মাতৃভাষা হোক গর্বের, লজ্জার নয়

১৯৫২ সালে তৎকালীন ছাত্রসমাজ মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। সেদিন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো কয়েকজন বীর সন্তান এই মাতৃভাষা বাংলার জন্য শহীদ হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 

পরবর্তীতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে।

এথ্‌নোলগ-এর ২১তম সংস্করণ (২০১৮) অনুসারে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষা প্রচলিত আছে। এরমধ্যে বাংলা ভাষারই রয়েছে অসংখ্য উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা। অনেকেই আবার এই উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষাকে মায়ের আঁচলের ভাষা বলে থাকেন। দেশের ৬৪ জেলাতেই কমবেশি বাংলা আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক মানুষ রয়েছে যারা এ আঞ্চলিক ভাষাকে ভিন্ন চোখে দেখে। অর্থাৎ যখন কেউ তার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন তখন যারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন না তারা মুচকি মুচকি হাসেন। বলতে গেলে অনেকটা ওই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারকারীকে মনে মনে মূর্খ বা অশিক্ষিত ভাবে। অনেকেই আবার তাদেরকে আনস্মার্ট মনে করেন। আমি মনে করি তাদের এ ধারণা ভুল। 

পৃথিবীর সর্বত্রই প্রতিটা ভাষারই কিছু না কিছু আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। যা কিনা যুগ যুগ ধরে ওইসব এলাকায় মানুষ ওই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে আসছে। তবে আমাদের দেশের ওইসব আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা মানুষ শহরে বা অফিসিয়াল কোন কাজে চেষ্টা করেন শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে। তাই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারকারীদের কে ছোট করে দেখা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। 

বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশে প্রকৃতিতে যেমন বৈচিত্র রয়েছে তেমনি এদেশের নানা বর্ণ ও ধর্মের মানুষের বসবাস থাকায় দেশের কৃষ্টি-কালচার এবং সার্বিক বিষয়েও রয়েছে নানা বৈচিত্র্যতা। এতে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে বৈচিত্র্যময় ভাবে।

এখন চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এই ভাষা নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে সভা-সমাবেশ ও সেমিনার। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দেয়া নিয়া চলছে নানা অনুষ্ঠানমালার প্রস্তুতি বা আয়োজন।

আমাদের শেরপুর জেলায় সাতটি নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে গারো, কোচ, হাজং, হদি, বর্মন, ডালু ও বানাই সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। এরমধ্যে গারো, কোচ ও হাজং ভাষাটি কোনোরকমে টিকে রয়েছে। বাকি চারটি সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষা হারিয়ে গেছে। ওইসব সম্প্রদায়ের গুটি কয়েকজনের মানুষ সামান্য কিছু মুখে মুখে বলতে পারে মাত্র। 

উল্লেখিত সাতটি সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেই মাতৃভাষায় কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, সর্বত্র বাংলা ভাষাভাষী ব্যবহারের মধ্যে হঠাৎ করেই কোন নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মধ্যে যখন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলে তখন আমরা বাঙালিরা মুচকি মুচকি হাসি আবার কেউ কেউ তাদের মুখের দিকে চেয়ে টিপ্পনি কাটি। তাই তারা তাদের মাতৃভাষাতে কথা বলতে কোন কোন স্থানে বা সময়ে লজ্জাবোধ করে। এ বিষয়টা আমি মনে করি আমরা বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ যারা কিনা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষা ফিরিয়ে এনেছি তারা কিভাবে অন্যের ভাষার প্রতি টিপ্পনি কাটতে পারি। 

আমি বেশ কয়েকবার আমাদের শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। মেঘালয় রাজ্যটি মূলত গারো ও খাসিয়া ভাষাভাষীর মানুষের বসবাস। এখানে গারো-খাসি ছাড়াও আরো অনেক ভাষাভাষীর মানুষের বসবাস রয়েছে। তবে গারো ও খাসিয়ারা সংখ্যাগুরু। 

মেঘালয়ের তুরা অঞ্চলটি মূলত গারো অধ্যুষিত এবং শিলং অঞ্চলটি খাসিয়া অধ্যুষিত। আমি তুরাতে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছি এবং বেশ কয়েকবার সেখানে অবস্থান করেছি। তাতে দেখেছি যে, সেখানকার গারোরা বা আচিক ভাষাবাষীর মানুষ তাদের ভাষার প্রতি এতটাই কট্টর যে, তুরা শহরের বিভিন্ন দোকানপাট বা ব্যবসা কেন্দ্রে গারোরা তাদের গারো মাতৃভাষা বা আচিক বা মান্দি ভাষায় কথা না বললে তাদের সাথে ব্যবসা করেন না। অর্থাৎ সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় অন্য প্রদেশের মানুষ যদি হিন্দি বা বাংলা ভাষায় কথা বলেন তবে তাদের সাথে ব্যবসা করেন না। অথবা তাদের কাছে কোন পণ্য বিক্রি করেন না। তাই স্থানীয়রা বাধ্য হয়ে গারো ভাষা ব্যবহার করেন। তবে এক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ এবং বাংলাদেশসহ অন্য যে কোন দেশের পর্যটকদের বেলায় তা শিথিল্য। ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষায হিন্দি হলেও মেঘালয় রাজ্যে অফিসিয়াল বা দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি।

ইংরেজি এখানকার দাপ্তরিক ভাষা হলেও খাসি ও গারো ভাষা এই রাজ্যের প্রধান দুই প্রচলিত ভাষা। এছাড়া অন্যান্য ভাষার মধ্যে রয়েছে নার, বাংলা, নেপালি, অয়ার, হাজং, অসমিজ।

আমি মনে করি আমরা বাঙালিরা যে মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়ে ভাষাকে ফিরে পেয়েছি সেই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের আশপাশের নানান ভাষাভাষীর মানুষ এবং আঞ্চলিক ভাষায় মানুষগুলোকে টিপ্পনি না কেটে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং তাদেরকেও তাদের নিজস্ব মায়ের ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের উৎসাহিত করি। এতে আমাদের সমাজে বৈচিত্রতার পাশাপাশি ভাতৃত্বের বন্ধনও মজবুত হবে বলে আমি মনে করি। তাই এই আন্তর্জাতিক ভাষার মাসে আমাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা এবং আমাদের বাংলার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারকে লজ্জা জনক না ভেবে গর্ব মনে করি।

লেখক:  কবি ও সাংবাদিক, শেরপুর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //