ডিসগ্রাফিয়া কি?

একটি বছর চারেকের ছেলে বা মেয়ের সব কিছু একদম স্বাভাবিক। কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই। স্কুলে যাচ্ছে, খেলছে, দুষ্টুমি করছে... কিন্তু যেই কিছু লিখতে হচ্ছে তখনই কোথা থেকে একরাশ জড়তা এসে ঘিরে ধরছে তাকে। পেনসিল ধরতে সমস্যা হয়, অক্ষরগুলো কেমন যেন উল্টোপাল্টা হচ্ছে, বানান ভুল। মা-বাবা ভাবছেন পড়াশোনায় অনীহা বা দুষ্টুমি করছে। অথচ সে কিন্তু অন্যান্য পড়া মুখস্থ বলতে পারছে। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের সমস্যাকে বলা হয় ডিসগ্রাফিয়া, এটি নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডার। ইনস্ট্রাকশন শুনে সেই আকৃতিটা ভেবে লিখতে গেলে সমস্যা হয় এই রোগীদের।

ডিসগ্রাফিয়া হলো এক ধরনের শিক্ষণগত অক্ষমতা, যেখানে শিশুর হাতের লেখায়, লিখে মনের ভাব প্রকাশে ও হাতের সূক্ষ্ম কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।  অনেক শিশুই লিখতে গিয়ে b আর d-এর মধ্যে গুলিয়ে ফেলে। সহজ বানানও ভুল হয়। তার মানেই কি সে ডিসগ্রাফিয়ায় আক্রান্ত? 

না, অনেক লক্ষণ দেখে এটি বুঝতে হবে। কোনো শিশুর মধ্যে যদি সব ক’টি বা অধিকাংশ লক্ষণ দেখা যায়, তা হলে বুঝতে হবে সে ডিসগ্রাফিয়ায় ভুগছে। এটি যে শুধু শিশুদের হয় তা নয়, পূর্ণবয়স্ক মানুষও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কোনো দুর্ঘটনার কারণে মাথায় গুরুতর আঘাত লাগলে, এই সমস্যা দেখা যেতে পারে। 

দুই ধরনের ডিসগ্রাফিয়া হয়-  ব্রেন ইনজুরির কারণে অ্যাকোয়ার্ড ডিসগ্রাফিয়া এবং জন্মগত ক্ষেত্রে হলে তাকে ডেভেলপমেন্টাল ডিসগ্রাফিয়া বলা হয়। তবে আসল সমস্যা হল, এই রোগ পুরোপুরি সারে না। 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিউরোলজিস্ট জয়ন্ত রায়ের কথায়, এই রোগ একেবারে সারে না এ কথা সত্যি। ওষুধ দিলাম আর ঠিক হয়ে গেল, এমন নয়। অ্যাডাল্টদের ক্ষেত্রে ব্রেন ইনজুরির মাত্রার উপরে নির্ভর করে সমস্যা কতটা জটিল। শিশুদের ক্ষেত্রে কন্টিনিউয়াস থেরাপির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

লক্ষণ দেখে বুঝতে হবে

সাধারণত শিশুরা প্রি-স্কুলে যাওয়ার সময় থেকেই লক্ষণগুলো ধরা পড়ে। নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডারের জন্য নির্দেশ শুনে, সেটা বুঝে লেখার প্রক্রিয়াতেই ওদের জট পেকে যায়। তাই লেখার সময়ে অক্ষর বিকৃত করে ফেলে। স্মল লেটার, ক্যাপিটাল লেটার মিশিয়ে লেখে। বেশির ভাগ অক্ষর লেখে মিরর ইমেজে। ওভার রাইট করে। কোনো বাক্য গুছিয়ে লিখতে পারে না, দু’চারটে শব্দ বাদ দিয়ে যায়। বানান লেখার সময়েও অক্ষর বাদ দেয় বা অতিরিক্ত অক্ষর জুড়ে দেয়। 

সমস্যা যত জটিল, লক্ষণের সংখ্যা তত বেশি। শুধু যে নিজেরা মাথা খাটিয়ে লিখতে পারে না তা নয়, লেখা অনুকরণও করতে পারে না। আঁকার সময়েও ইমেজ বিকৃত করে ফেলে। এমনকি ঠিক মতো পেনসিলও গ্রিপ করতে পারে না।

ডিসগ্রাফিয়ায় আক্রান্তদের ফাইন মোটর স্কিলের ক্ষেত্রেও সমস্যা থাকে। দু’ধরনের মোটর স্কিল হয়- ফাইন মোটর, গ্রস মোটর। জিনিস ধরার জন্য যে বিগ মাসলের ব্যবহার হয়, তা হলো গ্রস মোটর স্কিল। যেমন বড় বল, বই, ব্যাগ, হাতা-খুন্তি ইত্যাদি। ছোট ছোট সূক্ষ্ম জিনিস যেমন পেনসিল, পুঁতি, দানাশস্য- এগুলো ধরার জন্য স্মল মাসলের ব্যবহার হয় বলে এগুলো ফাইন মোটর স্কিলের মধ্যে পড়ে। 

ডিসগ্রাফিয়া আক্রান্তদের এই ছোটখাটো জিনিস যেমন পেনসিল, গ্রিপ করতে সমস্যা হয়।  

ট্রিটমেন্ট কী ভাবে

এই রোগের কোনো চিরস্থায়ী সমাধান নেই। সারা জীবন থেরাপির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করেন শ্রেয়শ্রী কুণ্ডু (কোর্স কো-অর্ডিনেটর)। 

তিনি বলেন, বাচ্চাটির স্কুল, মা-বাবা ও স্পেশ্যাল এডুকেটরের সাহায্যের মধ্য দিয়ে বাধাগুলো কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। ওদের হাতের লেখা খারাপ হলেও উৎসাহ দিন। কারণ ওইটুকু লিখতেই ওর অনেকটা স্ট্রেস হচ্ছে। পেনসিলের গ্রিপ কিনতে পাওয়া যায়, তাতে ওরা সহজে পেনসিল ধরতে পারবে। ফাইন মোটর স্কিল ডেভেলপ করার জন্য ওদের পুঁতি দিয়ে মালা করতে দেয়া যেতে পারে। বড় উত্তরের বদলে ছোট উত্তর লিখতে দিলে ভাল। কম্পিউটার দেয়া যেতে পারে, কারণ টাইপ করতে সমস্যা নেই। সাথে থাকতে হবে অডিয়ো ইনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থা। লেখার বদলে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। 

কোনো জিনিস শেখানোর জন্য অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিন। স্পর্শ, গন্ধ, দৃষ্টি, শ্রবণ- এগুলো কাজে লাগাতে হবে। স্কুলকেও সহযোগিতা করতে হবে। যেহেতু এই শিশুদের আর কোনো সমস্যা থাকে না, তাই তারা স্পেশ্যাল স্কুলেও যেতে চায় না। 

মানসিক চাপ কাটাতে হবে

আমরা যে কাজটা পারি না, সেটা এড়িয়ে যাই। ডিসগ্রাফিয়া আক্রান্তদের ক্ষেত্রেও তাই। যে কারণে ওদের বুঝিয়ে বা নানা কৌশলে লেখাতে হবে। ওরা যে শুধু লেখার ক্ষেত্রে বাকি বাচ্চাদের চেয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সেটা নিজেরা বেশ বুঝতে পারে। সেখান থেকেই ওদের মধ্যে একটা প্রতিরোধ তৈরি হয়। এর সাথে অনেক সময়ে এডিএইচডি-র (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) সমস্যা জুড়ে যায়। 

লেখার প্রসঙ্গ এলেই নার্ভাস হয়ে যায়, হাইপার অ্যাক্টিভ হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে মা-বাবাকে তো বোঝাতে হবেই, কাউন্সেলিংও জরুরি। বকুনি দেবেন না। এটা বুঝতে হবে যে, সামান্য একটা কিছু লিখতে গেলেও এদের মাথায় অনেক চাপ পড়ছে। 

বড়দের ক্ষেত্রেও মানসিক সমস্যা কম নয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ যিনি সব পারতেন, হঠাৎ একদিন আর লিখতে পারছেন না। এ দিকে বাকি সব স্বাভাবিক। তাদেরও কাউন্সেলিং জরুরি। স্কুল-কলেজের পড়ুয়ার ক্ষেত্রে এ রকম কিছু হলে, সে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে, পরীক্ষার হলে রাইটার নিতে পারে, তার সাথে চলুক থেরাপি। যারা অফিসে কাজ করেন, তারাও হাতে লেখালেখির বদলে কম্পিউটার মারফত কাজ চালাতে পারেন। 

যেহেতু এই রোগের কোনো স্থায়ী সমাধান নেই, তাই নানা কৌশলের মাধ্যমে যতটা সম্ভব এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আর দরকার ধৈর্য ও যত্ন। -আনন্দবাজার পত্রিকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //