নব্যজাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়াকে গ্রাস করেছে: সাবিহা হক

সাবিহা হক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। স্নাতক শিক্ষার্থী অবস্থায় শিক্ষকতা শুরু করেন অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের সিনিয়র শাখায়। বিএএফ শাহীন ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন ২০০১ সালে। উচ্চতর গবেষণা করেছেন অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাথমিক অবস্থায় এমফিল করেছেন বাংলাদেশে ইবসেন চর্চায় লিঙ্গবৈষম্য ও নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতার প্রভাব নিয়ে। পরে নরওয়েজিয়ান রিসার্চ কাউন্সিলের স্কলারশিপ নিয়ে হেনরিক ইবসেনের পিয়ের গিন্ট নাটকের দক্ষিণ এশিয়ার দুটি অ্যাডাপটেশন ও নরওয়ের আঞ্চলিক একটি ভাষায় একটি অ্যাডাপটেশন নিয়ে পিএইচডি করেছেন। ইবসেনের ওপর গবেষণা করতে গিয়েই নারী চরিত্র ও নারীর জীবন নিয়ে কাজ করার প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি মূলত নাটক ও নারী লেখকদের নিয়েই লেখালেখি করেন। ২০২২-এ প্রকাশিত মুঘল সময়ের মুসলিম নারী সাহিত্যিকদের জীবন ও কর্ম বিষয়ক তার গ্রন্থ দ্য মুঘল এভিয়ারি : উমেন্স রাইটিং ইন প্রি মডার্ন ইন্ডিয়া প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির জন্য ২০২৩-এর লিটারারি এন্সাইক্লোপিডিয়া পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। গবেষণার পাশাপাশি তিনি ছোট গল্প ও কবিতা লেখেন। ডেড মেটাফোর শিরোনামে একটি ছোট পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে বহু নতুন লেখককে তিনি লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মুঘল সাম্রাজ্যের নারী, সাম্প্রতিক সময়ে নারী অধিকার, নারীর সাহিত্য চর্চা এসবই সাবিহা হকের কথায় উঠে এসেছে নিপুণভাবে। তার সঙ্গে কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সাহিত্য সম্পাদক এহসান হায়দার। 

‘‘দি মুঘল এভিয়ারি : উইমেন’স রাইটিং ইন প্রি-মডার্ন ইন্ডিয়া’’ কেন এই বইটি লেখার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন?
সাবিহা হক: আমি ক্যাথরিন ল্যাস্কির লেখা একটি বই হঠাৎ পেয়ে পড়ে ফেলি। বইটির নাম জাহানারা: দ্য প্রিন্সেস অব প্রিন্সেসেস। বইটি মুঘল রাজকুমারী জাহানারা বেগমের জবানীতে লেখা একটি কাল্পনিক দিনলিপি। ল্যাস্কি এই বইতে শিশু জাহানারার মুখ দিয়ে তার বয়স্ক পিতামহী নূরজাহান বেগমকে সারপেন্ট বা সাপ বলে গালি দেওয়ালেন। তখন আমার কেমন খটকা লাগল। বইটি পড়ে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারে, কারণ একেবারেই বাস্তবসম্মতভাবে এই দিনলিপি লেখা এবং যিনি জানেন না যে জাহানারা তার জীবদ্দশায় কোনো দিনপঞ্জি লেখেননি, তেমন পাঠকের পক্ষে এই বইয়ের অসত্যতা নিরূপণ করা সত্যিই দুরূহ। আমি কৌতূহলী হয়ে একটু খোঁজ করে জানতে পারি যে ইংরেজিতে জাহানারার কমপক্ষে তিনটি এমন কাল্পনিক দিনলিপি রচিত হয়েছে। ইদানীংকালে বেশ কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস রচিত হয়েছে যার প্রায় সব কটিতে মুঘল রাজকন্যাদের চরিত্র হনন করা হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিশেষত পুরুষ ঔপন্যাসিকের হাতে নারীচরিত্রনির্ভর উপন্যাসে এমন চরিত্রহননের ঘটনা ঘটে- একথা আমরা সবাই জানি। তদুপরি, বর্তমান নব্যজাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষের ইতিহাস হতে মুঘল সময়কে বিস্মৃত করার যে প্রয়াস তার সাথে কোথাও এই রাজকুমারীদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টাও যেন এক ভিন্ন মাত্রার ইঙ্গিত দেয়। অথচ এই নারীগণ ছিলেন বিদুষী, ধর্মপরায়ণ ও সজ্জন। তাদের হাতে রচিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য। মূলত ভারতবর্ষের সাহিত্যের কিছু ধারা এদের হাতেই সৃষ্টি। সচেতন পাঠক ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে, তদুপরি একজন নারী হিসেবে আমার মনে হলো ছোট করে হলেও প্রতিবাদের জায়গা থেকে কিছু লেখা উচিত। তারই ফল এই বই। 

গুলবদন বেগম, জাহানারা, জেব-উন-নিসা এবং হাব্বা খাতুন- বইটিতে এই চারজন মুসলিম নারীকে বেছে নিয়েছেন। এই চারজন নারীকে বেছে নেওয়ার কারণ যদি বলতেন?
সাবিহা হক: আমি বইটি লিখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্নন প্রেসের প্রাক-আধুনিক সাহিত্যের একটি সিরিজ হিসেবে। এই চারজন নারী ওই সময়ের ভারতবর্ষের সাহিত্যের প্রতিনিধি, আর আমার সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম নারী এবং মুঘল ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এই নারীদের বেছে নিয়েছি। তিনজন মুঘল রাজকুমারী ও একজন কাশ্মীরি রানী যিনি মুঘলদের ঘেরাটোপে একরকম বন্দি ছিলেন। এদের নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না, সাহিত্য সংকলনগুলোতে এরা স্থান পাননি; কিন্তু এদের রচনাগুলো মনোমুগ্ধকর ও উচ্চমানের। 

এই মুসলিম নারীদের লেখায় নারীবাদ ব্যাপারটি যদি আলোকপাত করতেন...
সাবিহা হক : এরা ভারতবর্ষের প্রথম সারির নারীবাদী হিসেবে পরিচিত না হলেও, এদের লেখায় নারীর মনস্তত্ত্ব, নারীর অধিকার, নারীর ইতিহাস-বিশ্লেষণের ক্ষমতা, নারীর ধর্মানুভূতি, নারীর সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ, এবং সর্বোপরি নারীর নিজস্ব চেতনার সন্ধান পাওয়া যায়। নারীবাদ আসলে কী? নারীবাদ তো পুরুষের সাথে যুদ্ধ নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠা ও নিজের অধিকারের কথা বলা। এদের লেখায় তারই ছাপ রয়েছে। পশ্চিমি সাহিত্যে ভারতবর্ষের নারীকে প্রাক-আধুনিকতার অন্ধকারে তলিয়ে থাকা একটি শ্রেণি মনে করা হয়, কিন্তু তা যে সত্য নয়, বরং জ্ঞানের আলোয় প্রজ্বলিত এ সকল নারীর জীবন, এই সত্যই বেরিয়ে আসে এদের লেখা থেকে। 

এভিয়ারি ইমেজটা ব্যবহারের নিশ্চয়ই কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল? 
সাবিহা হক : হ্যাঁ, আমি সচেতনভাবে এই এভিয়ারি বা পক্ষীশালা শব্দটি ব্যবহার করেছি। মুঘল নারীরা একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অধিকার ভোগ করতে পারতেন; কিন্তু কোথাও সেই সীমা পার হলে নেমে এসেছে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ শাস্তি। ডানা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে এদের। তাই এই মেটাফরের ব্যবহার করেছি। 

বর্তমান দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই নারীদের লেখা কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
সাবিহা হক : বইটিতে আমি লিখেছি, বর্তমান সময়ের নব্যজাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়াকে গ্রাস করেছে। ভারতের অবস্থান এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট। সেখানে ইতিহাস বই থেকে মুঘল সময়কে একপ্রকার মুছে দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। এভাবে কি ইতিহাসকে মুছে দেওয়া যায়? বাংলাদেশেও এরকম চেষ্টা আমরা একসময় দেখেছি। একটি প্রজন্মকে ইতিহাস জানতে না দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। বরং ইতিহাসের নানা না জানা বিষয়কে যদি তুলে আনা যায়, পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হতে পারে সব সমস্যার সমাধান। এই নারীদের লেখায় আমরা না জানা অনেক বিষয়কে জানতে পারি। জানতে পারি হত্যা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মতো ঘটনার অন্তরালে থাকা চোখের জলের ইতিহাস। মুঘল বাদশাহ শুধু রক্তলোলুপ পশু নয়- সেও দোষেগুণে একজন মানুষ, একজন পিতা, একজন ভাই, একজন স্বামী, একজন পুত্র। মেলবন্ধনের একটি যোগসূত্র হতে পারে ইতিহাসের এই পুনঃপাঠ। আর তাই এদের লেখা আমার ইতিহাস পাঠের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ মনে হয়। 

বইটির জন্য আপনি লিটারেরি এনসাইক্লোপিডিয়া বুক পুরস্কারের মতো সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, এই প্রাপ্তি আপনার ভবিষ্যৎ কর্মে আরও দায়িত্ব বাড়িয়ে দিল- এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
সাবিহা হক: দেখুন, পুরস্কারের জন্য কেউ লেখেন না, তবে যে কোনো স্বীকৃতি বা অর্জনই নিঃসন্দেহে কাজের প্রতি আরও নিষ্ঠাবান হতে অনুপ্রেরণা জোগায়। 

গবেষণার বাইরে আপনি সৃজনশীল লেখায়ও সিদ্ধহস্ত। সেগুলো নিয়ে কি আপনার পরিকল্পনা জানাবেন?
সাবিহা হক: আপাতত এ বিষয়ে কিছুই জানাতে পারছি না। লেখা জমছে। কখনো ইচ্ছে হলে প্রকাশ করব। 

আপনার গবেষণা ছিল হেনরিক ইবসেন, এর বাইরে আগ্রহের বিষয় বিশেষভাবে আধুনিক নাটক, সাহিত্যে নারী- এ ছাড়া আপনি আন্তর্জাতিক ইবসেন কমিটির সদস্য, বিষয়গুলো অত্যন্ত আগ্রহ জাগানিয়া। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত বলবেন কি?
সাবিহা হক: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ইবসেনের ডলস হাউস পড়ি। মধ্যবিত্ত মুসলিম ঘরের নারী হিসেবে অনেক দেখা জীবনের সাথে ওই নাটকের মুখ্য চরিত্র নোরার জীবনকে মেলাতে পারি। পরে ইবসেনের আরও কিছু লেখা পড়ে আমি আগ্রহী হয়ে ইবসেনের নাটকের অনুবাদ ও অভিযোজন নিয়ে গবেষণা করেছি। সেখানে আমি বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উগ্র ধর্মান্ধতা ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি আধুনিক ও উত্তর আধুনিক সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। সাম্প্রতিক সময়ে Ibsen in the Decolonised South Asian Theatre শীর্ষক একটি বই (Routledge, 2024) বেরিয়েছে যেখানে আমার সাথে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপাল থেকে বেশ কয়েকজন গবেষক কাজ করেছেন। 

আমি আন্তর্জাতিক ইবসেন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই ২০১৮ সালে। সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে কাজ করেছি ও করছি। প্রথম দক্ষিণ এশীয় নারী সদস্য হিসেবে আমি অত্যন্ত আনন্দিত, এ দায়িত্ব পেয়ে আমি নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে চেষ্টা করেছি এটুকু বলতে পারি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //