বীর বাঙালি বাঘা যতীন

আজকের চিঠিতে আপনাদের জানাব ইতিহাস বিখ্যাত একজনের বাস্তব জীবনের কথা। 

পিতৃদেব উমেশচন্দ্র এসে ছেলের মুখ দেখলেন,নাম রাখলেন জ্যোতি,সারা দেশের মানুষ অবশ্য তাঁকে চিনেছিলেন'বাঘা যতীন'নামে৷

যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের 'বাঘা যতীন' নামে পরিচিত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে অসীম শৌর্য আর বীরত্বের অনবদ্য এক কাহিনী৷ বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে বাঘকে মারার স্বীকৃতি হিসেবে জ্যোতি পেয়েছিলেন 'বাঘা যতীন'উপাধি৷

দিনটি ছিল ১৯০৬ এর এপ্রিল মাস (বাংলা ২৮চৈত্র)৷ আগেরদিন জ্যোতি অফিস করেছে কলকাতায়,তারপর সন্ধ্যার ট্রেনে কয়ায় ফিরেছে বেশ রাতে৷ ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে পুজোতলায় খালি গাঁয়ে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছিলেন আট হাতের একটা ধুতি কোমরে জড়িয়ে। 

সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় পর্বটা শুরু হয়েছে,জমিদারের খাজনা বাকি,কিছু একটা করতে হবে ,কেউ বলছেন একটা বিদ্যালয় হোক গ্রামে,একটি ছেলে কৃষ্ণনগরে পড়তে যেতে চায় সে খরচ জ্যোতি ব্যয় করবে৷ আলোচনা, শলা পরামর্শ যেন মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। দু'মাইল দূরের রাধাপাড়া গ্রাম থেকে ক'জন চাষী এসেছেন,চোখে-মুখে তাদের উৎকণ্ঠা তারা বললেন 'দাদাবাবু গাঁয়ে একটা কেঁদো আয়চে'৷

কেঁদো আসলে ছোটখাট বাঘ কে বলা হয়৷ চাষীরা বললেন ক'দিন ধরে বাঘটা তাদের গরু, ছাগল ধরে মেরে নিয়ে যাচ্ছে৷ 'চল-দেখেই আসি কেমন তোদের কেঁদো', বলে ধুতিটা মালকোঁচা মেরে ঘর থেকে একটা কুকরি (দার্জিলিং থেকে কেনা) আনতে যাবে, তখন দিদি বাধ সাধলেন 'হ্যাঁ রে কোথায় চললি?'

'না রে,অমন ন্যাড়া হাতে যাওয়াটা আমার ভাল লাগছে না-একটা বন্দুক অন্তত নে সঙ্গে'?

'ভারি তো কেঁদো,ঘুরে দেখে আসি'৷

জ্যোতির পিছনে ছুটতে ছুটতে আসছেন বড়মামার ছেলে ফণী,মেজমামার ছেলে অমূল্য তাদের অনেক আগে রাধাপাড়ার চাষীদের সঙ্গে জ্যোতি এগিয়ে চলেছেন৷

ভাইয়েরা বায়না ধরেছে দাদার সঙ্গে যাবে,অমূল্য একটা পাখিমারা বন্দুক নিয়েছে ৷দাদা জ্যোতি বলল ওটা দিয়ে বাঘ মারা যায়! লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে ফেলল পাখিমারা বন্দুকটা৷

রাধাপাড়া গ্রাম শেষ হওয়ার মুখে আখের ক্ষেত,জ্যোতি যেন দেখলেন আখ গাছগুলো সামান্য দুলছে, সাহসটা বরাবর ছিল, ব্যাপারটা বুঝতে ক্ষেতের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে জ্যোতি ঢুকলেন কয়েক হাত।

হ্যাঁ গ্রামের লোক একদম সঠিক বলেছে এ যে সত্যিই বাঘ৷

'এই তোদের কেঁদো? উঠে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, ততক্ষনে উত্তেজনা সামলাতে না পেরে অমূল্য পাখিমারার বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেছে৷ বাঘ নিজের জীবন বাঁচাতে অমূল্যর দিকে ছুটে গেল, বাঘের ধাক্কায় সে ছিটকে গেল হাত পাঁচেক দূরে৷ এসবে বিন্দুমাত্র ভয় পেলেন না জ্যোতি৷ ভয় তার জীবনের অভিধানে কোনদিন ছিল না। যখন ছোট ছিলেন মা শরৎশশী নিজে তাকে  'গড়ুই' নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যেতেন। কি শীত, কি বর্ষা মায়ের ভ্রুক্ষেপ নেই, ভরা জোয়ারে কাপড়ের একমুড়ো জ্যোতির কোমরে বেঁধে ছেলেকে ছেড়ে দিতেন জোয়ারের জলে।

ঢেউয়ের ফনায় ছোট্ট একমাত্র ছেলে যখন অবসন্ন হয়ে উঠত, তখন শাড়ির অন্য মুড়ো ধরে মা জল থেকে তুলে আনতেন একমাত্র ছেলেকে, এভাবেই যতীন্দ্রনাথ শিখেছিলেন বিপদকে তুচ্ছ করা৷ কয়া,কুষ্ঠিয়া,কৃষ্ণনগরে ছোটমামা ললিতকুমারের সঙ্গে জ্যোতি গড়ে তুলেছিল ছোট, ছোট সমিতি। সেখানে ফুটবল, কুস্তি লড়া খুব জনপ্রিয় ছিল৷ এসবের ফাঁকে ফাঁকে তরুণেরা ভাবতে লাগলেন দেশের কথা৷ গায়ে সাংঘাতিক জোর ছিল যতীন্দ্রনাথের। 

অমূল্য ছিটকে গেলেও জ্যোতি একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে ফিরে দাঁড়াল বাঘের দিকে, মুহূর্তে বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্যোতির উপর, কিন্তু এ কি, কুস্তির প্যাঁচ জানা জ্যোতি সামান্য সরে গিয়ে এক লহমায় বাঁ বগলে চেপে ধরল বাঘের ঘাড়, ডান হাত দিয়ে চালাল ছোরার ঘা। কুস্তির প্যাঁচে বাঘকে সাপটে ধরেছে মাটিতে। ভয়ঙ্কর মল্লযুদ্ধ বাঘ বনাম মানুষ৷ উভয়ের ক্ষেত্রেই একটি শর্ত, জানে বাঁচতে হলে অপরকে হত্যা করতে হবে। তাই চলে মরণপণ যুদ্ধ।

কখনো বাঘ জ্যোতিকে পেড়ে ফেলে মাটির উপর,আবার জ্যোতি চেপে বসে তার বুকে৷ আশপাশের লোকজন এসেছেন কিন্তু বাঘ-মানুষের এমন ধস্তাধস্তিতে কাকে মারতে কাকে মারবেন। তারা অপেক্ষা করছেন লড়াইটা শেষ হওয়ার।

এদিকে বাঘটা ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে লক্ষ করলেন জ্যোতি। আর নিজেও ক্লান্ত। তবে এই সুবর্ণ সুযোগ দেহের সব শক্তি এক করে ছোরা দিয়ে কুপোতে লাগলেন বাঘ কে। আস্তে আস্তে বাঘ নিস্তেজ হয়ে গেল। তবে মরার আগে জ্যোতির ডান হাঁটুতে মরণ কামড় বসিয়ে দিয়েছিল যেখান হতে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। গ্রামবাসীরা পাঁজাকোলা করে জ্যোতিকে নিয়ে চলল বাড়িতে আর পিছনে মরা বাঘ নিয়ে শোভাযাত্রা৷ 

দিদি বিনোদবালা দেবীর খাতায় লিপিবদ্ধ এই কাহিনী,চন্ডীমণ্ডপের দালানে জ্যোতির জন্য বিছানা পেতে দিলেন দিদি। তার খাতায় লেখা 'তাকে দেখে তার আত্নীয় স্বজন সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়লেন৷ 

কিন্তু জ্যোতির মুখে হাসি আর অবিচল দৃঢ় মনোভাব সবাইকে ভরসা দিতে লাগল৷ জীবনে কখনো কোনও শারীরিক ব্যথা বা মানসিক দূর্বলতা তাকে কাতর করতে পারেনি৷ মামারা ভাল চিকিৎসকদের ডেকে পাঠালেন। ক্ষতস্থান ধুয়ে তারা ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন৷

শোভাবাজারে মেজমামাকে  তার করে দেওয়া হল। স্টেশনে মুখোমুখি লড়াইয়ে বাঘ কে মেরে ফেলা জ্যোতিকে দেখতে আট-দশ গ্রামের মানুষের ভিড়। কলকাতায় যতীন্দ্রনাথের অপারেশান করলেন মেজমামার বন্ধু ডাঃ সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী৷ আস্তে আস্তে ডাঃ সর্বাধিকারীর শুশ্রূষায় যতীন্দ্রনাথ সুস্থ হয়ে ওঠেন, তিনি বাঘ মারার স্বীকৃতি হিসেবে যতীনের নাম দিলেন- ‘বাঘা যতীন’। 

বালেশ্বরের সন্নিকটে বুড়ীবলামের তীরে সঙ্গীদের নিয়ে যতীন্দ্রনাথের ইংরেজ পুলিশের বিরুদ্ধে অসীম বীরত্বের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় আরেক অধ্যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে চিত্তপ্রিয় প্রাণ দিলেন দেশের জন্য। পর দিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ মহানায়ক যতীন্দ্রনাথের জীবনাবসান হল৷ 

বাঘা যতীনের সেই অসীম সাহসী লড়াই কে কুর্নিশ করেন স্বাধীন ভারতের কোটি-কোটি ভারতবাসী আজও৷

অরুনাভা সেন 

লেখক, কোলকাতা। 


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //