প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেশকে সংকটে ফেলবে: বদিউল আলম মজুমদার

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ও অন্যান্য বিরোধী জোটভুক্ত ৬০-এর অধিক নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন করছে। আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোও নির্বাচন নিয়ে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট। ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেছেন আরিফুল ইসলাম আদীব... 

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার মতামত কী? 
এটা এক ধরনের ভোটের খেলা চলছে। যেমন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন খেলা হবে, সে রকম কিছু। নির্বাচনের সংজ্ঞা অনুযায়ী অ্যাক্ট অব চয়েজ অর্থাৎ নির্বাচনে বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকতে হয়, আরও সঠিকভাবে বললে যথাযথ বিকল্প থাকতে হয়। ভোটের পরিবেশ সমতল থাকে। এখন হচ্ছে সমঝোতা। আমরা পছন্দ করি আর না করি, আমাদের এখানে দুটো ব্র্যান্ড। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। যখন বিএনপি ভোটে থাকে না তখন আওয়ামী লীগ প্রায় সবগুলো আসনেই জিতবে এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। ফলে তারা আসন ছেড়ে দিয়ে বিরোধী দল তৈরি করছে। নিবাচনে অনিশ্চয়তা থাকতে হয়। ছোটবেলায় রেডিওতে নির্বাচনের ফল ঘোষণা শুনতাম। ঘোষণার আগেও কেউ জানত না কে জিতবে। আর এখন সব নিশ্চিত। নির্বাচন কমিশন গঠনই প্রশ্নবিদ্ধ, ফলে তাদের তফসিল এবং নির্বাচনী সকল কার্যক্রম নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এর পরিণতি অশুভ। এই নির্বাচনের জন্য দেশ গুরুতর সংকটে পড়বে। আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি। 

নির্বাচন কমিশন ও এদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এর ব্যাখ্যা কী? 
হাবিবুল আউয়াল কমিশন গঠিত হয়েছে গুরুতর আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। এর কোনো আইনি বৈধতা নেই। সংবিধানে বলা ছিল একটা নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন করতে হবে।  আমরা সুজন থেকে ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ‘নির্বাচন কমিশন আইন’ খসড়া আইনমন্ত্রীকে দিয়েছিলাম। সেটা তারা গ্রহণ করেননি, আইনমন্ত্রী সময় নেই বলে নাকচ করে দেন। পরে জনমত গঠন হলে তারাই একটা নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন প্রণয়ন করে। পূর্বের  আইনে একটি ইমডেমনিটি ক্লজ যুক্ত করে দিয়েছে। এটা একটা নিকৃষ্ট আইন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে যে আইন, ওখানে একটা বিধান আছে। ধারা ৪ মোতাবেক বলা আছে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠন নাম প্রস্তাব করবে। কিন্তু যখন অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছিল তখন সেটি উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। সুতরাং আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। নুরুল হুদা কমিশনের সময়ে শুধু রাজনৈতিক দল নাম প্রস্তাব করতে পারত। এবার যে কোনো ব্যক্তি চাইলে নাম প্রস্তাব করতে পারত এবং চাইলে নিজের নামও প্রস্তাব করতে পারত। হাবিবুল আউয়ালের নাম আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রস্তাব করেছিল। তিনি আমার নামও প্রস্তাব করেছিলেন, আমি ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছি আমি আগ্রহী নই। ওনার মতো এ রকম বহু লোক নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম প্রস্তাব করেছে। জাফর ভাই বা যারা নাম প্রস্তাব করেছিল কেউই নাম প্রস্তাবের জন্য আইনগত বৈধ ছিলেন না। অথচ তাদের নাম প্রস্তাবের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। যারা বৈধ নয়, তাদের প্রস্তাবেই যদি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় তাহলে তাদের বৈধতা নিয়েও তো প্রশ্ন ওঠেই। আমি কেবিনেট ডিভিশন ও তথ্য কমিশনে তথ্য চেয়েছিলাম যে কে কার নাম প্রস্তাব করেছে, তারা বলেছে এতে ব্যক্তি গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হবে। আমরা আদালতে গেলে তিন দিন হিয়ারিং করে এরপর রুল জারি করে। মূলকথা হলো যে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, সব কার্যক্রম আইনগত প্রশ্নবিদ্ধ, এই যে তফসিল ঘোষণা করেছে, ভোটাভুটি করছে সবই প্রশ্নবিদ্ধ। ভবিষ্যতে এগুলো গুরুতর সাংবিধানিক সংকট তৈরি করবে। 

বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ বলছে এটা অসাংবিধানিক। আপনার বক্তব্য কী?
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক, এটার কোনো লেজিটেমিসিও নেই, লিগ্যালিটিও নেই। লেজিটেমিসি হলো উইল অব পিপল, সংশোধনী বিষয়ে কাউকেই জিজ্ঞেস করা হয়নি, ফলে এটার লেজিটেমিসি নেই। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক, এর অনেকগুলো কারণ আছে। আদালত জালিয়াতি করেছে, গণভোট করা হয়নি এবং তখনকার সময়ে গঠিত ১৫ সদস্যের সংসদীয় কমিটির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কথায় পরিবর্তন করা। 

আদালত জালিয়াতি হলো  বিচারপতি খায়রুল হক ১০ মে, ২০১১ সালে চার বাক্যের একটি রায় দিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন ত্রয়োদশ সংশোধনী মানে ভবিষ্যতের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক। পরের বাক্যেই বলেছিলেন, পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় হতে পারে কতকগুলো যুক্তির ভিত্তিতে, সেগুলো হলো ক্রান্তিকালীন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল এই রায়ের সঙ্গে একটি ক্লজ যুক্ত করে যে পরবর্তী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, যদি সংসদ অনুমোদন করে। এই আইন সেই নির্দেশে ছিল না। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। 

গণভোটের বিষয়টি হলো, সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সীমিত আকারে গণভোট যুক্ত করা হয়েছিল। ৪টি ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করতে হলে গণভোট প্রয়োজন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সময়ে গণভোট হয়নি। সংসদীয় কমিটির বিষয়টি হলো, বেগম সাজেদা চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি করা হয়েছিল। তারা ১০৪ বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন, মতামত নিয়েছিলেন। সেখানে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক  প্রধান বিচারপতি তিনজন, আইন বিশেষজ্ঞ, পত্রিকার সম্পাদকগণ, এমনকি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একটি প্রতিনিধি দলসহ উপস্থিত ছিলেন। সেই সংলাপে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কথা বলেননি,  সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আলাপ আলোচনা করে খায়রুল হকের রায়ের ১৯ দিন পর (২৯ মে, ২০১১) তারা একটি সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব বা সুপারিশ করেছে যে “তিন মাসের সময় বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখেই সংবিধান সংশোধন।”  তার পরের দিন সংসদীয় কমিটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং সবকিছু পাল্টে যায়। একটা সংসদীয় বিশেষ কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশ নির্বাহী বিভাগের প্রধান প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দেন যা অসাংবিধানিক। 

এরকম একতরফা নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে? 
একতরফা নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্র, সুশাসন ও রাষ্ট্রে কয়েকটি গভীর প্রভাব ফেলবে। বহুদলীয় গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে একদলীয় শাসন কায়েম হবে, আমাদের  নজরদারি ও দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে পড়বে, সুশাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে পড়বে, ফলে প্রশাসন দলীয় ক্যাডারের ন্যায় আচরণ করবে। রাষ্ট্রের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বেড়ে যাবে। 

গণতন্ত্র মানেই বহুদলীয় গণতন্ত্র, যেখানে জনগণ বিনা দ্বিধায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেন। বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচনে অধিকাংশ জনগণ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।

একটি রাষ্ট্রে মোটাদাগে দুই ধরনের দায়বদ্ধতা বিরাজমান, নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা ও সমান্তরাল দায়বদ্ধতা। নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয় ভোটের মাধ্যমে; যা থেকে ইতোমধ্যে জনগণ বঞ্চিত হয়েছে। সমান্তরাল দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয় কতকগুলো সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। জাতীয় সংসদ ও উচ্চ আদালত এমন দুটি প্রতিষ্ঠান। কতকগুলো সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আদালতের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো ভেঙে পড়লে সরকার দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়, যার লক্ষণ দৃশ্যমান একতরফা নির্বাচন আরও ভয়াবহ করে তুলবে। 

শক্তিশালী নাগরিক সমাজ কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্ত। এটি অন্য সব প্রতিষ্ঠানের ওপরও নজরদারি করে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে নানা কৌশলে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //