ভিসা নিষেধাজ্ঞা সরকার সামলাতে পারবে: তৌহিদ হোসেন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশি পরাশক্তিগুলোর সম্পর্ক কী হতে পারে, পশ্চিমা দেশগুলো কী ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে সে বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম আদিব...

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কীভাবে দেখেন? 
আমি মনে করি, যে রি-অ্যাকশন এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, সবই প্রত্যাশিত ছিল। কারণ ভারত, রাশিয়া, চীন সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করে আসছে অনেক দিন ধরে। সে অনুযায়ী নতুন সরকারকে তারা অভিনন্দন জানাবে খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। একইভাবে পাশ্চাত্য দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রথম থেকেই জোর দিয়েছিল অবাধ-নিরপেক্ষ এবং কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হোক। আমরা তো জানি তারা যেভাবে চাচ্ছিল সেটা হয়নি। সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন করে সরকার গঠন করছে। তারা যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে সেটা সহজ। কিন্তু সামনে কী দেখাবে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। তারা বলেছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি; সে ক্ষেত্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা ব্যাপারটা হলো, ব্যক্তির নাম ঘোষণা হয় না, যাকে দেওয়া হয় তাকে ও তার ফ্যামিলি সদস্যদের ভিসা দেওয়া হয় না। এটা যদি হয় সরকার এটা হ্যান্ডেল করতে পারবে। আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা তেমন কোনো ইঙ্গিত আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। যদি আসে তাহলে তো অবশ্যই অসুবিধা হবে দেশের জন্য। এমনিতে আগে তাদের লোকজন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বা লেবার ল বিষয়ে কথা বলেছিল। সেটা প্রয়োগ করতে চাওয়ার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। সামনে সেটা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে দুমাস, ছয় মাস। 

বাংলাদেশের নির্বাচনে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কীভাবে দেখেন?
পরিবেশটা যদি এমন হতো যে কারও তাৎপরতা দেখানোর প্রয়োজন নেই তাহলে ভালো হতো। আমাদের দেশের জন্য সেটা সম্মানজনক হতো। এজন্য বিদেশিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, দোষ আসলে আমাদের। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও নির্বাচন কীভাবে হবে, মানুষ কীভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার পাবে সে বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থা দাঁড় করানোর সদিচ্ছা নেই রাজনীতিবিদদের মধ্যে। একটা নির্দিষ্ট নির্বাচনী ব্যবস্থাটুকু আমরা করতে পারিনি এত বছরেও- যেখানে মানুষ কোনো ভয়-ভীতি ছাড়া খুশি মেজাজে ভোটকেন্দ্রে যাবে, ভোট দেবে, সন্ধ্যার সময় গোনা হবে, যাকে বেশি ভোট দিয়েছে সে বিজয় হিসেবে ঘোষিত হবে। 

আমাদের এখানে ৭০টা পার্টি আছে। বেশিরভাগের নাম মানুষ শোনেইনি, আসলে দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি- দুটোরই অন্তত ৩০% ভোট আছে। যতই প্রতিকূল পরিবেশ বা বদনাম হোক না কেন ৩০% মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, ৩০% মানুষ বিএনপিকেও ভোট দেয়। আর বাকি যে ৪০% আমার মতো মানুষ, যাদের কমিটমেন্ট নেই কোনো পলিটিক্যাল পার্টির প্রতি- এরাই তো ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করে। তারা যখন যেটাকে ভালো মনে করে সেটার পক্ষে অথবা যেটাকে খারাপ মনে করে সেটার বিপক্ষে ভোটের বাক্সে রায় দেয়। এই সুযোগটা বাংলাদেশের মানুষ চারবার পেয়েছে। এ ছাড়া সবগুলো নির্বাচনে কম বেশি জালিয়াতি হয়েছে। ওই চারটা নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পেরেছে কোনো ধরনের চাপ ছাড়া। এবং তাদের ভোটের ভিত্তিতেই রেজাল্ট নির্ধারণ হয়েছে। এখন তো ম্যানেজ নির্বাচন আছে। ২০১৪, ২০১৮ পলিসি একটু চেঞ্জ হয়েছে। কিন্তু বিষয় একটাই, কীভাবে ক্ষমতায় থাকবে এটাকে পাকাপোক্ত করা হয়েছে। এ কারণে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। এই সুযোগ না থাকত, তাহলেই আমরা খুশি হতাম।

ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে কী বলবেন? 
এ ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার যে, বিজেপি কিংবা কংগ্রেস ভারতের যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, দুটোর জন্যই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ থাকাটা সুবিধাজনক। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ সম্পর্ক আছে। নিরাপত্তা নিয়ে তাদের বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ ভালোভাবে ট্রিট করেছে। ওই পয়েন্ট অব ভিউ থেকে তাদের আর চাওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয় হলো ভারতের কাছে অনেক কিছু চাওয়ার ছিল। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক সেখানে ভারত অনেক সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের যা কিছু চাওয়ার ছিল তা পাইনি গত ১৫ বছরে। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, ভারতকে বেশ কিছু সুবিধা আমি দিয়েছি, যা চিরদিন তারা মনে রাখবে। কিন্তু তারা মনে রাখেনি। আমাদের যে চাওয়া পাওয়া ছিল সেগুলো নিয়ে সরকার তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। এই পরিস্থিতিতে ভারতের আর কী চাওয়ার থাকতে পারে! কাজেই বর্তমান যে ব্যবস্থা সেটা কন্টিনিউ করুক এটাই তাদের চাওয়া। ২০১৮তে কতটুকু হস্তক্ষেপ করেছে, সেটা শিওর না হলেও ২০১৪তে ‘আওয়ামী লীগ জিতে আসুক’ তাদের এই চাওয়াটা স্পষ্টতই বোঝা গেছে। আমাদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ২০১৪তে যদি আওয়ামী লীগ হেরে যেত, ২০১৮তে আবার ফিরে আসত এটাও শিওর। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা অনেক বেশি প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেটা পূরণ করার ইচ্ছাও তাদের নেই, সামর্থ্যও নেই। কাজেই তখন মানুষ অসন্তুষ্ট হয়ে বিরুদ্ধে ভোট দেয়। ভারত সেটা চায়নি। কারণ ২০১৪তে তাদের সব চাওয়া-পাওয়া শেষ হয়নি, কাজেই তারা চেয়েছিল আওয়ামী লীগ যাতে জয়ী হয়, তাদের সুবিধা হয়।

সরকার কেন বাংলাদেশের চাওয়াগুলো আদায় করতে পারেনি? 
আজকালকার দুনিয়ায় কিছুই গোপন থাকে না। ২০১৪ সালে ভারত জানে, সরকারের জনগণের ম্যান্ডেট নেই। ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। যখনই কোনো সরকারের ম্যান্ডেট থাকে না তারা এক ধরনের দুর্বলতায় ভোগে। এবং তাদেরকে বহিঃশক্তি যখন সমর্থন করে, তারা স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। কারণ সরকারের সেই মোরাল স্ট্রেংথ থাকে না যে চাপ সৃষ্টি করবে- আমাকে এটা দাও ওটা দাও।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //