নারীর মূল্যায়নহীন কাজ

রেহানা একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তার স্বামী শফিক চাকরিজীবী। শফিকের বাবা তাদের সঙ্গেই থাকেন। রেহানা প্রতিদিন ভোর ৬টায় উঠে বাসার সবার জন্য নাশতা তৈরি করেন। নিজের ও শফিকের দুপুরের খাবার তৈরি করে শ্বশুরের খাবার ও ওষুধ গুছিয়ে দেন। রেহানার অফিস ছুটি হয় সন্ধ্যা ৬টায়।

বেসরকারি ব্যাংক হওয়ায় ৭টাও বাজে। অফিস থেকে বাসায় ফিরে রেহানা ফ্রেশ হয়ে আবার চলে যান সংসারের কাজ করতে। ঘর গোছানো, সবার জন্য নাশতা তৈরি, রাতের রান্না, পরের দিন অফিসের খাবার তৈরি করা- সব মিলিয়ে দম ফেলার সময় থাকে না রেহানার। শফিক মাঝে মধ্যে অভিযোগ করেন- রেহানা আর আগের মতো সময় দেয় না।

সালমা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। মা- বাবার পছন্দে বিয়ে করেছিলেন সাব্বিরক। তাদের চার বছরের মেয়ে আছে একটি। সাব্বিরের মা-বাবা আর ভাই আছেন। সালমা পুরোদস্তুর গৃহিণী। সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় তার ঘরের কাজ করা। ঘর পরিষ্কার, নাশতা তৈরি, এর পর সাব্বিরের অফিসের দুপুরের খাবার দেওয়া। মেয়েকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা। কাজের লোক এসে কাপড় পরিষ্কার করেন এবং ঘর মুছে যান। এর পর দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নেওয়া। দুপুরের খাবারের পর আবার সব পরিষ্কার করা। সালমা নিজের দুপুরের খাবার খেতে বেজে যায় ৪টা। সন্ধ্যা ৬টায় আবার সবার জন্য নাশতা তৈরি। এর পর রাতের খাবারের প্রস্তুতি। চাকরিজীবী বা গৃহিণী- দুটি পরিবারের চিত্র একই।

কোনো শিশুকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয়- তোমার বাবা কী করেন? সে হয়তো বলবে, কৃষিকাজ করেন, ব্যবসা বা চাকরি করেন ইত্যাদি; কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়- তোমার মা কী করেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তর হবে- কিছু করেন না, ঘরের কাজ করেন। শিশুরা এটা শিখেছে আর বড়রা এসব শিখিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। এখন প্রশ্ন হলো- এই যে গৃহস্থালি কাজগুলো আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয় না কেন?

এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ- এই কাজগুলো করে কোনো টাকা উপার্জন হয় না। এজন্য এই কাজগুলোর স্বীকৃতি নেই। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে এবং উত্তর খোঁজা হচ্ছে- নারীরা ঘরে যে কাজ করেন তা কি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে না? যদি জাতীয় উৎপাদনে এর প্রভাব থাকে, তবে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি নেই কেন? এর আর্থিক মূল্য কি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়? 

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, মজুরিবিহীন কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ দিনে ৬ দশমিক ৪৬ ঘণ্টা বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর টাইম ইউজড সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৫ বছরের বেশি কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১ দশমিক ২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন। অবৈতনিক কাজের মূল্যের একটা ছায়া হিসাব করেছিল গবেষণা সংস্থা সানেম। তাদের তথ্য অনুযায়ী যদি গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব করা যায়, তা হলে তা দাঁড়াবে- নারীর ক্ষেত্রে জিডিপির ৩৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ। 

এটাতো গেল আর্থিক হিসাব, এবার আসি আরেকটি প্রশ্নে। এই গৃহস্থালি কাজগুলো নারীকেই করতে হবে- এটি কি সহজাত বা প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনো নিয়ম? না, এটি আমাদের সমাজের নিয়ম। প্রকৃতপক্ষে নারীর কাজ বা পুরুষের কাজ বলে কিছু নেই। যে কোনো কাজ যে কেউ করতে পারে। গৃহস্থালি কাজগুলোতে টাকার মূল্যায়ন থাকে না। অথচ এ কাজগুলো অত্যাবশ্যকীয়। পরিবারের এ কাজগুলো একত্রে করা হলে সময় যেমন কম লাগে, তেমনি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহমর্মিতা বাড়ে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //