ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে কঙ্গোর নির্বাচন কমিশন প্রধানের সাক্ষাৎকার

বুধবার (১৯ ডিসেম্বর) কঙ্গোর লক্ষ লক্ষ নাগরিক ২০২৩ সালে তাদের বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। এর আগে ১৯৬০ সালের জুনে বেলজিয়াম থেকে স্বাধীনতা লাভের পর কঙ্গোর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে এটিকে আখ্যা দেয়া হতে পারে। বেসামরিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশটিতে। তবে নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে সকল মহলে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিলে, সশস্ত্র গোষ্ঠীর কারণে নিরাপত্তাহীনতার জন্য কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দেয়। এসময় কয়েক হাজার মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। 

নির্বাচন ইস্যুতে আল জাজিরা কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায় নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে স্বাধীন জাতীয় নির্বাচন কমিশন প্রধান ডেনিস কাদিমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছে। 

সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো: 

বুধবারের নির্বাচনের জন্য আপনাদের প্রস্তুতি কেমন? 

কাদিমা: প্রস্তুতি ভালই চলছে। অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আমরা। প্রথম কারণ, আমরা নিয়োগ পেয়েছি অনেক দেরিতে। আমাদের এই টিমকে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ২৮ মাস সময় লেগেছে যেটি বেশ কঠিন আমাদের জন্য। তবে একটি নির্বাচন করতে সকল প্রয়োজনীয় কাজ করতে আমরা সক্ষম। ভোটার রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে সব কিছু সম্পন্নের পর আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি।  

তবে সবকিছুই অল্প সময়ের মধ্যে করতে হচ্ছে যেহেতু নির্বাচনের শিডিউল খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে করা হয়েছে। আমরা একটি দিনও অবহেলা করিনি কাজ সম্পন্ন করতে। এর ব্যত্যয় হলে বিপদের মাঝে পড়তে হতো আমাদের। তবে বেশ কিছু অঞ্চল রয়েছে যেখানে আমাদের পৌছানো কষ্টসাধ্য। কিছু প্রদেশে অসংখ্য নদী-নালা, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পৌছানো সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে আমি সরকারকে যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার দিতে অনুরোধ করেছিলাম। পাঁচ বছর আগেও নির্বাচনে একই সমস্যায় পড়েছিলাম আমরা। 

আপনি কি মনে করেন যে এই ধরনের নির্বাচন পরিচালনায় কমিশন নিশ্চিতভাবে প্রস্তুত? 

কাদিমা: দেখুন, নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে দীর্ঘ সময় চলে গেছে। এটা যে কোনো দেশকে পঙ্গু করে তুলতে পারে। তাই সরল পথেই কাজ চলছে। এছাড়া বর্ষার সময়ে আমরা নির্বাচন করতে পারব না। সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ জুলাইয়ের শুষ্ক মৌসুমে নির্বাচন করতে বাধ্য করত। রাস্তাঘাট ভাল না থাকায় আমাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্বাচনী সামগ্রী বিমানযোগে পৌঁছে দিতে হচ্ছে। তবে আমাদের উন্নত অবকাঠামো খুব জরুরি। এর বাইরে অর্থের যোগানও আসছে ধীর গতিতে। ফলে সমুদ্রপথে নির্বাচনী সামগ্রী পৌঁছাতেও লাগছে দীর্ঘ সময়। 

এ মুহুর্তে বিমানে করেই সবকিছু পৌঁছে দেয়া হচ্ছে যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। 

এত সীমাবদ্ধতার পরও আপনি কী মনে করেন একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে আপনারা সক্ষম? 

কাদিমা: আপনি যদি আমাকে ১০০ ডলার দিন তবে ভাল একটি নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু যদি ৫০ ডলার  দিন তাহলেও নির্বাচন করা সম্ভব। আমাদের সাধ্যমতে সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আগামী নির্বাচন খুব ভালভাবে করতে আমাদের মূল লক্ষ্য রেখেছি। আমাদের দুর্বলতাগুলো দেখানো উচিত নয়। আমরা ভাল করতে পারি। 

কঙ্গোর কিছু জনগণ এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে অভিযোগ করে আসছেন…

কাদিমা: আমি মনে করি তারা এটা ঠিক বলছেন না। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা  এখনও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ তারা ভাবতেও পারেনি এত অল্প সময়ে নির্বাচন করতে পারব। তারা কখনও এটাও বলবে না যে হাজারও সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমরা এত বড় কাজটি করছি। তাদের মধ্যে বেসামরিক গোষ্ঠীও রয়েছে। দেশের ক্যাথোলিক চার্চেরও নিজস্ব প্রার্থী রয়েছে। 

আসলে যা হচ্ছে সবই রাজনৈতিক খেলা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমাদেরকে মূলায়নের সময় এসেছে, যদি জনগণ ২০১১, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালের দিকে ফিরে তাকায়। আমাদের পুরো প্রক্রিয়াটি সবার কাছে উন্মুক্ত। আমরা অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছি। একসময় যারা নির্বাসিত ছিলেন, নির্বাচনে মনোয়ন নিতে পারতেন না তারাও আজ প্রার্থী। 

২০১৮ সালে যেখানে ৩৫০০০ প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন সেখানে এ বছরে প্রার্থী সংখ্যা ১ লাখ। নির্বাচনে দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণ বিষয়ে আইনি কাঠামোর অধীনে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ জানিয়েছি। যাতে করে প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা থাকে। 

আমরাই জনগণকে জানিয়েছিলেম ৩৩ লাখ লোকের নাম ভোটার তালিকায় থাকা উচিত নয়  কারণ তারা একবার নিবন্ধন করেছেন। আবার কারও অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেও তালিকায় নাম ছিল। আপনি দেখবেন যে সবসময় সব সমালোচনা সত্যি হয় না।

নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আপনাকে দেখতে হবে কমিশন বৈধ নাকি অবৈধতার সঙ্গে কাজ করছে। যদি সমস্যা দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে এ প্রক্রিয়া কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় হয়ত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আপনি যদি আমাদের অতীতের সব সমস্যার দিকে তাকান, দেখবেন প্রতিটা সমস্যাই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেছি। 

কিছু রাজনীতিবিদ নির্বাচন স্থগিতের জন্য সাংবিধানিক আদালতের কাছে আবেদন করেছিলেন, তবে আদালত তা নাকচ করে দেন। এই কয়েক দিনে সবকিছু ঠিকঠাক না থাকলে আপনি কোন বিষয়টি বিবেচনা করবেন?

কাদিমা: আমরা নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল চাই না। কেননা একটি নির্ধারিত রুটিন ওয়ার্কের মধ্যদিয়ে সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সমস্যা সবসময় থাকবে। যদি আমাদের হাতে ছয় মাস (৬) সময়ও থাকত তাও সমস্যার সমাধান হতো না। তাদের কাছে সমস্যা থাকবেই, তবে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। 

আমি এটা বলছি না যে, প্রক্রিয়াটি নিয়ে সব অস্বীকার করব। আমরা সময়সীমা নিয়ে বলছি যেহেতু সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। আমরা যেটুকু সময় পেয়েছি তা খুবই সংক্ষিপ্ত প্রস্তুতির জন্য। তবে সর্বোচ্চটা করেছি সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে। 

যারা আজ নির্বাচন বাতিলের কথা বলছেন, তাদের কথামতে তা করা হলে ফের তারাই বলবেন- আহা, কেন বাতিল করলেন নির্বাচন। আবার সমস্যাও তৈরি করবেন তারা।  

কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে ৬৫ লাখ লোক বাস্তচ্যুত হয়েছেন। তাদের অনেকেই ঘরে ফিরতে পারেননি, ভোটার হিসেবেও নিবন্ধিত হতে পারেননি। এ বিষয়ে কী বলবেন? 

কাদিমা: আইন অনুযায়ী দুই রকমের বাস্তচ্যুত রয়েছে। প্রথম গ্রুপটি তারা যারা তাদের আত্মীয়দের কাছে গিয়েছেন। ফলে তাদেরকে ওই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে নিবন্ধিত করে নিয়েছি। কিন্তু যারা আইডিপি শিবিরে বাস করছেন তাদের নিবন্ধন যে এলাকা থেকে তারা এসেছেন সেখানেই করা আছে। 

তাই আপাতত শিবিরে অস্থায়ীভাবে বাস করলেও তাদের বাড়ির এলাকা থেকেও ভোটে অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় আবারও তাদেরকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা এটাও জানিনা তারা কী আবারও শিবিরে ফেরত গেছে কী না। তাদেরকে চিহ্নিত করা আমাদের পক্ষে কঠিন। তবে পরিস্থির কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটদানে অংশ নিতে না পারলেও আশা রাখছি, জাতীয় ও স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারবেন। 

নির্বাচন কমিশন প্রধান হিসেবে আপনি সকলের প্রতি কীভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন?

কাদিমা: প্রত্যেকেই কিছু না কিছুর জন্য আপনার ওপর দোষ চাপাতে পারেন। অনেক দায়িত্ব ও চাপের মধ্যে আমরা রয়েছি। ১ লাখ প্রার্থীর মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। 

অন্যরা আমাদের ঘৃণা করবে কারণ তারা এ কাজটি করতে সক্ষম ছিলেন না। কেউ কখনই পরাজয় মেনে নেয় না। আর এটাই বাস্তবতা। তবে এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আমাদের নির্বাচনকে একটি রুটিন প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে হবে যাতে করে রাজনীতিবিদরা উপলব্ধি করতে পারেন যে আমিও হেরে যেতে পারি। আর এই পাঁচ বছরে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় থেকে ভুলগুলো সংশোধনের সুযোগ কাজে লাগানো উচিত, যেন আবারও জয়লাভ করতে পারেন ভবিষ্যতে। আমাদের মাঝে এ অভ্যাসটি যত বেশি গড়ে ওঠবে  তত বেশি মানুষ জাতীয় গণতান্ত্রিক নীতির ওপর আস্থাশীল হওয়া শুরু করবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //