বিদেশি নাগরিকের দেশপ্রেম প্রহসন

ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স – এই দুই দেশের সংযোগকারী একটি ট্রেনের দুই ভ্রমণকারীর ঘটনা শুনাব আপনাদের। মূলত দুই দেশকে সংযোগকারী ট্রেনটি ফ্রান্স হতে ইংল্যান্ডে যাত্রা করত। একদিনের ঘটনা- ট্রেনটি সম্পুর্ণ ভর্তি কেবলমাত্র একটি আসন খালি ছিলো। ট্রেন ছাড়ার কয়েক সেকেন্ড আগে উক্ত খালি আসনে এক বৃটিশ নাগরিক এসে বসে পড়েন। পাশের আসনে ছিল এক ফরাসী মহিলা। 

মহিলার হাবভাবে টেনশনের বেশ ছাপ পরিলক্ষিত ছিল। চোখমুখে দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট। এসময়  বৃটিশ নাগরিক প্রশ্ন করলেন- "ম্যাডাম,, মনে হচ্ছে আপনি অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় রয়েছেন?" 

মহিলা ইতস্ততঃ হয়ে বলেন - "না,,মানে,, তেমন কিছু না।" 

ট্রেন চলতে থাকে। বৃটিশ যুবক এবং ফরাসী যুবতী একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যান। যুবক আবার প্রশ্ন করেন - "ম্যাডাম,, কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারেন। আমি যথাসম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো।" 

মহিলা আশ্বস্ত হলেন। তাছাড়া ততক্ষণে বৃটিশ পুরুষের প্রতি তার কিছুটা বিশ্বাস জন্মে গেছে। তিনি বলেন - "আমার কাছে ১০ হাজার পাউন্ড রয়েছে।। যেটা ফ্রান্সের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা না। কিন্তু ইংল্যান্ডে ১০ হাজার পাউন্ড ক্যাশ নিয়ে ঘোরা দন্ডনীয় অপরাধ। তাই চিন্তার মধ্যে রয়েছি।" 

বৃটিশ যুবক হেসে বললেন - "সিম্পল সমস্যা। ম্যাডাম,, আপনি আমার কাছে ৫ হাজার পাউন্ড রেখে দিন। আপনার ঠিকানা দিয়ে দিন। আমি ৫ হাজার পাউন্ড আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবো। কোনো সমস্যা হবে না।" 

মহিলা আশ্বস্ত হলেন। তাছাড়া যুবকের বেশভূষা-কথাবার্তা দেখে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশও দেখলেন না তিনি। মহিলা বৃটিশ পুরুষের কাছে ৫ হাজার পাউন্ড এবং নিজের ঠিকানা লেখা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন। 

অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছনোর পর ট্রেন থেকে নেমে ফরাসী মহিলা বিনা চেকিংয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময় পিছন হতে বৃটিশ নাগরিক পুলিশের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ওঠে বললেন - "স্যার মহিলাকে পাকড়াও করুন। উনি বে-আইনি ভাবে ১০ হাজার পাউন্ড বহন করে চলেছেন।"

পুলিশ মহিলাকে পুনরায় তলব করে ব্যাগ তল্লাশি কর ব্যাগের মধ্যে ৫ হাজার পাউন্ড পেলেন। 

সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ নাগরিক যুবকটি এগিয়ে এসে নিজের ব্যাগ হতে আরও ৫ হাজার পাউন্ড বের করে দিয়ে বলেন - "স্যার, এই ফরাসী মহিলা নিজের কাছে ৫ হাজার পাউন্ড রেখেছেন। আর আমাকে দিয়ে ৫ হাজার পাউন্ড পাশ করিয়ে নিতে চাইছেন। আমি দেশের নাগরিক,দেশকে ভীষণ ভালোবাসি। দেশের সঙ্গে গাদ্দারি করতে পারি না। সুতরাং, মহিলার মুখোশ খুলে দেওয়া আমার পরম কর্তব্য বলে মনে করলাম।" 

মহিলা নিজের দোষ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন। তার ব্যাগ হতে বাকী অর্থ বের করে নেওয়া হলো। সঙ্গে পুরুষটি নিজের কাছে গচ্ছিত ৫ হাজার পাউন্ড পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে দেশভক্তির চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে চলে গেলেন। 

অন্যদিকে, পুলিশ মহিলার ১০ হাজার পাউন্ড বাজেয়াপ্ত করে ফিরতি ট্রেনে তাকে ফ্রান্স পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মহিলা একরাশ হতাশা সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সে ফেরার ট্রেনে চেপে বসেন। আর সঙ্গে নিয়ে গেলেন বৃশ সহনাগরিকের প্রতি একরাশ ঘৃণা। 

মানি-লন্ডারিং যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ধ্বংস করে দিতে পারে। বৃটিশ নাগরিক ফরাসী মহিলার মানি-লন্ডারিং রুখে দিতে দারুণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, এতে সন্দেহ নেই। পরদিন লন্ডনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বৃটিশ নাগরিকের ছবি সহ গোটা ঘটনাটি ফলাও করে ছাপা হয়। 

গোটা দেশজুড়ে চলছে বৃটিশ নাগরিকের গুণকীর্তন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পক্ষ হতে তাকে পুরস্কৃতও করা হয় দেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে। 

বেশ কিছুদিন পর ওই ফরাসী মহিলার বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলে মহিলা হতভম্ব হয়ে পড়েন। কারণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই বৃটিশ নাগরিক, যিনি কদিন আগে বন্ধু সেজে প্রতারণা করেছিলেন তার সেই ১০ হাজার পাউন্ড লন্ডন পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে। 

মহিলা প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলেন - "তুমি একজন মিথ্যাবাদী, প্রতারক। আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছো। আমার সামনে হতে এ মুহুর্তে বেরিয়ে।" 

বৃটিশ নাগরিক কোনো কথা না বলে মহিলার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। প্যাকেট খুলে মহিলা রীতিমত হতবাক। কারণ এতে রয়েছে ৫০ হাজার পাউন্ড। 

মহিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন- "এটা কি?"

বৃটিশ নাগরিক বলেন - "পুরস্কার আপনার জন্য।" 

মহিলা - "কিসের পুরস্কার?"

পুরুষ - "সেদিন আমার কাছে ৩ মিলিয়ন পাউন্ড ছিলো।। আর তা বাঁচানোর জন্য আপনার ১০ হাজার পাউন্ড ধরিয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী ছিল। পুলিশ আপনার ১০ হাজার পাউন্ড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর সেই ফাঁকে আমি নিজের ৩ মিলিয়ন পাউন্ড বের করে নিয়ে আসি অনায়াসে।" 

মহিলার চক্ষু তখন চড়কগাছ। কি বলবেন আর কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। 

বৃটিশ নাগরিক বলেন - "ম্যাডাম আমার মনে হয় এই পদক্ষেপ আমার জন্য ব্যায়বহুল ছিলো না তাই আপনার পুরস্কার স্বরূপ ৫০ হাজার পাউন্ড দিয়ে গেলাম। প্রয়োজন হলে বলবেন- আরো বেশকিছু পাউন্ড দেওয়ার কথা ভেবে দেখবো।" 

কথায় কথায় দেশভক্তি আর দেশের আইনের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দেশের সম্মানের কথা ভাবার মানুষটি সবসময় দেশভক্ত হবেন এটা বিশ্বাস করে নেওয়া যথাযথ বলে মনে করবেন না। 

বরং প্রায়ই দেখা যায় দেশভক্তির আড়ালে বড় ধরনের কোনো প্রহসন লুকিয়ে থাকে। যে চোর কিনা দেশপ্রেমের চাদর জড়িয়ে নিজের সমস্ত অপকর্ম আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে থাকে। 

সামছুজ্জামান 

 সিলেট   

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //