নতুন শিক্ষাক্রমের মূল সমস্যাগুলো কী?

যখন বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে হয় তখন কোথাও উঁচু থাকলে সেগুলো কেটে ছোট করে সমান করতে হয়। উচ্চতর গণিত উঠিয়ে দিয়ে, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়ন কমিয়ে দিয়ে এই কাজটিই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আগে যাদের বিজ্ঞান ও গণিতে ভীতি ছিল তাদের জন্য উপযোগী করা হলো। তার মানে সহজ করা হলো। মান কমানো হলো। এই সহজ সত্যটা বোঝা কি এতোই কঠিন?

এবার ভাবুন আগে যারা মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পড়তো তারা কি পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতো বা পড়তে চাইতো? না। কেন না? কারণ তারা উচ্চতর গণিত পড়তো না। কারণ তারা বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তো না। কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসিতে যারা বিজ্ঞান নিয়ে পাস করতো তারা মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে পড়তে পারতো। তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যারা এসএসসি ও এইচএসসি পাস করবে তারাতো অনেকটা আগের মানবিক থেকে একটু বেশি বিজ্ঞান জানা হবে। তবে আগের মতো পূর্ণ বিজ্ঞান জানা হবে না এবং উচ্চতর গণিত একদম না জানা হবে। তাহলে এরা তো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হিমশিম খাবে। শুধু তাই নয়, উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তেও ভয় পাবে। ফলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া কমে যাবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে স্কুলের শিক্ষকদের দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হচ্ছে। এই বিষয়ে বলার আগে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আগের পদ্ধতিতে স্কুল কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহারিক পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। সেই পরীক্ষা কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে হতো না। নিজ নিজ স্কুল কলেজের শিক্ষকরাই সেই পরীক্ষা নিতেন ও মূল্যায়ন করতেন। এই মূল্যায়ন সম্মন্ধে বাংলাদেশের সকল মানুষের নিশ্চই খুব ভালো করে জানেন। সেখানে স্কুল কলেজের দপ্তরি থেকে শুরু করে ল্যাব এটেন্ডেন্ট, শিক্ষকরা বাড়তি টাকার বিনিময়ে নম্বর দিতেন ও দেন। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে এই অনৈতিকতাটাকে আরো বিস্তৃত বা এক্সটেন্ডেড করা হলো। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষকের পক্ষে এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান এমপি, ইউএনও, ডিসি, এসপি, ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী, এলাকার গড ফাদারদের আত্মীয় ও সন্তানদের কম নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে বা রাখে?

ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে সম্ভব। সেখানে শিক্ষকতা পেশা সমাজের উঁচু শ্রেণীর একটি পেশা। এই পেশা অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং প্রতিযোগিতামূলক। কেবল মেধাবীদের মধ্যে যারা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন লালন করে বড় হয়েছে তারাই স্কুলের শিক্ষক হতে পারে এবং মাসিক ৪.৫ লক্ষ টাকা বেতন পায়। তারা মূল্যায়ন করার সময় কে কার ছেলে বা মেয়ে এসব দেখে না। আমাদের দেশের বাস্তবতায় কি তা সম্ভব? যেখানে স্কুলের শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত শুনতে হয়: আমি কে আমাকে চিনস? যেখানে শিক্ষক নকল ধরলে ছাত্রের হাতে মার খায়, অভিবাবকদের দ্বারা নিগৃহীত হয় সেখানে কি নয় নিজ শিক্ষকদের দ্বারা ধারাবাহিক মূল্যায়ন সম্ভব? এই নিয়ম চালু করার আগে সমাজকে আগে সেই মানের হিসাবে তৈরি করতে হবে। এই নিয়ম চালু করার আগে শিক্ষকতা পেশাকে এমন মানে উন্নীত করতে হতো যাতে শিক্ষকরা ক্লাসের সেরা মেধাবী হয়, আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়। এসব ঠিক না করে ফিনল্যান্ডের মডেল চালু করে দিলেই আমরা ফিনল্যান্ডের মতো পেরে ফেলবো? এতোই সহজ?

এর একটা ন্যূনতম সমাধান কি হতে পারে? কয়েকটা বিষয় যেমন ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদির মতো দুই বা তিনটি বিষয়কে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক রেখে বাকি অনেক বিষয় অপশনাল করে দেওয়া। কেউ যদি চায় ট্রিপল বিজ্ঞান অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং যারা পদার্থবিজ্ঞান নিবে অবশ্যই উচ্চতর গণিত নেওয়ার বিধান হতে পারে। কেউ ইচ্ছে করলে ডাবল বিজ্ঞান এবং সঙ্গে মানবিকের কিছু বিষয় নিতে পারে। অর্থাৎ সিস্টেমকে রিজিড না করে ফ্লেক্সিবল করতে হবে।

পরীক্ষাবিহীন ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতায় পরীক্ষা অবশ্যই লাগবে। পরীক্ষা মানে উচ্চ লাফের বারের একটি উচ্চতা যা দিয়ে দেখা হয় শিক্ষার্থী এই বার পার হতে পারছে কিনা। পরীক্ষা মানে শিক্ষার্থীদের উপর একটি চাপ। আমাদের পদার্থবিজ্ঞানে কাজের একটা সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। কাজ=সরণ ঢ সরণের দিকে বল যা সাধারণভাবে চাপ বলতে পারি। বল বা চাপ ছাড়া জ্ঞানের সরণ হবে না। আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই দেখবো পরীক্ষার দুই/একদিন আগের ১ ঘণ্টার পড়া আর পরীক্ষার ২ মাস আগে ১ ঘণ্টা পড়ায় জ্ঞানের সরণ সমান ছিল না এবং হয় না। জ্ঞানের সরণের জন্য কিছুটা চাপের প্রয়োজন। সেই চাপ আপনি নতুন শিক্ষাক্রম থেকে উঠিয়ে দিয়ে বলছেন শিক্ষাকে আনন্দময় করবেন। ঠিক আছে সেটা ক্লাস ওয়ান, টু, ত্রি, ফোর, ফাইভ পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ৮ম, ৯ম ১০ম শ্রেণীতে? এতেতো ডিজাস্টার হয়ে যাবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন পৃথিবীর কোথাও নবম শ্রেণীতে বিভাগ থাকে না। কথাটা আপাত একদম সত্যি মনে হবে। কিন্তু এর চেয়ে মিথ্যা আর হয় না। হ্যাঁ কোথাও নবম শ্রেণীতে বিভাজন নেই কিন্তু কোথাও ঘাড়ে ধরে সবাইকে সব সাবজেক্ট পড়তে বাধ্যও করা হয় না। উদাহরণ আমাদের দেশেই আছে। ইংরেজি মাধ্যমে কয়েকটা বাধ্যতামূলক বিষয় ছাড়া যে যার ইচ্ছেমতো বিষয় পছন্দ করতে পারে। পছন্দ মতো বেছে নেওয়ার তালিকা স্কুল ভেদে খোদ ইংল্যান্ডেও ভিন্ন। তারা ইচ্ছেমতো বিষয় নির্বাচন করতে পারে এবং এটাই হলো সেরা পদ্ধতি। এমনি এমনিতো আরওরা সভ্য হয়নি।

সক্রেটিসের সময়তো স্কুলই ছিল না। গুরুগৃহই ছিল স্কুল। তাদের মাধ্যমে একটা সভ্যতা বিনির্মাণ হয়ে যায়নি? অর্থাৎ ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিলে অনেক কিছুই এক্সট্রা কারিকুলার হিসাবে করানো যায়। বিশেষ করে বর্তমানে যেই জীবন জীবিকা, ভালো থাকা, তথ্য প্রযুক্তির মতো বিষয়তো এক্সট্রা কারিকুলার হিসাবেই শেখানো যায়। কয়েকদিন আগে আমার কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। উনি বলছিলেন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়টির জন্য অধিকাংশ স্কুল বা কলেজেই বিশেষায়িত শিক্ষক নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গণিত, পদার্থবিজ্ঞান বা অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষকদের ৬ মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই বিষয় পড়াতে দেওয়া হয়। তার মানে কী? ৬ মাসের ট্রেইনিং দিলেই এই বিষয়ে পড়ানোর মতো দক্ষ হওয়া যায়? এরকম একটি বিষয়কে কেন ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পূর্ণ বিষয় হিসাবে টেনে নেওয়া হয় এবং তাও আবার মৌলিক বিজ্ঞানের ধার কমিয়ে?

লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //