‘চাকরিতে শুধু জীবন গোছানো যায়, অন্যের জন্য ভাবা যায় না’

মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে পৃথিবীজুড়ে যে সকল দেশে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙালির ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত বিশ্বব্যাপী। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে  নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করে নিয়েছিল এই বীরের জাতি। আর তাঁদের এই মহান আত্মত্যাগের  স্মরণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অমর ২১ ফেব্রুয়ারি মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে সারা দুনিয়ায়। 

আবদুল মতিন বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের এক কিংবদন্তীর নাম। ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম ধুবালীয়ায় তাঁর জন্ম। বাবার নাম আব্দুল জলিল। নদীভাঙনের ফলে চাকুরির সন্ধানে দার্জিলিংয়ে গিয়ে অবস্থানের সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের অফিসে চাকরির সুযোগ পান। মা আমেনা বেগম একজন গৃহিনী ছিলেন। আব্দুল মতিন ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। ভাষা আন্দোলনের অবদান রাখা প্রিয় ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন তাঁর মৃত্যুর ঠিক্ বছরখানেক আগে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে গণমাধ্যমে কথা বলেছিলেন নানা বিষয় নিয়ে। সংগৃহীত এই সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। 

প্রশ্ন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন কত সালে?

আবদুল মতিন: ১৯৪৭ সালে। আমি দলীয় রাজনীতিতে জড়িত হইনি। কোনো পার্টিও করা হয়নি।

প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন কিভাবে শুরু হল?

আবদুল মতিন: আমার মনে হল, উর্দু কিভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে? পাকিস্তানিরা  উর্দু  বলে, বাংলা তারা বোঝে না। বাঙালিরা  উর্দু  বোঝে না। এ অবস্থার মধ্যে কী হবে? তখন তো এ দেশ ছিল পাকিস্তান। তার মধ্যে আমরা বাঙালিরাও থাকলাম। একটা বড় অংশ বাঙালি, আমাদের কথা, আমাদের ভাষা কোথাও কি কোনো স্থান পাবে না! বাংলা থাকুক এবং  উর্দুও থাকুক। বাংলা ও উর্দু দুটোই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হলো কিন্তু সেই পাকিস্তানের শাসন থাকল পাকিস্তানিদের হাতে। তাহলে আমাদের কী থাকল? বাংলাকে রাষ্ট্র করতে দেবে না।  উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে জিন্নাহ সাহেব, তার বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালে আন্দোলন শুরু হয়।

প্রশ্ন: সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহর বক্তৃতার আপনি প্রতিবাদ করলেন?

আবদুল মতিন: হ্যাঁ, সেখানে প্রতিবাদ করলাম। আমি তখন চিন্তা করিনি। কিছু বলিও নি অন্যদের। কারণ তখন ওই হলেই দেখলাম, ছাত্ররা মিটিং করছে এবং সেখান ওয়ার্নিং দিল কেউ যদি জিন্নাহকে অপমান করে তাহলে তাকে সহজে ছাড়বে না। মাস্তান টাইপের ওইসব ছেলেপেলেরা এটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিল। আমি তখন একটু অবাক হলাম। আমি ভাবলাম, আমি প্রতিবাদ করবই, যা হবার হবে। এতে যদি আমার মৃত্যুও হয় হবে, যা হয় হবে। তারপর বললাম, না, না এটা হতে পারে না। আমি বলা শেষ করেছি, তখন ছাত্ররা উঠে দাঁড়াল। তারাও বলল, না, না এটা হতে পারে না। তখন পরিস্থিতি খারাপ দেখে জিন্নাহ সাহেব তাড়াতাড়ি বক্তৃতা শেষ করলেন। সিকিউরিটিতে নিয়োজিত লোক ছিল, তারা তো বাকহীন হয়ে পড়ল। দ্রুত তাকে গাড়িতে তুলল। এ ঘটনার তিন মাস পর জিন্নাহ সাহেব করাচিতেই মারা যান। এরপর খাজা নাজিমউদ্দিন, লিয়াকত আলীসহ আরও অনেকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে লাগলেন।

প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলনের সেই সময় আপনি নেতৃত্বে ছিলেন?

আবদুল মতিন: হ্যাঁ, আমি ছিলাম। আমি তো কোনো অর্গানাইজেশনের নেতৃত্বে ছিলাম না। আমাকে নেতা মানে কে? আমার তো ওভাবে কোনো নেতৃত্ব ছিল না। আমি অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম। তারপর দেখলাম যে, জনগণের শক্তি না পেলে কিছু করা যাবে না। ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের শক্তিকে আমাদের কাজে লাগানো দরকার। তারপর আস্তে আস্তে সাধারণ ছাত্রদের আমরা ভীষণভাবে পেয়ে গেলাম।

প্রশ্ন: আপনি তো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা ছিলেন?

আবদুল মতিন: সংগ্রাম পরিষদের আমি আহ্বায়ক হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হলাম ১৯৫০ সালে।

প্রশ্ন: আচ্ছা আপনি তো তখন কোনো সাংগঠনিক রাজনীতি করতেন না। আপনি কিভাবে বুঝলেন সে সাধারণ ছাত্ররা আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে থাকবে?

আবদুল মতিন: না, আমি সাংগঠনিক রাজনীতিতে ছিলাম না। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের শুরুর থেকেই তো সক্রিয়ভাবে এর সঙ্গে ছিলাম। সেখান থেকেই এটা বুঝেছিলাম।

প্রশ্ন: মোট কতবার আপনাকে গ্রেফতার করা হয়? এবং জীবনের কতবছর আপনাকে জেল খাটতে হয়েছে?

আবদুল মতিন: পাঁচবার আমাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়েছে। প্রথমবার গ্রেফতার করে ১৯৪৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারিরা ধর্মঘট করে, সেখানে আমি তাদের সমর্থনে পিকেটিং করেছিলাম। পুলিশ সচিবালয়ের গেটে থেকে ধরে দুমাসের ডিটেনশন দেয়।

দ্বিতীয়বার ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে শান্তিনগর কমিটির মিটিং ডাকা হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে আমার নামসহ বহু নেতার নামে গ্রেফতারি পরয়ানা জারি করা হয়। সেবার ১ বছর সাত দিন জেলে থেকে ১৪ মার্চ ১৯৫৩ সালে মুক্তিলাভ করি।

তৃতীয়বার গ্রেফতার হই ঈশ্বরদীতে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায়। সেবার সরকার আমাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ হাজার টাকা ঘোষণা করে। চতুর্থবার ধরা পড়ি ১৯৭২ সালের ৫ জুন, নাটোর থেকে। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেয়ে আবার সক্রিয় হই। তারপর আবার শেষবার ধরা পড়ি এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে। সবমিলে পাঁচবার গ্রেফতার হয়ে প্রায় দশ বছর জেল খেটেছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে এখনো সর্বপর্যায়ে বাংলাভাষা চালু হয়নি। আপনার অভিমত কী?

আবদুল মতিন: ভাষার জন্যে লড়াই হলো, জীবন গেল, রক্ত গেল, অথচ তার মূল বিষয়টাই রাজনীতিবিদরা এড়িয়ে চলেন। ভাষাশহীদদের স্মৃতি রক্ষায়ও কোনো ধরনের মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের নামে যে জাদুঘরগুলো আছে সেগুলো একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

প্রশ্ন: শুনেছি আপনি সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু করেননি। কেন?

আবদুল মতিন: প্রলোভনে পড়ে বৃত্তি নিয়ে বা সিভিল সার্জনে চাকরিতে জয়েন করলে ভাষা আন্দোলনের মতো মহান আন্দোলনের অংশীদার হয়ে যেটুকু ভূমিকা পালন করেছি, তা থেকে বঞ্চিত হতাম। চাকরি দিয়ে শুধু নিজের জীবন গোছানো যায়, অন্যের ভাবনা ভাববো কখন? সরকারি চাকরি করলে কোনো আন্দোলন সংগঠন করা যায় না। চাকর হওয়া কি সবার পক্ষে সম্ভব? নিজের জন্য করে কি আনন্দ পাওয়া যায়? যারা পায় তারা পাক। তাছাড়া চাকরি দিয়ে নিজের ভাগ্য বদল করা যায়, জাতির ভাগ্য বদল করা যায় না। একটাইতো জীবন। সংগ্রাম না থাকলে সে জীবনের কোনো মূল্য আছে? অন্যের কাছে থাকতে পারে আমার কাছে তার কোনো মূল্য নেই।

আপনার মূল্যবান সময় দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আবদুল মতিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

(সংগৃহীত)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //