মাহবুব ইলিয়াস 

কত কথা আরো বাকি রয়ে গেল ঋতুসংহারের। শীত উদযাপনের কথাও রইলো বাকি। তবে নানা পুরাণ কথকতার মধ্য দিয়ে শীত এলেই উষ্ণতার ডাক আসে। উষ্ণতার খোঁজ পড়ে। শীতে হৃদয়ে উষ্ণতার হদিস দেন আলবেয়ার কামু দার্শনিক মেজাজে- 

‘শীতের তলায় কাঁপতে কাঁপতে আমি জেনেছি, আমার হৃদয় এক অপ্রতিহত গ্রীষ্মের বসত।’
অন্যদিকে বাংলার কবির আকুতি শীত ঘিরে-
‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি কোনো এক শীতের রাতে।’-জীবনানন্দ দাশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //