৮৮তম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধা

সৃষ্টিশীল লেখা রসোত্তীর্ণ কালোত্তীর্ণ এবং স্থানোত্তীর্ণ হতে হয়: সৈয়দ শামসুল হক

ভাষামাধ্যমের প্রায় প্রতিটি শাখায় সাহিত্যজীবনের শুরু থেকে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন আঙ্গিকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার হিসেবে সমকালে এতটা সাফল্যমণ্ডিত নাম আর খুব একটা পাওয়া যায় না। এর বাইরে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় কাহিনিকার, গীতিকার হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। তবে বলতেন, কবি না হলে সাহিত্যের অন্য কোনো শাখাতে তিনি সফল হতে পারতেন না। ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন---ইসমাইল সাদী 

দুই খন্ডে প্রকাশিত আপনার হৎকলমের টানে পড়ার পর আমার মনে হয়েছে কত বড় মাপের লেখক আপনি 

এই বড় মাপটা কিন্তু খুব একটা অস্পষ্ট কথা। অস্পষ্ট কথা আমি বলছি তোমায়। অস্পষ্ট কথা, কারণ মানুষকে ওইভাবে মাপা যায় না। মানুষকে তার কাজ দিয়ে মাপতে হয়। অথবা তার চিন্তাভাবনা দিয়ে মাপতে হয়। আর সেই মাপটা বড়-ছোট হিসেবে হবে না। সেটা বরং গভীরতার দিক থেকে মাপা যেতে পারে। বলা যেতে পারে যে তিনি [কোনো একজন] অনেক গভীরে, অনেক কিছু সন্ধান করেছেন। চেষ্টা করেছেন বা কেউ খুবই উপরিতলে কাজ করেন-----এটা হওয়া উচিত। আর দ্বিতীয় কথা যে হৎকলমের টানে যদি পড়ে থাকো অন্তত একটা জিনিস নিশ্চয় চোখে পড়েছে যে অনবরত ছাত্রের মতো-----তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে নয়; কিন্তু কোনো কিছু জানবার আগ্রহ এবং চেষ্টা, সেই অর্থে ছাত্র। ছাত্রের মতো একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। পড়তে হয়, জানতে হয়, বুঝতে হয়, মেলাতে হয়। এবং সম্ভব হলে, সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না, নিজের একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, নিজস্ব। তারপরও যদি লেখার প্রবণতা থাকে বা ইচ্ছে থাকে, তাহলে লেখার একটা নিজস্বতা আনবার চেষ্টা করতে হয়। তো এগুলো এক দিনে হয় না, আকাশ থেকে আসে না। প্রেরণার একটা ব্যাপার আছেই; কিন্তু প্রেরণাটাকে উসকাতে হয়।

বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, লেখার গভীরতা-----সেই গভীরতাটা আনার জন্য অনেক বেশি পড়াশোনা যে করতে হয়, তার একটা ছাপ অবশ্যই লেখার মধ্যে পড়ে

যা-ই হোক, তুমি কি আমার এই বইটা পড়েছ।-----মার্জিনে মন্তব্য। আছে তোমার কাছে?

আছে। পড়েছি

আমার কবিতার ওপর কাজ করলে কিছু সংকেত পাবে মার্জিনে মন্তব্য বইটিতে কবিতার কিমিয়া অধ্যায় আছে।

প্রথমটা সার্বিকভাবে। দ্বিতীয়টা গল্পের কলকব্জা, তৃতীয়টা কবিতার কিমিয়া

কবিতার অংশে আমার নিজের কবিতা দু-একটা নিয়ে কিছু কথা বলবার চেষ্টা করেছি। শেষ দিকে কিছু ছাঁকা কথা আছে কবিতা সম্পর্কে। আমি যেমন যতটুকু বুঝেছি, বিভিন্ন সময়ে...। ওইভাবে ওখানে পাবে। 

আপনার কবিতা সংগ্রহ প্রথম খণ্ডে আপনি লিখেছেন, সাল-তারিখ উল্লেখ করার যে বিষয়টা ওসব ছাত্রের কাজ; গবেষকের বিষয়। আসলে কোন কাব্যের কোন কবিতা, এটা চিহ্নিত করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। আমি লাইব্রেরিতে কাজ করে সেগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার, রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রন্থাগার ঘুরে ঘুরে সেগুলো বিভাজন করতে পেরেছি

আমি তোমাকে বলি, আমি এই জিনিসটা একেবারেই পছন্দ করি না। বই একটা বেরুলো ঠিক আছে; কিন্তু একজন কবির কবিতা সমগ্র তার সব লেখা নিয়ে এবং সেখানে তা অনাবশ্যক বলে আমি মনে করি। কোন বইতে এটা আছে, কোন বইটা কখন বেরিয়েছে, এর চেয়েও বড় কথা ঃযব ঃড়ঃধষরঃু ড়ভ ঢ়ড়বঃৎু-----সামগ্রিক একটা রূপ আছে কবিতার। আমি সেদিকে তোমাদের মনোযোগটা চেয়েছি। তোমরা যাতে একজন কবির সমস্ত লেখাকে একবারে দেখতে পাও। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে বইয়ে যা আছে, তা মোটামুটি ধারাবাহিক, আমি যখন শুরু করেছি। এর প্রথম কবিতা ১৯৫৩ সালে। প্রথম খণ্ডের প্রথম কবিতা ১৯৫৩ সালের বোধ হয়।

বুনোবৃষ্টি গান?

হ্যাঁ, এবং ৫৩ সাল থেকে এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের প্রকাশ যে পর্যন্ত মোটামুটি সময়ানুযায়ী, তা আছে। ধাপে ধাপে তা এগিয়ে গেছে। এভাবে বিচার করাটা ভালো। আমার মনে হয় বইয়ের চেয়েও সময়ের দিকটা বিচার করা ভালো।

সময়টা ধরতে গেলে তো ওইটাও দরকার, যে বইটা কবে বেরুলো। সময়টা যেহেতু কাব্যে বা সাহিত্যকর্মে ধরা পড়ে। তাহলে ওইটাও আমাদের জানা দরকার।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই...। আমার কবিতা সংগ্রহের নতুন সংস্করণ যেটা বেরোচ্ছে, সেখানে কোনো কোনো কবিতায়; কিছু কিছু জায়গায় আমি পুরনো খাতা দেখে তারিখ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এজন্য, যাতে তোমাদের কাজ একটু সহজ হয়। আমি এটা খুব বড় প্রশ্ন মনে করি না; কবিতার ভেতরেই তার সাক্ষ্য আছে। এই যে দ্যাখো, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তারিখ তো তার প্রথম থেকে শেষ অবধি আছে। তারপরও এই তারিখ কিন্তু আমাদের খুব একটা কিছু করে না। এই তারিখ আমি মনে করি না যে আমাদের খুব একটা কিছু করে। বরং যেমন ধরো তার সংকলন সঞ্চয়িতার      কথাও যদি ধরি, তাহলে ঃযব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ধ সরহফ, ধ ঢ়ড়বঃরপ সরহফ সেটি আমাদের কাছে ধরা পড়ে। এবং সেভাবেই দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। একটা কথা আমি বলি, আমার কবিতাকে আমি তুলনা করি ছবি আঁকার সঙ্গে। ছবি যারা আঁকেন তারা কখনো তেলরঙে আঁকেন, জল রঙে আঁকেন, পেন্সিল স্কেচে করেন, কালি-কলমে স্কেচ করেন তো। ঠিক তেমনি কবিতাতেও সে রকম আমি বিভিন্ন ধরনের কবিতা লিখি। সেটা আমার বলার কথা তার ওজন, তার বিষয়, বিভাব-----এটাকে ধরার জন্য কখনো তেলরঙের মতো জমাট ভারী, কখনো জলরঙের মতো বিষয় বুঝে সেটাতে স্বচ্ছতা আনতে হয়েছে। কখনো পেন্সিল স্কেচের মতো একটা রূপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি। 

আমি যেটা বলছিলাম, এবারের সংস্করণে কি কাব্যগ্রন্থ অনুযায়ী কবিতাগুলোর ভাগ পাব?

না, না। তবে কিছু তারিখ পাবে। মাঝে মাঝে। কোনো কোনো কবিতায়। তাতে অন্তত স্টেপিংটা বোঝা যাবে। কিছু তারিখ হয়তো ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৮ অথবা তার কাছাকাছি। তাতে মোটামুটি বুঝতে পারবে। তবে এটা একাডেমিসিয়ানরা খুব পছন্দ করেন। আমি মনে করি শুধু কবিতা না, কোনো লেখার বই, এভাবে বিচার করা ঠিক না। বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে তো নয়ই-----যেখানে সংকেত, ইঙ্গিত এগুলো খুব বড় জায়গা নিয়ে থাকে। সংকেত, ইঙ্গিত, চিত্রকল্পের মাধ্যমে জীবন পায় যখন, তখন সময়কে ছাড়িয়ে যায়। একটা কথা তোমায় বলি, দ্যাখো যে কোনো সৃষ্টিশীল লেখা শুধু রসোত্তীর্ণ হলে চলে না, তাকে কালোত্তীর্ণ হতে হয় এবং স্থানোত্তীর্ণ হতে হয়। স্থান, কাল, রস-----এই তিনটের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। 

যখন আপনি থাকবেন না, তখন একদা এক রাজ্যের কবি কী বলতে চেয়েছেন, তারপর তার উত্তরণটা কী হচ্ছে বা প্রবণতাটা পরিবর্তন হচ্ছে কি না, এই বিষয়গুলোর জন্য কি কবিতা সংগ্রহে আলাদা আলাদা কাব্যের উল্লেখ দরকার না?

না।

আপনার উন্মোচনে আপনি নিজেও বলেছেন একদা এক রাজ্যে কাব্যে এবং বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালায় এসে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে-----এই বিষয়গুলো ধরার জন্য কি আমাদের আলাদা আলাদা কাব্যের পরিচয় থাকার দরকার না?

এই যে, কাব্য (কবিতা সংগ্রহ দেখিয়ে)। এই সংকলনটাই একটা কাব্য।

আপনি যখন থাকবেন না, তখন এটাকেই কাব্য মনে করতে হবে?

এটাকেই মনে করতে হবে কাব্য। কবে কী লেখা হয়েছে...তোমরা আমাকে বলো যে, ঝযধশবংঢ়বধৎব-এর পুরো রচনাবলি-----সেটা ১৬০৮-এ লেখা, না ১৬০২-এ লেখা, না ১৫৯৬-এ লেখা তাতে কিছুই আসে যায় না। কেউ এটা নিয়ে ভাবে না। শুধু কিছু যখন পৎরঃরপরংস থাকে, তখন সেইখানে এসে যায়। কিন্তু আমার মনে হয় এটার একটা পরিবর্তন হওয়া দরকার। এভাবে নয়। এটা হচ্ছে একাডেমিক পড়াশোনার সুবিধার জন্য। কিন্তু when I am drinking a poetry, when I am reading a poetry, when I am considering a poetry, the whole body...শুধু বিষয় কেন দেখবে, আমার বাক্যবন্ধন, আমার ছন্দ ব্যবহার, এগুলো তোমাকে দেখতে হবে। আমার সমসাময়িক যদি শামসুর রাহমানের কথা বলি-----শামসুর রাহমান ব্যাপকভাবে ইয়োরোপীয় ইমেজ ব্যবহার করেছেন।

আপনি স্বকীয়তার ক্ষেত্রে নিজস্ব জাতি, সংস্কৃতি, পরিচয় এগুলোকে বেশি ব্যবহার করেছেন

একেবারে নেই, তা নয়। আমার বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালায় দু-একটা পাবে। কিন্তু সেটা কোনো প্রবল চিহ্নিত ব্যাপার না। আমি এটাকে অ্যাভয়েড করি। এগুলোকে আবিষ্কার করাটা আমার মনে হয়, নিবিড়ভাবে যারা পাঠ করতে চান তাদের কাজ। তাদের এসব ভেবে দেখা উচিত। ছন্দের দিক থেকে, ভাষার দিক থেকে, শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে আমার প্রায় অর্ধেকটা কবিতা গদ্যে লেখা; রবীন্দ্রনাথ যেটাকে ভাবছন্দ বলেছেন। সেখানে দেখবে...কবিতার কাজটা কী। 

একটা প্রশ্ন করব? পাশের দশকে যে ক্ষেত্র থেকে আপনারা শুরু করেছিলেন, যে অবস্থাটা ছিল-----তারপর ষাট, সত্তরের যে সংকট বাংলাদেশ পেরিয়ে এসেছে। আপনি কি মনে করেন বর্তমান সময়টা তার চেয়ে কম কিংবা বেশি। সংকটটা কেমন?

সংকট সব সময় তুঙ্গে থাকে। এইটা ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ. লোকের বোঝার মাত্রাগত পার্থক্য। ৫২ সালে যে সংকট ছিল আমাদের জাতির জীবনে পাশের দশকে-----সংকট সংকটই আছে। তখন একরকম চেহারা ছিল, এখন একরকম চেহারা। তখন তিনটে লোক গুলি খেয়ে মারা গেলে একটা বিপুল ব্যাপার ছিল। আজকে তিন হাজার মেরে ফেললেও কিছু হচ্ছে না। কিন্তু সংকটটা এক। এর শুধু মাত্রা পাল্টাচ্ছে।

আমি মনে করি না যে, তোমাদের শ্রদ্ধেয় অনেকে বলে থাকেন যে এ রকম সংকটে জাতি আর কখনো পড়েনি। আমার বাপের জীবনে, পিতামহের জীবনে, তারও আগে সংকট ছিল না কি? ছিল। মনে করো, সিপাহী বিদ্রোহের সময় ১৮৫৭ সালে তখন তার ভেতরে যারা পড়েছিল-----তারা কি ভেবেছিল-----যে এই রকম সংকটের ভেতরে আর কখনো পড়িনি। আমরা যখন ৪৬-এর দাঙ্গার কথা বলি...শুধু ব্যাপকতার মাত্রাটা ভিন্ন। প্রসঙ্গটা পাল্টাচ্ছে। এটা সাধারণ মানুষের কাছে-----এটা তখনকার মানুষের কাছে যে পরিমাণ সত্য, এখনকার মানুষের কাছেও সে একই পরিমাণ সংকট। 

(সংক্ষেপিত)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //