হেডফোন ব্যবহারে বাড়ছে স্মৃতিভ্রংশের আশঙ্কাও

অচিরেই বিশ্বের বড় অংশের মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাবে। এমনকি অনেকের শ্রবণ ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শ্রবণশক্তি কমে গেলে ক্রমশ তা ডিমেনশিয়ার বা স্মৃতিভ্রংশের মতো অসুখ ডেকে আনে। এর কারণ হচ্ছে ইয়ারফোন বা হেডফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার। এমনই আশঙ্কা করছে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

সম্প্রতি হেডফোন বা ইয়ারফোনের মতো যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ডব্লিউএইচও। সেখানে দেখা গেছে, ফোনের সাথে এই যন্ত্র জুড়ে নিরন্তর ব্যবহারের ফলে ক্রমশ শোনার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে মানুষের। 

বিশেষ করে যারা খুব ছোট বয়স থেকেই এই জাতীয় যন্ত্রের অতিরিক্ত ব্যবহার করেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের শোনার ক্ষমতা মারাত্মক হারে কমতে থাকে। বিশেষ করে হেডফোন ব্যবহার সময় ৯০ ডেসিবেল বা তার বেশি মাত্রার আওয়াজ সরাসরি কানে গেলে শ্রবণে সমস্যা হতে পারে। চিরতরে শ্রবণশক্তিও হারাতে পারেন।

এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির মাঝে বাড়িতে বন্দি হয়ে অনেকেই আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরছেন মোবাইল। মানসিক অবসাদ কাটাতে অনলাইন চ্যাট, ভিডিও গেমস বা ওয়েবসিরিজের মধ্যে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন। আবার যারা চাকরি করেন বা বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত তাদের কনফারেন্স কল, অডিও-ভিডিও কল তাদের এখন সব সময়ের সঙ্গী। ব্যবসা ধরে রাখতেও অনেকেই ভরসা রাখছেন ভার্চুয়াল জগতে। নিউ নর্মাল লাইফে কানের কাজ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।

এত বেশি ফোনের ব্যবহার বাড়িয়ে তুলছে কানের সমস্যা। নতুন অভ্যাসে অনেকেই কানে ভাল করে শুনতে পাচ্ছেন না বা কম শুনছেন। কারও আবার খুব কাছের শব্দকে দূরের মনে হচ্ছে। কেউ কানের পাশে কেমন একটা ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ শব্দ শুনছেন কখনো। কান ব্যথাও করছে অনেকের। তাই এখন সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। দীর্ঘ সময় হেডফোন কানে গুঁজে রেখে, ল্যাপটপ, মোবাইল ব্যবহারের ফল মারাত্মক হতে পারে।

গবেষক দলের অন্যতম প্রধান চিকিৎসক ও কোয়েট কোয়ালিশনের বোর্ড চেয়ারম্যান ডা. ড্যানিয়েল ফিঙ্ক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শোনার ক্ষমতা কমে গেলে, সেই বিষয়টিকে আমরা ততটাও গুরুত্ব দিই না। এটি যে পরবর্তীকালে আরো বড় ক্ষতির আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়, সে বিষয়েও আমাদের অনেকের ধারণা নেই।

তিনি আরো বলেন, সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন, যে শ্রবণশক্তি হ্রাস হওয়াটা স্বাস্থ্যকর জীবনের অঙ্গ নয়। তবুও তারা এই বিষয়ে বিশেষ চিন্তিত নন।

ড. ফিঙ্ক ও অডিওলজিস্ট জ্যান মেয়েস একাধিক রিপোর্ট পড়ার পাশাপাশি গবেষণা করে দেখেছেন, শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ব্যক্তিগত সাউন্ড সিস্টেম। যেগুলোতে সাধারণত হেডফোন ও ইয়ারবার্ডের সাহায্যে সাধারণ মানুষ গান শুনতে অভ্যস্ত। বিশেষত যুবসমাজের অডিও সিস্টেম ব্যবহারের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে তারা যখন ৪০ বছর বয়সে পৌঁছাবেন সেই সময় বর্তমানের ৭০ ও ৮০ বছরের প্রবীণরা যে হারে শুনতে পান তাদের অবস্থা একই জায়গায় এসে দাঁড়াবে। 

কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে এর ফলে? চিকিৎসকদের আশঙ্কা, শ্রবণশক্তি কমে গেলে ক্রমশ তা ডিমেনশিয়ার বা স্মৃতিভ্রংশের মতো অসুখ ডেকে আনে। পরিসংখ্যান দিয়ে তারা দেখিয়েছেন, যাদের শোনার ক্ষমতা অল্প কমে, তাদের ডিমেনশিয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ বাড়ে। যাদের শোনার ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়, তাদের ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়ার আশঙ্কা তিন গুণ বেড়ে যায়। 

গবেষণা অনুসারে, শ্রবণশক্তিহীন মানুষের তুলনায় যাদের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া শুরু করেছে তাদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি হারানোর একটা প্রবণতা দেখা গেছে। কম শুনতে পাওয়ার প্রবণতা যাদের হালকা থাকে তাদের ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া ক্ষমতা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্তদের ঝুঁকি পাঁচগুণ বেড়ে যায়। যারা শ্রবণশক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলেন, তাদের ডিমেনশিয়ার আশঙ্কা প্রায় পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

হেডফোন বা ইয়ারফোনের এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আগামী সময়ে পৃথিবীব্যাপী বড়সড় সমস্যার কারণ হতে চলেছে বলেও আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।

হেডফোন ব্যবহারে আরো যেসব ক্ষতি হতে পারে

কানের ইনফেকশন 

বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে আমরা প্রায়ই হেডফোন বা ইয়ারফোন ভাগ করে শুনি। এই ভাগ করার ফলে সহজেই কানে সংক্রমণ হতে পারে। অন্য মানুষের কান থেকে ব্যাকটেরিয়া সহজেই হেডফোন মাধ্যমে আপনার কানে আসতে পারে। তাই পরবর্তী সময়ে আপনি যখন আপনার ইয়ারফোন বা হেডফোন শেয়ার করবেন, তখন নিশ্চিত করুন যে আপনি তাদের স্যানিটাইজ করেছেন বা পরিষ্কার করে নিয়েছেন।

বাতাস প্রবেশে বাধা

বর্তমান সময়ে হেডফোন কোম্পানিগুলো তাদের হেডফোনের অডিও এক্সপেরিয়েন্সের দিকে ঠিকই নজর দিয়েছে। যার ফলে খুব ভাল কোয়ালিটির গান শুনতে পারছি। কিন্তু কানে এমন স্থানে হেডফোন লাগাতে হয় কানের ছিদ্র পুরোপরি বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে কানে কোনো বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। এর ফলে কানে ইনফেকশন, টিটিনাস, শ্রবণ জটিলতার ঝুঁকি থেকেই যায়।

সাময়িক বধির

এক গবেষণায় দেখা গেছে- যারা অনেক সময় ধরে উচ্চ ভলিউমে গান শুনে তারা হেডফোন খোলার পরেও অনেকক্ষণ ভালোভাবে কানে শোনে না। যদি কেউ ১৫ মিনিটের জন্য ১০০ ডেসিবেলের বেশি শোনে, তবে সে বধির হয়ে যেতে পারে। এটি সাময়িক হলেও এর ক্ষতি কিন্তু অনেক। 

কানে ব্যাথা

যারা অতিরিক্ত হেডফোন ব্যবহার করেন তারা সাধারণত এ সমস্যায় ভুগেন। মাঝে মাঝে কানের ভেতরে ভোঁ ভোঁ আওাজ হয়ে থাকে। এটিও কিন্তু কানের ক্ষতির লক্ষণ।

মস্তিষ্কের উপর খারাপ প্রভাব

হেডফোনের দ্বারা সৃষ্ট ইলেক্ট্রম্যাগনেটিক তরঙ্গ মস্তিষ্কের জন্য গুরুতর বিপদ ডেকে আনতে পারে। আর যারা ব্লুটুথ হেডফোন ব্যবহার করেন তারা আরো বেমি ঝুঁকিতে আছে। কান সরাসরি মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত। তাই হেডফোন খুব বাজেভাবে মস্তিষ্কে আঘাত হানে।

হেডফোনের কারণে দুর্ঘটনা

সম্প্রতি হেডফোনের ব্যবহারের ফলে রাস্তায় দুর্ঘটনার সংখা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়ি দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, এমনকি ট্রেন দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। হেডফোন কানে দিয়ে রাস্তায় হাটার সময় আওয়াজ শোনা যায় না, তাই দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //