মানব সেবাই মানুষের আত্মার পরিতৃপ্তির যোগান দেয়: প্রফেসর ডা. জাকিয়া আক্তার

প্রফেসর ডা. জাকিয়া আক্তার মানবসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা ঘাত-প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পেশাগত জীবনে দীর্ঘ সময় ধরেই ডা. জাকিয়া মেডিকেল কলেজে পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত থেকে সঞ্চয় করেছেন নানা অভিজ্ঞতা। বর্তমানে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল এর উপাধ্যক্ষ ও এনাটমির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সম্প্রতি সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে এক খোলামেলা সাক্ষাৎকারে মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম, স্বাস্থ্যসেবা খাত ও  ব্যক্তিজীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন।  সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাম্প্রতিক দেশকালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জাফর খান। 

চিকিৎসা পেশায় আসার পেছনে আপনার অনুপ্রেরণা কে?

এ পেশায় আসার পেছনে আমার মায়ের অনুপ্রেরণার কথাই বেশি মনে পড়ে। আম্মা সবসময় বলতেন-‘’তোমাকে ডাক্তার হতে হবে।‘’ তিনি শিক্ষক ছিলেন আর সে সুবাদে আমার পড়াশোনার বিষয়ে খুব যত্নশীল ছিলেন। তার সেই গাইডলাইন আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছে ভালো একটা কিছু করার। এমনকি আমাকে নিয়ে হাসপাতালে যখন যেতেন তখনও ডাক্তারদের দেখিয়ে বলতেন-‘’দেখো কী সুন্দর লাগছে দেখতে!’’ আমি বরাবর ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিলাম। বড় হয়েছি ময়মনসিংহে। মায়ের প্রভাব আমাকে পরবর্তী জীবনে চিকিৎসক হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। আর সে থেকেই লক্ষ্য স্থির করে ডাক্তার হতে পড়াশোনায় আরও সিরিয়াস হলাম। কোচিং করলাম, এইচএসসির রেজাল্টও বেশ ভালো হলো। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে সুযোগ পেয়ে গেলাম। এভাবেই আসলে এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়া। মূলত আমার মায়ের ঐকান্তিক ইচ্ছাতেই এ পেশায় আসা। 

আপনার ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা জীবন নিয়ে যদি বলেন ...

আমি ছোটবেলায় নানার বাড়িতে থেকেছি বেশিরভাগ সময়। উনি শিক্ষক ছিলেন। নানা ইংরেজি পড়াতেন। আমার ছোট মামা ও আমাকে ইংরেজিতে দক্ষ বানাতে তার প্রচেষ্টা ছিল খুব স্মৃতিময়। এমনকি পরিবারের সকলের আমাদের দুজনের প্রতি খুব আশা ছিল যে আমরা ভবিষ্যতে ভালো কিছু করব। ইংরেজির গাইডটা পেয়েছি নানার কাছেই। নানার বাড়ি নেত্রকোণায়। আমি আর মামা বয়সে কাছকাছি থাকায় আমাদের মাঝে পড়ার একটা প্রতিযোগিতাও ছিল। এখনও মনে আছে আমি এতোটাই আদরের ছিলাম যে নানার বাড়ি পৌঁছাতেই রাস্তায় থাকা অবস্থায় আমাকে সবাই দৌড়ে গিয়ে কোলে করে নিয়ে আসতেন। 

আমাদের পড়ার পরিবেশটাও ছিল চমৎকার। সন্ধ্যা নামলেই রুটিন মাফিক প্রতিদিন হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসতাম। অদ্ভুত প্রাকৃতিক নৈসর্গিক গ্রাম্য পরিবেশে বারান্দায় বসে সবাই লাইন ধরে পড়তে বসতাম। আসলে একটা পড়ার পরিবেশ ছিল তখন, যেটি মানসিকভাবে তৃপ্তি  দিত। আর সেখান থেকেই পড়াশোনার পাশপাশি মূল্যবোধের শিক্ষাটাও পারিবারিকভাবেই পেয়েছিলাম।  

মুসলিম গার্লস  স্কুল থেকে এসএসসি ও মুমিনুন্নিসা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হই। এভাবেই ডাক্তারি অধ্যয়নের শুরু। 

কর্মজীবনে মানবসেবার জন্য নিজেকে নিবেদিত করতে আসা নাকি ক্যারিয়ারে অনেক দূর যাওয়া— কোনটিকে বড় করে দেখেছেন? 

আসলে সেসময় আমাদের কাছে সেভাবে কোনও গাইডলাইন ছিল না। খুব তথ্য আমাদের কাছে থাকতো না। তখন জানতাম শুধু গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ঢাকায় এসে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করতে হবে, বিসিএস দেব— এভাবেই ভাবনা ছিল। আমাদের শিক্ষকেরা বলতেন শিখতে হলে ট্রেনিংয়ের বিকল্প নেই। আমরাও বুঝতাম প্রপার ট্রেনিং না থাকলে এ পেশায় নিজেকে উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ট্রেনিং করতে হলে নিজের মেডিকেল কলেজ ছাড়া বেশ কঠিন। মনে আছে ইন্টার্নির সময় আমরা  কঠোর পরিশ্রম করতাম। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছোটাছুটি করতে হতো। গ্রামের অসহায় মানুষ যারা সেবা নিতে আসতেন তাদের দেখভাল করাও আমাদের ইন্টার্নির অংশ ছিল। 

আমি মনে করি মানব সেবার মূল্যবোধ না থাকলে এ পেশায় আসা উচিত না। ক্যারিয়ার এমনিতেই হয়ে যায়, কিন্তু মানুষ হিসেবে মানবসেবাকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। মানব সেবার দর্শন থেকেই এ পেশায় আসা আমার। 

আমার একটাই চিন্তা ছিল— যে কোনো মূল্যে আমাকে শিখতে হবে। মনে আছে, একবার একটা নরমাল ডেলিভারির জন্য সারারাত দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার তখন নাইট ডিউটি ছিল। একদিন ঠিক রাত ১০ টায় একজন রোগী আসলেন। তখন আমি রংপুর মেডিকেলে ইন্টার্ন করছি। লেবার পেইন নিয়ে একজন আসেন। রংপুরে যেটা হতো— তখন সাধারণত আশ-পাশের অসহায়, হত-দরিদ্র কিংবা পল্লী অঞ্চলের মানুষেরাই স্বাস্থ্যসেবা নিতে বেশি আসতেন আমাদের হাসপাতালে। যাই হোক ওই রোগী আসার পর আমাদের সেবাদান শুরু হলো। বারবার মনে হচ্ছিল হয়তো কিছুক্ষণ পরেই ডেলিভারি হয়ে যাবে। কিন্ত অনেক সময় গেলেও তা হচ্ছিল না। এসময় তিনি আমার হাত এমন শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন যে কোনভাবেই তার পাশ থেকে সরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যদিও আমার সবটুকু দায়িত্ব তার প্রতি তখন সম্পন্ন করেছিলাম। উনি আমার ওপর এতোটাই আস্থাশীল ছিলেন যে বলেই ফেললেন- ‘না আপা, আপনি যাবেন না। আমার খুব ভয় হচ্ছে। আপনার ওপর ভরসা চলে এসেছে’।’ এখনও স্মৃতিতে অম্লান সেদিনটি। পরে ফজর পর্যন্ত ওভাবেই আমি ওই মহিলার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। অবশেষে ফজরের পর উনার ডেলিভারী সম্পন্ন হয়। 

আমি মনে করি ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। এখনও দুনিয়াতে ভালো মানুষ আছে বলেই সব কিছু টিকে আছে। দু'একজন ব্যতিক্রম থাকবেই, তার জন্য ঢালাওভাবে মন্তব্য করা যাবে না। আর তাই এ পেশার মাধ্যমেই মানুষের আত্মার পরিতৃপ্তি মেটানো সম্ভব বলে আমি মনে করি। 

ক্যারিয়ার জীবনের শুরুর দিকের কিছু কথা যদি বলেন….

অধ্যয়ন শেষ করে ভাবছিলাম গাইনী নিয়েই ক্যারিয়ার গড়ব কী না! আমার লক্ষ্য ছিল স্পেশালাইজেশন হিসেবে যেদিকেই ক্যারিয়ার বেছে নেই না কেনো, আমাকে সত্যিকার অর্থে শিখতে হবে। তবে আমার মায়ের চাওয়া ছিল গাইনীতে যেন  ক্যারিয়ার গড়ি। মায়ের চাওয়ার দিকে তাকিয়ে তখন ঢাকায় আসলাম। শিক্ষার পাশাপাশি প্র্যাক্টিক্যাল নলেজ বাড়াতে হবে। তাই সেদিকে নজর দিলাম। এর মধ্যে আবার বিয়ে হয়ে গেল আমার। গাইনীতে কোর্স করতে বিএসএমএমইউ ও ঢাকা মেডিকেলে ফর্ম জমা দিলাম। আমার স্যারেরা বলতেন ব্যবহারিক দক্ষতা বাড়াতে হলে অবশ্যই ঢাকা মেডিকেলে ট্রেনিং করতে হবে। একমাত্র ওখানেই শেখা যায়। সুযোগ পেলাম ভর্তির। এভাবেই শুরু ক্যারিয়ারের প্রথম ধাপ। ইন্টার্নের পর অনারারী হিসেবে একবেলা ডিউটি, অন্যবেলা পড়ার সুযোগ পেলাম। কোর্সের সময় টানা ৮ মাস ডিউটি করার পর আমার শারীরিক অসুস্থতার জন্য গাইনিতে ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা ছেড়ে দেই। আমার হাজবেন্ড ডা. মাহবুবুল আলম, ইএনটি বিশেষজ্ঞ। বিসিএস হয়ে গেল তার। এর মাঝে আলট্রাসোনোর একটা ট্রেনিং করে নিলাম। হাজবেন্ডের পরামর্শে এনাটমির ওপর বিএসএমএমইউ থেকে এমফিল করলাম। এদিকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার সময়েই লক্ষ্যস্থির করে ফেললাম একাডেমিক লাইনে কাজ করব। এভাবেই আমার শুরু। 

আমি মনে করি সিনসিয়ারিটি অনেক বড় একটা বিষয়। সবসময়ই আমি মানুষ হিসেবে সময়ানুবর্তিতার দিকে লক্ষ্য রেখেছি। আমার স্যার মানজারে শামীম আমাকে খুব স্নেহ করতেন এই সিনসিয়ারিটির জন্যই। আমি আজও খুব সম্মান করি স্যারকে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন স্যারের অধীনেই শেষ হয় আমার। উনার ক্লাস আমি মিস করতাম না। এমনকি একবার আমার হাজবেন্ড এক্সিডেন্ট করেন, তার অবস্থা জটিল হতে থাকে। এক পর্যায়ে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই অপারেশনের দিনেও স্যারের ক্লাস থাকায় আমি ক্লাস করতে চলে যাই, যা শুনে স্যার রীতিমতো অবাক হয়ে যান। রাত-দিন পরিশ্রম করে স্টাডি শেষ করি। এদিকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই চাকরি পাই সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। সেখানে আমার কাজের আন্তরিকতা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। এটা নিয়েও আরেক মজার স্মৃতি আছে। কর্মস্থল বেশী দূরে হয়ে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলাম বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য জব ছেড়ে দিতে। কারণ ডিউটি শেষ করে আমার যাওয়া আসা করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানে একাডেমিকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করি। আমার বাচ্চারা ছোট, বাসায় কেউ নেই। একা সবদিক সামলাতে হয়। এদিকে শিক্ষক হিসেবে নিজ দায়িত্ববোধ থেকেই খুব আন্তরিকতা নিয়েই শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকতে হয়। সপ্তাহে চারটা করে ক্লাস। সিনিয়র টিচার হিসেবে আমি একাই ছিলাম। একদিন মেসেজ আসলো ডিউটি টাইম বেড়ে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আমায় কাজ করতে হবে। আর তা হলে বাসায় ফিরতে ফিরতে সবমিলিয়ে ৫ টা বেজে যাবে। এতো দীর্ঘসময় আমার বাইরে থাকা আমার দুই সন্তান মায়িশা আর মৃত্তিকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নতুন শিডিউল, বাসা অনেকদুর সবমিলিয়ে আর সম্ভব ছিল না কাজ করা। যেখানে ফ্যামিলিকে সময় দিতে গিয়ে ক্যারিয়ার ছেড়ে একাডেমিক সেক্টরে এসেছি, সেখানে আবার সেই ফ্যামিলিকেই সময় দিতে পারব না তা হয় না।  এদিকে চেয়ারম্যান স্যার আবার কোনোভাবেই আমাকে ছাড়বেন না। উনার নাতনী আমার স্টুডেন্ট ছিল। তার কাছ থেকে স্যার শুনেছেন আমি নাকি বেশ ভালো পড়াই, আর তাই একাট্টা হয়ে ছিলেন তিনি যেন আমি জব না ছাড়ি। একমাসের বেতন ছেড়ে দিয়ে অবশেষে আমি ‘রিজাইন’ দেই।  

পরবর্তীতে নর্দার্ন মেডিকেল জয়েন করলাম। এরমাঝে একদিন উকিল নোটিশ পেলাম। বলা হলো- আমাকে সিকদারে ফিরে যেতে হবে। আসলে এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিলাম সবার কাছে যে কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই আমাকে ছাড়তে চাচ্ছিল না। এমনকি এর মাঝেই শুনলাম আমার জায়গায় নতুন যিনি এসেছেন উনাকে আমি যে রুমে বসতাম সেখানে না দিয়ে অনত্র ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কারণ অধ্যক্ষ স্যার বলেছেন-‘ এই রুমে জাকিয়াই আসবে।’ অনেক অনুরোধ ও চেষ্টা-চরিত্রের  পর একটা সমাধান করি। আমি জয়েনের পর মাত্র ৬ মাসের মধ্যে যথাযথ নিয়ম মেনেই আমাকে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (কারেন্ট চার্জ) হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এটা আসলে আমার কাছে অন্যরকম স্মৃতি।  

এদিকে নতুন কর্মস্থলও যখন ছেড়ে আসি, সেটাও ছিল আবার আরেক নির্মম কষ্টের। আমার শিক্ষার্থীরা কান্নাকাটি করে অনুরোধ করছিল যেন না ছেড়ে যাই তাদের। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে আমাকে চলে আসতে হয়।

আপনার কোন বিশেষ দিকগুলোর জন্য সবার কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে হয়? 

আমি বিশ্বাস করি আল্লাহর একটা রহমত ছিল আমার ওপর। পাশপাশি আসলে যদি কেউ মমতা, সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষাদান করেন তবে তার মূলায়ন শিক্ষার্থীরাই করে থাকেন। এক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা নিয়ে আপনি যে পেশাতেই নিজেকে নিয়োজিত করেন না, আপনার সফলতা আসবেই। আমি সবার মাঝে আমার ওপর একটা আস্থার জায়গা তৈরি করেছিলাম। 

সিনসিয়ার থাকা, মানুষের জন্য উপকারের চেষ্টা ও চিন্তা-কর্মে সৎ থাকা-— এ তিনটি মানুষের সফলতার অন্যতম উপাদান, আমি বলব। সবসময় মনে রাখতে হবে আমি যা কিছু করব, মানুষের ভালোর জন্য করব। কাজের সময় কাজ, স্টাডির সময় স্টাডি, অন্যান্য সকল প্রয়োজনীয় কাজও সমান গুরুত্বের সাথে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক জীবন পরিচালনা করাই একজন আদর্শ মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমি চেষ্টা করে আসছি সবসময় এভাবেই জীবনের সকল স্তরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলার। হয়তো এ দিকগুলো আমার নিজের মাঝেই একটা আস্থার বলয় তৈরি করে দিয়েছে। 

বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিকুলাম সময়ের প্রেক্ষাপটে কতটা আধুনিক হয়েছে বলে মনে করেন ও শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনামূলক চিত্র এখন কেমন? 

দেখুন স্বাধীনতার পর থেকে অনেক কাজ হয়েছে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নীতিনির্ধারকেরা সবসময় চেষ্টা করে এসেছেন কীভাবে একটি আধুনিক মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। আমি বলব বর্তমান সরকার অধিক যত্নের সাথে আমাদের মেডিকেলের একাডেমিক সেক্টরকে ঢেলে সাজানোর জন্য নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সত্যি যা প্রশংসনীয়। এখন এ খাতে অনেক বাজেট দিয়েছে সরকার। সব কলেজে রিসার্চ সেল রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, উন্নত দেশের কারিকুলামের আদলে নিউ কারিকুলাম প্রণীত করেছে, লোকবল বাড়ানো হয়েছে, টিওটি’র ব্যবস্থা করেছে (যা আগে ছিল না) ইত্যাদি নানামুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার যেভাবে স্বাস্থ্যশিক্ষায় মনোযোগী হয়েছে তাতে বলা যায় বর্তমান উন্নতির পাশপাশি ভবিষ্যতেও খুব ভালো দিকেই যাচ্ছে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা। 

আমি বলব এসব উদ্যোগের সঠিক বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে সময় যত যাবে আরও উন্নতি হবে আমাদের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার। আমি প্রচন্ড আশাবাদী। 

আমাদের মেডিকেল কারিকুলাম আগের চেয়ে আরও উন্নতি লাভ করায় এখন আগের চেয়েও বেশী বিদেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়ছেন। আমার কলেজেই বর্তমানে ৫০ শতাংশ ফরেন স্টুডেন্ট। বর্তমানে আমার কলেজে নেপাল, ভারতসহ অনেক দেশের স্টুডেন্ট রয়েছে। এভাবে সারাদেশে বিভিন্ন কলেজে বহু সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এটা আমাদের দেশের মেডিকেল শিক্ষার জন্য জন্য বড় একটা অর্জন। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে। 

একাডেমিকে এ বছরে নতুন কারিকুলাম চালু হওয়ায় এই খাত কালক্রমে আরও বিকশিত হচ্ছে। ফেইজ-১ থেকে শুরু করে সকল স্তরে বেশ ভালো কারিকুলাম দিয়েছে সরকার। এখন আমাদের পক্ষে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব হলো এর মাধ্যমেই কীভাবে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত একজন চিকিৎসক হিসেবে তৈরি করা যায়। এটি আমাদের একান্ত দায়িত্ব। বর্তমান কারিকুলামে ১ম বর্ষ থেকেই ক্লিনিক্যাল ওরিয়েন্টেড পাঠ প্রণয়ন করা হয়েছে যা অত্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ। আমি যতদুর জানি এই কারিকুলাম প্রস্তুতের পেছনে শ্রদ্ধেয় ডা. হুমায়ুন স্যার ও ডা. মানজারে শামীম স্যারের অনেক অবদান রয়েছে। 

বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান নিয়ে যদি কিছু বলেন… 

সরকারি মেডিকেল সবসময়েই বেটার। তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মান এখন চোখে পড়ার মতো। ভৌত অবকাঠামো, টিচার স্টাফ, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, পাঠদান পদ্ধতি ও নানা সুযোগ-সুবিধার জন্য বর্তমানে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রাইভেট মেডিকেলেও অনেক ব্রাইট স্টুডেন্ট আসছে এখন। আমরা জানি ভর্তি নীতিমালায় সেন্ট্রাল সিস্টেম চালু করায় ভর্তি পরীক্ষার মেধা তালিকার ক্রমানুসারে যারা সরকারিতে সুযোগ পায়নি তারাই বেসরকারিতে আসছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একদম জ্ঞান শূন্যরা আসছে। দেখা গেছে খুব অল্প নাম্বারের ব্যবধানে যারা সরকারিতে আর ভর্তির সুযোগ পায়নি তারা আমাদের শিক্ষার্থী হচ্ছে, আর তারাও যথেষ্ট মেধাবী। তাই শিক্ষার্থীর মানের কথা বললে বেসরকারি কলেজগুলোয় এখন যথেষ্ট মেধাবীরা আসছে। আমাদের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা শিক্ষার্থীদের ইটিকোয়েট, ম্যানারস এসব বিষয়ে পাঠদান করে থাকি। একজন মানুষ কীভাবে মানবিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গড়ে উঠবেন সেদিকে খেয়াল রেখেই এমন শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক।  

আমি বিশ্বাস করি টিচারেরা ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে শিক্ষা দিব সেভাবেই আমাদের আউটপুট আসবে। এক্ষেত্রে আমি শিক্ষক সমাজ ও কর্তৃপক্ষকে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আরও যত্নশীল হতে অনুরোধ করব।

আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে কতটা উন্নয়ন ও পরিবর্তন এখন পর্যন্ত সাধিত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? 

আমি মনে করি সামগ্রিকভাবেই স্বাস্থ্য খাত আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে বর্তমানে পদোন্নতি থেকে শুরু করে নানান বিষয়ে সমস্ত জটিলতা কেটেছে এই সরকারের আমলে। তবে আমি বলব এক্ষেত্রে ব্যক্তি মানসিকতার পরিবর্তন খুব দরকার। আবার একইসঙ্গে চিকিৎসকদের প্রচুর কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়ে সেদিকটায় খেয়াল রেখে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাদিও বাড়াতে হবে। বর্তমানে জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজের যে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার, আমি মনে করি সেটা আরও উন্নতিতে সহায়ক হবে। এখনকার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলো অনেক উন্নত হয়েছে। সারা দেশের পাবলিক হাসপাতাল থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি ইউনিট ব্যপক উন্নত হয়েছে। আমি যথেষ্ট আশাবাদী। এভাবে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে আমদের দেশের রোগীদের মধ্যে একদিন দেখবেন বিদেশমুখিতাও কমে আসছে।  

আপনার বর্তমান কর্মস্থহল ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল সম্পর্কে যদি বলেন… 

২০১০ সালে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। বর্তমানে ১২তম ব্যাচ চলছে। আপনারা জানেন একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল বিএমডিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিজি হেলথের ত্বত্ত্বাবধানে থাকে। মূলত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেখার পরেই সেখানে কয়টা আসনে ভর্তি কার্যক্রম চলবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। তৃতীয় ব্যাচ ব্যাচ থেকে আমাদের আসন সংখ্যা ৯০টি করা হয়। বর্তমানে আরও ১০ টা আসন বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের কলেজে শিক্ষার মানের দিক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আপোষ করা হয়নি। বিশেষ করে আমাদের পাঠাদান পদ্ধতি, টিচার, স্টাফদের নিষ্ঠা-আন্তরিকতা আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরেছে। বর্তমানে সাড়ে চারশ’র (৪৫০) বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রায়শই মেধা তালিকায় স্থানলাভ করছে। পাশপাশি অনার্স লাভও করছে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা (অনার্স হলো ৮৫% নাম্বার প্রাপ্তি)। আমি খুব পজিটিভ আমার স্টুডেন্টদের প্রতি। তাদের ধৈর্য্য, লেখা-পড়ার প্রতি আন্তরিকতা আমাদের ফলাফল ভালো করতে অবদান রাখছে। সামনে স্থায়ী ক্যাম্পাসের পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের। 

আমাদের হাসপাতালেরও সুনাম রয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর রোগী আসেন। সেবার মান ভালো বলে ক্রমেই চাহিদা বাড়ছে আমাদের হাসপাতালের। এমনকি করোনার সময় আমাদের কলেজকে কোভিড ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়েছিল। কোভিড মোকাবেলায় আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল। 

কোভিড সময়কালীন আপনার কোনো স্মৃতি রয়েছে কী? 

হ্যাঁ। কোভিডের শুরুতেই আমার হাজবেন্ড আক্রান্ত হন। এপ্রিলে তার করোনা ধরা পড়ে। তবে দুজনেই ডাক্তার থাকায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেই। সেসময় আমার বাসায় আমার বৃদ্ধ মা, এটা খুব দুঃশ্চিন্তার ছিল। একদিকে মা ও অন্যদিকে দুই সন্তান তাদের সবাইকে আলাদা করে রাখলাম। আমার হাজবেন্ড আবার হাসপাতালে ডিউটি করে বাসায় ফেরে, তাই তাকেও সম্পূর্ণ আইসোলেশনে দিলাম। একদিকে সারা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি। হাজবেন্ডকে মানব সেবায় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আর, অন্যদিকে বাসায় অন্য সদস্যদের অবস্থান-সব মিলিয়ে দিশেহারা পরিস্থিতি। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সবকাজ অব্যাহত রেখেই যা যা ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেগুলো নিলাম। ধীরে ধীরে আমার হাজবেন্ড সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে সেসময়টা ছিল সত্যি বিভীষিকাময়। চারদিকে নীরবতা, মানুষের গোপন আহাজারি, লকডাউন সব মিলিয়ে কঠিন অবস্থা। এর মধ্যেই মানুষের সেবার জন্য আমাদের চিকিৎসকদের কঠিন যুদ্ধে নামতে হয়। আর সে যুদ্ধে সব ভয়কে উর্ধ্বে রেখেই আমরা আমাদের দায়িত্বে অবিচল ছিলাম। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //