মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের : সুলতানা কামাল

সুলতানা কামাল মানবাধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী, সমাজকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। তিনি মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এর পূর্বে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি হংকংয়ে ভিয়েতনামি ভাসমান লোকজনের ওপর জাতিসংঘের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি, নির্বাচন, গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম... 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আপনি কীভাবে দেখছেন?
আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য যে শর্তগুলো প্রযোজ্য তা এবারের নির্বাচনে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল। এ নির্বাচনে জনগণের জন্য নিজের পছন্দমতো প্রার্থী বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। প্রার্থীরা কে কিসের ভিত্তিতে আমাদের ভোট চাইছেন সেটা নিয়ে কারও কাছে যাননি। মোটামুটি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যাকে যে আসনের জন্য দাঁড়াতে বলেছেন বা অনুমতি দিয়েছেন তিনি তাই করেছেন। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে দেখানোর জন্য, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় রাখতে হবে এই দোহাই দিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে আহ্বান জানানো হয়। সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, যারা ভোট দিয়েছেন তারা নির্বিঘেœই ভোট দিতে পেরেছেন। কত শতাংশ ভোট পড়েছে তা নিয়েও সংশয় আছে। তাই এই নির্বাচন নিয়ম অনুযায়ী সুষ্ঠু হলেও প্রকৃতপক্ষে কতটা সঠিক হয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। 

বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিস্তারিত কথা বলেছি। এককথায় বলতে গেলে আমাদের সংবিধান, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের যে সমস্ত দলিল বা চুক্তি বাংলাদেশ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে মেনে চলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ, সে আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক।

দেশে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছে? কী ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়?
না পারছে না। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্বই হচ্ছে মানবাধিকারকে সম্মান করা, জনগণকে  মানবাধিকারের সুরক্ষা দেওয়া এবং মানবাধিকারের দাবিগুলো পূরণ করা। ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদেরকেই রাষ্ট্র বলে মনে করে এবং  মানবাধিকার সুরক্ষায়  রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার সমালোচনাকে সরকারের বিরুদ্ধাচার বলে চিহ্নিত করে রুষ্ট হয় এবং যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের প্রতি বৈরী, নিপীড়নমূলক আচরণ করে থাকে। যে সমস্ত সংগঠন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে তাদের নিবন্ধন দিতে চায় না, তাদের প্রকল্প ছাড় দিতে বা নবায়নে কালক্ষেপণ করে। যারা এ দেশের নাগরিক, যাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম অভিযোগ বা মামলা নেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ছাড়ের অজুহাতে এনজিও ব্যুরো তাদের সংগঠনগুলোকে কাজ করার অনুমতি দিতে অহেতুক দেরি করে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রায়ই মানবাধিকার কর্মীদের সম্পর্কে অসম্মানজনক মন্তব্য করে থাকেন। আর কর্মীদের হয়রানি বিরল নয়।

সীমান্তে হত্যা বন্ধের জন্য কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত? 
সীমান্ত হত্যার ব্যাপারটা দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। সাধারণত সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটে থাকে চোরাচালানি অথবা অবৈধ সীমান্ত পারাপার বন্ধের নামে। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণ ও তার  কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

গত কয়েক মাসে কারা হেফাজতে মৃত্যু ও পুলিশি নির্যাতন বেড়েছে। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে সরকার  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আপনার মতামত কী?
রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহার ঐতিহাসিকভাবে চলে এসেছে। কোনো সরকারই এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে বিগত কয়েক বছরে এই প্রবণতা অতি মাত্রায় বেড়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। 

সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতির জন্য কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সবচেয়ে আগে মানবাধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের যে দায় রয়েছে সেটার স্বীকৃতি প্রয়োজন। রাষ্ট্রকে সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তাদের স্বাধীন কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিকারের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা, মানবাধিকার কমিশনের সক্রিয় শক্তিশালী ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও আবশ্যক। একই সঙ্গে জনগণের মানবাধিকার সচেতনতা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে মানবাধিকার সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে।

গণতন্ত্রের সঙ্গে মানবাধিকার পরিস্থিতি কীভাবে সম্পর্কযুক্ত?
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণতন্ত্র জাতি, ধর্ম-বর্ণ, কে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদায় বিশ্বাস করে। নয়তো গণতন্ত্র হয় না। মানবাধিকারও সকল মানুষের  নিঃশর্তভাবে মানুষের সম-অধিকার ও সম-মর্যাদার কথা বলে। প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার গণতন্ত্রেরই  একটি শর্ত।  

এবারের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলো বেশ সক্রিয় ছিল। একদিকে চীন-ভারত-রাশিয়া বলয় বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
বাংলাদেশ পরাশক্তির খেলার পুতুল হয়ে গেলে এক রকম অবস্থা।  বিকল্প অবস্থায় রাজনীতিকরা, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের শক্তির ওপর ভর করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত শক্ত করে চলতে পারে তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হতে হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //