যা দেখি, যা আমার মনে ঢুকে পড়ে সেটাই আঁকি: শহিদ কবির

বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা সব সময় তাকে আন্দোলিত করে। এ দেশের মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ও জীবনের নানা অনুষঙ্গ তার শিল্পকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি শিল্পী শহিদ কবির।

সত্তরের দশকের শক্তিমান শিল্পী, বাস্তবধারার বিশেষ রূপকার ও আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গন থেকে আহরিত বোধে ঋদ্ধ এ শিল্পী। আশির দশকের শুরুতেই উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান স্পেনে। সেখানেই তিনি তার সৃজন উৎকর্ষ ও শক্তিমত্তা দিয়ে শিল্পানুরাগীদের মধ্যে উন্মোচন করেন চিত্রকলার এক নবীন মাত্রা। বাস্তবধারা আর বিমূর্ত-দুই ক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। মাটি থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে চিত্রকর্ম করেন। চিত্রকর্মে কোনো ছলচাতুরীর জায়গা নেই। একজন শিল্পী হতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতে হয়। তাহলেই একজন পরিপূর্ণ শিল্পী হওয়া সম্ভব। শহিদ কবির এই কথাগুলোই লালন করেন তার নিজের চিত্রের বেলায়। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের থেকেও এ শিল্পী সব সময়ই নতুন কিছু জানার চেষ্টা করেন। তাদেরকেও তিনি অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস মনে করেন। 

শহিদ কবির সত্তরের দশকে বাউল সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের সংগীত ও আধ্যাত্মিক দর্শনে প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে তার সৃষ্টিতে বাউল সংগীতের মর্মবাণী প্রতিফলিত হয়েছিল। টেম্পেরায় করা বাউল সিরিজের এসব চিত্রে অচিন প্রেম ও মানবিক বোধের ঔজ্জ্বল্য প্রকাশে চিত্রানুরাগীরা বিমোহিত হয়েছিলেন এবং এই সময় থেকে তার সৃজন উৎকর্ষ নতুন মাত্রা অর্জন করেছিল।

বরিশালের ছেলে এক সময়ে ঢাকা চারুকলার শিক্ষক শিল্পী শহিদ কবির সর্বদাই নিভৃতে থেকে গেছেন। দেশ ও বিদেশ মিলিয়ে এ পর্যন্ত তার মাত্র ১৫টি একক চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের প্রতি আবেগী এই শিল্পীর সঙ্গে গল্প আড্ডায় মেতেছিলেন সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক এহসান হায়দার।

একবিংশ শতকের শুরু থেকেই, পৃথিবীতে সংঘর্ষ, জাতি-বর্ণ ভেদ, অধিকার হননের তীব্র প্রতিযোগিতা। দেশে দেশে পরিবর্তন, দখলদারিত্ব, হামলা চলছে। সাম্প্রতিক রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, এমন সংঘাতময় পরিস্থিতি সারা পৃথিবীতে চলমান। এই বিষয়গুলো আপনার আঁকায় কীভাবে প্রভাব ফেলে?

আমি নিজে খুব সাধারণ মানুষ। এজন্য আমার খুব কাছের মানুষ ও জিনিসগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়, ব্যথা দেয়, আনন্দ দেয়। মানে ইউক্রেন আর প্যালেস্টাইন অনেক দূরে। যদিও ওটা মানবতার লঙ্ঘন; কিন্তু আমার কাছের, কাল দেখছি রাস্তায়, আজকে দেখছি এমন-যেগুলো আমার প্রতিবেশীর মধ্যে দেখছি, বা অর্থনৈতিক বিভেদ, মানুষকে কীভাবে ঠকাচ্ছে; সেসব আমাকে বরং বেশি প্রভাবিত করে।

মানে দেশের ভেতরের বিষয়বস্তু?

দেশের না, একেবারে কাছের, প্রাত্যহিক জীবনে। আমার ছবি আঁকার সাবজেক্টগুলো হলো এরকম, যেমন পোড়া রুটি, সুকান্তের কবিতার উপরে। তারপরে, এক থালা ভাত; যেটা করছি এখন। এক থালা ভাত, পান্তা ভাত। একদম সাদামাটা, যেটা গরিব লোক খায়। এ জন্য বললাম যে খুব কাছের জিনিস আমাকে প্রভাবিত করে। ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে সেটা শুনি, কিন্তু তার থেকে তো আমাদের দেশে আরও বেশি হচ্ছে। যুদ্ধ না হলেও স্তব্ধ যুদ্ধ।

পাশের মানুষটার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে? 

হ্যাঁ হ্যাঁ সেটাই। 

সারা দেশে অনেকগুলো চারুকলা ইনস্টিটিউট তৈরি হলেও আমাদের মানসিকতার উন্নতি হয়নি। এখনো চারুকলার একটা ছেলে বা মেয়ে গ্রামে গেলে, তাচ্ছিল্যের শিকার হয়। আমার জানামতে ঢাকা চারুকলায় দুজন ভর্তি হয়েছিলেন, এখন তারা অধ্যাপক; কিন্তু তাদের পরিবার তাদের চারুকলায় পড়াকে মেনে নিতে পারেননি আজ অব্দি। এই যে আমাদের সমাজ একজন চারুকলার শিক্ষার্থীকে মেনে নিতে চায় না; কিন্তু বড় হলে তার অনেক সুনাম। যেমন সুলতান মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন, মানুষ তাকে গ্রহণ করেছে। এই জিনিসটা কেন হয় বলে আপনার মনে হয়? 

আমাদের দেশে, বিশেষ করে ধর্মান্ধতা, এটা একটা কারণ। কিন্তু ইদানীং আমি যা যা দেখলাম, বলব উল্টো। ঢাকা চারুকলায় একটা মেয়েকে দেখেছি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, অসাধারণ আঁকার জন্য। মেয়েটা হিজাব করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, কিন্তু খুবই আধুনিক দর্শনে বিশ্বাসী। তার বাবা মুসল্লি মানুষ; এসেছেন মেয়ের অ্যাওয়ার্ড নিতে। দেখলাম কোনো দ্বিধা নেই, উনি ওনার মেয়ের আঁকা খুব পছন্দ করেন এবং তাকে নিয়ে গর্বিত। আমার লাইফের ডকুমেন্টারিতে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘শিল্পীকে কতটা দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ?’ আমি বলব যে আমাদের মতো একটা গরিব দেশে, একটা শিল্পীকে, এই আমাকেই যতটা দিয়েছে তা আমার প্রাপ্যের থেকে বেশি। সেই পরিমাণ বরং আমি ফেরত দিতে পারিনি। আপনার কথার ঠিক উল্টাটা বললাম। 

তার মানে মানুষ এখন শিল্পকে গ্রহণ করছে ভালোভাবে?

মানুষ যতটা আমাকে দিয়েছে, সাধারণ মানুষ, যারা আমার ছবি সংগ্রহ করে, পয়সা দিয়ে কেনে। যাদের পয়সা নাই তারা মাসিক কিস্তিতে কেনে-আপনি ভাবতে পারেন? যে আর্ট সামিট হচ্ছে, আমার এক শিষ্য ওখানে গিয়েছিল, আমারও যাওয়ার কথা ছিল। গিয়ে আমাকে ফোন করে বলল-‘স্যার আইসেন না, আপনি।’ আমি বললাম-‘কেন!’ বলল, ‘সময় নষ্ট হবে, ঢুকতে পারবেন না।’ 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন কী হইছে!’ বলে, ‘পাঁচ জন করে বের হলে, পাঁচ জন ঢুকতে দেয়, ভিতরে এত ভিড়! শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে মানুষ!’ 

মানুষ এখন আর্ট এক্সিবিশনে যায়, দেখে, বুঝতে চায়। ব্যাপারটা একটা বড় রকমের পজিটিভ টাইম বা চেঞ্জেবল টাইম বলব। তবে পলিটিক্যাল দিক থেকেও তো একটা অস্থির সময়, সে কারণেও মানুষ হয়তো আর্ট দেখছে... 

তো একটা আর্ট এক্সিবিশন দেখতে এত ভিড়! তার মধ্যে হয়তো এক পারসেন্ট মাত্র আর্টিস্ট অথবা সাহিত্যিক। আর বাকি সব সাধারণ মানুষ, পাবলিক। 

আমার এক্সিবিশন যখন হয়েছে ২০১৪ সালে, প্রত্যেক দিন সাধারণ মানুষ এসে দেখে গেছে একটা ছবি। এক নারীর এক শাড়ি। মানে অর্ধেক শাড়ি শুকাচ্ছে, চরে, (দুই হাতে বুক বেঁধে) বুক ঢেকে বসে আছে, শুধু শাড়িটা নিচে পরা। উপরে খালি, আর বাকি শাড়িটা ধুয়ে চরে শুকাচ্ছে। শাড়িটা শুকালে ওটা পরে বাকিটা ধুবে। 

এটা কি আপনার নিজের কনসেপ্ট, না-কি এরকম ঘটেছিল বাস্তবে? 

ছবিটার ফটোগ্রাফ তোমাকে দেখাব। ওটার নাম হলো Only Sharee. কী কথা থেকে এটা আসলো? 

এটা এলো আমাদের দেশের মানুষের আর্ট নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে... 

এই যে আমার এক্সিবিশনে, আমি তো প্রত্যেক দিন যেতাম না, হয়তো এক দিন দুই দিন পর পর যেতাম। মানে লোকে ভরা, তার মধ্যে হয়তো ২ শতাংশ আর্টিস্ট। আর বাকিরা একদম সাধারণ মানুষ। এটা কি কম পাওয়া? আমাদের দেশের মতো প্রেক্ষাপটে? 

অনেক বড় পাওয়া। তার মানে হচ্ছে, একজন শিল্পী হিসেবে আপনারও অনেক দায়িত্ব আছে। 

হ্যাঁ, দায়িত্ব তো আছেই। আমি যেটা বললাম, মানুষ অনেক দিয়েছে; কিন্তু আমাদের সরকার এটা যথেষ্ট খেয়াল রাখছে না। 

হ্যাঁ, যথেষ্ট মূল্যায়ন তো হচ্ছেই না। 

আমাদের দেশে একটা ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি নেই! এত বড় বড় বিল্ডিং হতে পারে, আপনি রাজস্ব ভবন দেখেছেন-কত বড়?

হুঁমম... দেখেছি। প্রয়োজনের চেয়ে বড় আর অনেক মানুষ সেখানে কর্মরত। তবু কাজ হয় না খুব একটা। সম্ভবত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মভাবনা এমনই। বাংলা একাডেমির কথাও বলা যাবে এ বিষয়ে-একটা পত্রিকার জন্য কত মানুষ সেখানে নিয়োগ করা হয়েছে, অথচ সেই একটি পত্রিকাও তারা সুন্দর করে করতে পারে না। উদাহরণ অনেক, এসব বিষয় নিয়ে কথা বললে মন খারাপ করবেন সংশ্লিষ্ট লোকজন। 

এ রকম অনেক বড় বড় ভবন আছে, এবং আমাদের যথেষ্ট টাকা আছে; কিন্তু একটা আর্ট মিউজিয়াম করার মতো উদ্যোগ নেই; সেই আগ্রহ থাকতে হবে তো! 

প্রত্যেকেই তো আর্টের একেকটা মাধ্যম খুঁজে নেয়। কেউ রিয়েলিস্টিক আঁকতে পছন্দ করেন, কেউ প্রতীকী-নিজের ক্ষেত্রে আপনি কোনটাকে প্রেফার করেন? 

আর্টিস্টদের ভাষায় বলি, অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অ্যান্ড নন-অ্যাবস্ট্র্যাক্ট। তো এটা আরও ভালো করে বলতে গেলে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট হলো যে ছবিতে চেনা জগতের কোনো আকৃতি নেই। আমাদের চেনা জগতে, যা দেখে ছোট থেকে বড় হয়েছি, গাছপালা-মানুষ-ঘোড়া-বিড়াল-কুকুর কিছু নেই; কিন্তু শুধু রঙের বিন্যাস, স্পেস ও রেখা আছে। অ্যাক্সেক্টলি একটা ক্লাসিক্যাল গানে কি আছে? সা রে গা মা-ওইটাই থাকে। কোনো কথা থাকে না...

মানে, কথা খুব কম থাকে আবার না-ও থাকতে পারে। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেই-ই। কথা খুব কম। কথা থাকলেও, প্রেম বা মমতার কথা নেই, শুধু গানের স্বরলিপিগুলো থাকে। তারপরে কোকিল যখন ডাকে, কোকিল তো কিছু বলে না; কিন্তু ডাকের মধ্যে একটা রিদম আছে। যে রিদমের জন্য মানুষের শুনতে ভালো লাগে। যখন ডাকে খেয়াল করে দেখবেন, কুঁহ কুঁহ করে না। কুঁউউউ করে একটা রিদমে ডাকে। ওই রিদমটাই আর্ট এবং অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টেরও এমন একটা রিদম আছে। যে রিদমে চেনা জগতের কোনো আকৃতি নেই। 

তার মানে বিমূর্ত শিল্পে চেনা জগতের কোনো আকৃতি পাওয়া যায় না; কিন্তু একটা কিছু হলেও আছে। 

মূর্ত আর বিমূর্তের মধ্যে এমন কোনো পার্থক্য নেই। যেমন-আমাদের জীবনে অনেক জিনিস আছে, অনেক সময় শীত লাগলে বলি, ইসস কী শিরশির করছে, এই শিরশিরের কোনো অর্থ নেই। 

অর্থ নেই এবং দেখানোও সম্ভব না। 

এটা অ্যাবস্ট্রাক্ট। আমি এক ইন্ডিয়ান আর্টিস্টকে একটা কথা বলেছিলাম, উনি সেই কথাটা পরে টেলিভিশনে বলেছেন। উনি আমাকে বলেছেন, ‘আমাদের ছবিতে দেব-দেবীর ইনফ্লুয়েন্স খুব বেশি। সরস্বতীর হাত, কালীর জিহ্বা, বুদ্ধর এটা ওটা। আপনাদের ছবি দেখলাম খুব স্ট্রং!’ আমি বললাম-‘তার একটা কারণ হলো আমরা মুসলিম এবং যদিও প্রত্যেকে আমরা হয়তো নামাজ পড়ি না ঠিকমতো; কিন্তু যেহেতু আল্লাহ নিরাকার; ওখান থেকেই আমাদের মধ্যে অ্যাবস্ট্রাক্টটা আসছে। মানে আমরা সিজদা দিচ্ছি, মোনাজাত করছি, বাট কোনো কিছু সামনে নেই! প্রত্যেকটা ধর্মেই কিন্তু সামনে একটা জিনিস থাকে। যিশু থাকে কিংবা মূর্তি থাকে একটা, কিংবা গৌতম বুদ্ধ থাকে; কিন্তু আমাদের সামনে কিছু নেই। শুধু হাত তুলে মোনাজাত করছে, অ্যাবস্ট্রাক্ট! শুধু বিশ্বাস। অ্যাবস্ট্রাক্টটাও ওই রকমই।’

 আপনি কোনটাকে প্রেফার করেন-আমার প্রশ্ন হলো সেটা। 

আমি কোনোটা প্রেফার করি না। আমার মধ্যে যখন যা আসে, আমার ছবিতে সেটাই হয়। যিনি আমার গুরু ছিলেন, উনি অ্যাবস্ট্রাক্ট করতেন। আমি প্রথম পাঁচ বছর অ্যাবস্ট্রাক্ট করেছি। যখন শুরু করেছি। তারপরে আস্তে আস্তে দেখলাম যে আমি যা বলতে চাই, একটা আকার না থাকলে আমি এক্সপ্রেস করতে পারছি না। একটা বস্তুর আকার। 

রিয়েলিস্টিক ব্যাপারগুলো? 

না, ঠিক রিয়েলিস্টিক না। রিয়েলিস্টিক হলো যেটা ফটোগ্রাফিক। সেটাকে বলে রিয়েল-স্টিক। ফিগারিটিভের বাংলাটা কী? আকার-ধর্মী, মানে যেটার শেপ আছে।

মানে পুরোপুরি অ্যাবস্ট্রাক্ট না সেটা? 

ছবির ট্রিটমেন্ট মানে হলো রঙের ব্যবহার ও কারুকার্য। আমার ছবির ট্রিটমেন্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট; কিন্তু আমার ছবির একটা আকৃতি থাকে। আপনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখবেন যে এটা একটা ফ্লাওয়ার। অথবা একবাটি ডাল; কিন্তু প্রথমে এক নজরে আসে না, অনেকক্ষণ ধরে দেখতে হয়। 

আপনি বললেন পাশের যে মানুষটা, প্রতিদিন যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তার কোনো আঘাত এলে সেটা আপনাকে পীড়া দেয়। তো এমন কোনো ঘটনায়, তাৎক্ষণিক এসেই কি আপনি আঁকেন? নাকি সেই ব্যথাটাকে অনেক দিন ধরে টেনে নিয়ে যান-মানে ঘটনাটিকে জিইয়ে রাখেন কি? 

আমি তো আর ক্যামেরা না যে দেখলেই ইমেজটা এখানে এসে পড়ল। আমার ইমেজ চোখ থেকে অন্তরে ঢোকে। অন্তরে অনেক বছর থাকতে পারে। সেটা ডিলিট হয় না এবং আমি যে ওই ছবিটা আঁকছি, একটা নারী তার অর্ধেক শাড়ি শুকাচ্ছে আর অর্ধেক চরে-এটা আমি দেখছি, যখন আমি চারুকলায় সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমি বরিশাল যাচ্ছিলাম স্টিমারে। তখন ছাদের উপর থেকে আমি দেখছিলাম, দূরে এরকম একটা মেয়ে। দেখা যাচ্ছিল না ভালো করে। আমি দেখার চেষ্টা করছিলাম উবু হয়ে, তো আমার পাশে একটা বুড়ো লোক ছিল। তখন তাকে বললাম-‘চাচা উনি কী করেন ওখানে?’ তিনি জবাব দিলেন-‘আরে বাবা, ওর তো একটাই শাড়ি, অর্ধেক শুকাইতেছে, অর্ধেক পইরা আছে।’ তো এটা তখনকার কথা যখন বাংলাদেশ আরও গরিব ছিল! তো এটা আমার মনে গাঁথা ছিল, যা আমি ২০১৪ সালে এসে করছি। 

ধরুন ৪০ বছর আগের এবং ভেতরে এটা কিন্তু ডেভেলপ হতে থাকে। যাদের মধ্যে ফিলিংস বেশি তারাই এই ধরনের ছবি আঁকে। 

অনুভূতিশীল মানুষেরাই ঘটনা মনের ভেতর জমা রাখেন এবং তা ধীরে ধীরে আঁকেন।

ওই যে উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রোগ্রাম হতো না, বেঙ্গল যেটা করত। ওখানে চৌরাশিয়া বাঁশি বাজাত ভোর ৬টার সময়। মানুষ চলে না গিয়ে অপেক্ষা করে বসে আছে কখন চৌরাশিয়া বাঁশি বাজাবে; কিন্তু বাঁশি তো কিছু বলে না। ওই বাঁশিতে কিন্তু কোনো আমি-তুমি বলে কিছু নেই এবং কোনো গানও না, শুধু সুর। অ্যাবস্ট্রাক্ট। তো যেটা বললেন, আমার মনে যেটা উঠে আসে সেটা আঁকি। ভারতীয় প্রয়াত শিল্পী কেজি সুব্রামানিয়ামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-‘আপনি কী আঁকেন?’ উনি উত্তরে বলেছেন, ‘যা দেখি, যা আমার চোখ দিয়ে মনে ঢুকে পড়ে সেটাই আমি আঁকি।’ আর আমি কোনো সময় কল্পনা করে আঁকতে পারি না। এতদিন ছবি আঁকছি, আমি একটা মানুষ আঁকতে পারব না দেখে। আপনাকে আঁকতে পারব; কিন্তু সেই মানুষটা আপনি নন। আমি যখন যে জিনিসটা আঁকি, যাকে আঁকি, তাকে দেখি, স্টাডি করি, আর স্টাডি করার জিনিস যদি আমার সঙ্গে না থাকে তাহলে মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবি তুলে নিই। ছবিতে ক্যামেরা দিয়ে যখন তাকাই, তখনই তার ফিলিংসটা আমার মধ্যে ঢুকে যায়। তার চেহারা দেখে তার ভেতরটা বুঝতে পারি। পরে যখন আঁকতে বসি, ক্যামেরায় তোলা ছবিটার হেল্প নিই। 

এজন্য আমার প্রত্যেকটা ছবিতে টাইটেল আছে। যেমন-‘সোবহান চাচা’। আমি জানি না তিনি বেঁচে আছেন কিনা। সোবহান চাচাকে দেখে কিছু পাইনি, আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়েকে বললাম কিছু একটা নিয়ে আসতে, পরে ও একটা অঙ্ক খাতা নিয়ে আসে, সেখানে বলপেন দিয়ে একটা ড্রয়িং করেছি ওনার। তখন তো আর মোবাইলে ভালো ক্যামেরা ছিল না, এমনি মোবাইলে যে ছবি আসে, এমন একটা ছবি তুলে এনেছি। তোলার পরে সেটার হেল্প নিয়ে ওই চাচাকে ফিল করেছি আর এঁকেছি। 

বেশিরভাগই যারা ফিগারেটিভ কাজ করেন, তারা এভাবেই করেন। এটা ব্রিটিশ পদ্ধতি। ওরা কিন্তু না দেখে আঁকে না। আপনি ওল্ড মাস্টারদের যত পেইন্টিং দেখবেন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো যীশুকে আঁকছেন, পাঁচটা মডেলকে বিভিন্নভাবে বসিয়েছেন। বসিয়ে স্টাডি করেছেন তারপর এঁকেছেন।

সবটাই কি মডেল দেখে আঁকা?

প্রত্যেকটা মডেল দেখে আঁকা। আর যারা অ্যাবস্ট্রাক্ট করে তাদের মডেল লাগে না। তারা তো অ্যাবস্ট্রাক্ট করে। আমাদের এখানে শিল্পীরা যারা আঁকে, ধরেন গ্রামবাংলা, কলস নিয়ে যাচ্ছে একটা মহিলা, কোন মহিলা? কে? তার শেপ কি তার প্রকাশ করতে হবে। যেমন-যমুনা সেতুর যে ছবিটা এঁকেছি, সেটা আঁকার আগে, সানজিদা (ভাগনি) আমাকে একটা ফটোগ্রাফ দিয়েছে। আমি বললাম, শুধু ফটোগ্রাফ দেখে কীভাবে আঁকব? কখনো দেখিনি যমুনা সেতু। যখন উপর দিয়ে গিয়েছি তখন তো ব্রিজ দেখিনি। এরপর আমাকে নিয়ে যারা লাইভ ডকুমেন্টারি করছেন, তারা বললেন, স্যার আপনার প্ল্যান কী? আমি বললাম, যমুনা সেতুতে যাব। এরপর ওদের টিম, ক্যামেরা নিয়ে আমরা গিয়েছি টাঙ্গাইলে, যেখানে যমুনা সেতু শুরু হয়েছে। সেখানে দেখি আর্মি ভরা, ঢুকতে দিচ্ছে না। বলে, দূর থেকে দেখেন, উপর দিয়ে যান; কিন্তু এইখানে ঢোকা যাবে না। তখন আবার জঙ্গির উৎপাত ছিল খুব। ব্রিজ ধ্বংস করবে এ রকম একটা প্রচারণা। এখনো আর্মি আছে ওখানে। তো ঢাকায় ফিরে এসে, আমার এক এক্স-স্টুডেন্ট আছে, ওর হাজব্যান্ড মেজর, তাকে বললাম। সে টেলিফোন করে দিয়েছে, সেখান থেকে এরপর জিজ্ঞেস করেছে কয়জন আসবে, তাদের ছবি পাঠাও, কতক্ষণ থাকবে, ইত্যাদি। আমরা বললাম সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। পারমিশন পাওয়ার পরে আমরা আবার গেলাম। আমাদের সঙ্গে তিনজন আর্মি থাকল। ওরা বলল আপনাদের পারমিশন দেওয়া হলো, আপনারা শুধু ছবি আঁকতে পারবেন, কিন্তু কোনো মুভি করতে পারবেন না। আমি ওখানে ব্রিজের নিচে বসে ব্রিজ দেখেছি। ওয়াটার কালার করেছি একটা। আরেকটা স্কেচ করেছি। ছবি তুলেছি। এত বড় ব্রিজ, বাম দিক দিয়ে ঘুরে গেছে। আর ডান দিকে গেলে ব্রিজের একটু দেখা যায়; কিন্তু ওখানে আঁকার সুবিধা, কারণ রোদটা চোখে লাগে না। বাম দিকে রোদে চোখ ঝলসে গেছে, তারপরও বাম দিক থেকে আঁকতে হয়েছে। কারণ বামদিকে পুরো ব্রিজটা পাওয়া যায়। শেষে একদম মিশে গেছে হরাইজনটাল লাইনের সঙ্গে। ওখানে আমি ছবি তুলেছি, টুকরো টুকরো করে। ক্যামেরায় তো পুরোটা ধরে না। বাসায় এসে ফটোগ্রাফগুলো ওয়াশ করে জোড়া দিয়েছি। এরপর একটা কাঠের মধ্যে আটকে সেটাতে রঙ দিয়েছি। তারপরে ওই ফটোগ্রাফ দেখে ব্রিজটাকে এঁকেছি। সাত ফুট বাই নয় ফুট, বড় পেইন্টিং। এটা সালমান এফ রহমানের কাছে আছে। ওখানে গিয়ে যখন আমি কাজ করেছি বসে, গরমে। একটু পর পর পানি ঢেলেছি গায়ে আর দেখেছি, যখন ট্রাক যাচ্ছে তখন থরথর করে কেঁপে উঠছে। সেই যে ফিলিংস, ওটা না হলে তো আমি আঁকতে পারতাম না, ফটো দেখে তো সেটা হয় না। কয়েক হাজার রাজমিস্ত্রি আর কয়েকশ আর্কিটেক্ট মিলে ব্রিজ বানিয়েছে। ব্রিজের ফিলসফি হলো-দুই তীরকে এক করে বেঁধে রাখা। যোগাযোগ আরকি, বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক। সেটা আমি এক মুহূর্তে একটা ছবি দেখে এঁকে ফেললাম? এটা ফিলিংসের ব্যাপার। আমি কখনো মনগড়া ছবি আঁকি না। 

আপনি বড় হয়ে আর্টিস্ট হবেন, ছোটবেলা থেকেই কি এর লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে? 

হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকেই। 

আর কেউ আছে পরিবারে, যে ছবি আঁকত? 

আমার মা খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আমার ভাইবোনও সবাই আঁকতেন। আমার বড় ভাই, ছোট ভাই দুজনই খুব ভালো আঁকতেন। এটা কোত্থেকে এসেছে জানি না। কুর্শিকাঁটা দিয়েও আমার মা ভালো কারুকাজ করতেন। 

তার মানে একদম প্রাইমারি স্কুল থেকেই এই আঁকার সঙ্গে যুক্ত? 

আমার বড় বোন যখন টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজে পড়তেন, তখন হোস্টেল থেকে বাসায় এসে ওয়াটার কালার করতেন। আর সেগুলো ওয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন। প্রতিবেশীরা দেখে খুব প্রশংসা করত। এগুলো আমি দেখতাম আর ভাবতাম আমি কবে আঁকব। তখন আমি একদমই ছোট। একদম ছোটবেলায় আমার হাতেখড়ি করিয়েছিল। আমি জানি না কেন, আর কারো হয়নি। আগে হাতেখড়ি হতো। 

হ্যাঁ, আগেকার দিনে তালপাতায় কয়লার কালিতে বাঁশের কলম বানিয়ে লেখা হতো। আর একটা আনুষ্ঠানিকতাও ছিল। এখন এ দুটি প্রথার একটিও নেই।

মিলাদ পড়িয়ে একজন হুজুর এসে আমার হাতে একটা স্লেট দিয়েছে। স্লেটের মধ্যে আল্লাহুসহ আরও কী কী যেন লিখেছে, তারপর আমার হাতে দিয়েছে। আমি যতটুকু পেরেছি করেছি, তারপর নিচে একটা মানুষের মতো এঁকেছি। মানুষটা দেখতে হয়েছিল কাঁকড়ার মতোন। তখন তো আর আঁকতে পারি না। তখন হুজুর বলে এটা কী? সেটাই আমার হাতেখড়ি। 

বনেদি পরিবারগুলোতে এ ধরনের ঘটনাগুলো ছিল আগে? 

হ্যাঁ এবং তারপরে আমার মনে আছে আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই, উনি খুব ভালো হাত দেখতে পারতেন। আমার হাত দেখে বলেছিল আমার হাতের আঙুলের শেপগুলো পয়েন্টেড। আর কতকগুলো লাইন দেখে আমার বাবাকে বলেছিলেন ওকে কিন্তু আর্ট কলেজে পড়ায়েন, He will be very famous, ওর হাতের মধ্যে আর্টের সাইন আছে, এটা সবার হাতে থাকে না। তখন থেকে আমি, একদম ছোটবেলা থেকেই আঁকতাম। তখন আমি জানতামও না যে বাংলাদেশে চারুকলা নামে একটা আর্ট কলেজ আছে। আমি যখন সেভেনে পড়ি তখন গিয়েছিলাম দৌলতপুর। আমার ভগ্নিপতি দৌলতপুর থানার ওসি ছিলেন। আমার বোন ছিলেন দৌলতপুর মহসিন গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তো দৌলতপুরে তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো চিত্র শিক্ষার বিদ্যালয়। মহেশ্বর পাশা আর্ট স্কুল। 

এখনো আছে ওটা? 

হ্যাঁ, এখনো আছে। তখন আমার ভগ্নিপতিকে বললাম আমি ওখানে ভর্তি হবো। তবে উনিই প্রথম আমাকে সেখানে ভর্তি হতে বারণ করেন। বললেন, ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা আর্ট কলেজ আছে সেখানে ভর্তি হতে। এই প্রতিষ্ঠানের কথা আমি জানতামই না। তারপর ফিরে আসলাম বরিশাল, আর অপেক্ষা করলাম কবে আমি ম্যাট্রিক পাস করব। তারপরে ম্যাট্রিক পাস করলাম, তাও কিসের পাস, থার্ড ডিভিশন পেয়েছি। পাস ডিভিশন। জাস্ট বের করে দাও স্কুল থেকে। তখন চারুকলায় ভর্তি হতে কোনো পয়েন্টের বাধ্যবাধকতা ছিল না। 

শুধু উত্তীর্ণ হলেই হতো? 

শুধু ছবি আঁকার ট্যালেন্ট থাকলেই হতো।

আপনাদের সময়ে কি প্রবেশিকা পাসটা লাগত না? 

আমাদের সময়ে একটা ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে। আমাকে কী যেন একটা আঁকতে দিয়েছিল। এখন তো মাই গড! হিস্ট্রি অব আর্ট, ম্যাট্রিকে পয়েন্ট থাকতে হবে, কী সব মারপ্যাঁচ! নইলে ভর্তি করবে না। এজন্যই তো আর্টিস্ট বের হয় না। 

সাহস করে সত্যটা কেউ বলতে চান না। আপনি বলছেন যে...

এসব নিয়ে কথা বলতে আমার ভয় নেই। কালকে এক জায়গায় এক্সিবিশন উদ্বোধন করতে গিয়েছি, সবার প্রথমেই মাইকে বলে নেই আমি জন্ম মূর্খ। তাই মূর্খের ভুল হবেই। 

আঁকতে গিয়ে শিল্পী হিসেবে কোনো মজার, আনন্দময় স্মৃতি-যেটা মাঝে মাঝে মনে হয়, এরকম কিছু আছে কি? 

ছোটবেলার একটা স্মৃতি মনে পড়ে। আমার বড় বোন যখন কুমুদিনী কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়িতে আসতেন, দেওয়ালে তার আঁকা ছবিগুলো ঝুলিয়ে রাখতেন। তখন সবাই প্রশংসা করতেন। মনে হতো কী যে সুন্দর! আমার তখন মনে হতো আমিও তো পারি, আমারটা দেখে না কেন সবাই? কিন্তু আমি যে আঁকব, কাগজ কই পাব তখন? আমি তো খুবই ছোট। আমার বাবা তখন পোড়া বেল খেতেন, পাকস্থলীর উপকারের জন্য। পোড়া বেলটা দেখে মনে হলো এটায় ভালো রঙ আছে, খয়েরি রঙ। দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমিয়েছে, তখন পোড়া বেল ভেঙে সাদা দেওয়ালের মধ্যে ছবি এঁকেছি। যা পেরেছি আর কি। আমি ভেবেছি ঘুম থেকে উঠে সবাই প্রশংসা করবে। তখন আমার ছয় বছরের মতো বয়স। এঁকেছি টুলের উপর দাঁড়িয়ে। মনে করেছি সবাই বাহ বাহ দেবে। সবাই বলেছে হ্যাঁ সুন্দর হয়েছে; কিন্তু আমার বাবা আমাকে বলেছেন এগুলো সব মুছতে হবে তোর। তারপরে শাস্তিস্বরূপ হাত বেঁধে রেখেছে আমার। তারপরে আমি কেঁদেছি এবং মুছেছি। এটা একটা স্মৃতি।

চিত্রশিল্পী এবং সাধারণ মানুষ-নিজের ভেতরের এই দুজনকে কীভাবে বিভাজন করবেন? 

সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষ হিসেবে আমি কেমন? শিল্পী তো পরে। যেমন আবেদিন স্যার (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন) একটা কথা বলতেন (উনার ক্লাস পাইনি আমরা, কিন্তু উনি ক্লাসে ঢুকে কথা বলতেন) সব সময়, “ভালো মানুষ না হলে ভালো শিল্পী হতে পারবে না। ভালো মানুষ মানে সদা সত্য কথা বলিবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িবে, ওই ভালো মানুষের কথা বলছি না; You have to be very honest to yourself, নিজের প্রতি সৎ হও।’’ একজন শিল্পী ও একজন মানুষের মধ্যে কোনো তফাত নেই। ইতিহাসে তাকালে দেখা যায়, আজ পর্যন্ত যারা বড় শিল্পী হয়েছে, তারা প্রথমত ভালো মানুষ। And they all did for the people, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল-জয়নুল আবেদিন-সবাই তারা মানুষের জন্য খুব অনুভব করেছেন। আমি মানুষ আর শিল্পীর মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। যে ভালো শিল্পী, সাধক শিল্পী, সে ভালো মানুষ হবেই। 

কেবল মসজিদে যাওয়ার বিষয়টা তো ভালো মানুষ হওয়া না। 

হ্যাঁ, ড্রিংক কোরো না, তুমি ভালো মানুষ; ওরকম তো অনেকেই আছে। তুমি মানুষের জন্য কী করছো? তুমি অন্তত তোমার ভাইকে কিভাবে সাহায্য করেছ, বা তোমার বোনকে বা প্রতিবেশীকে? তোমার গ্রামের লোকের জন্য? সে-ই ভালো মানুষ যে অন্যের জন্য ফিল করে। 

আরেকটা বিষয়, ইতালিতে রেনেসাঁ প্রথম চিত্রকলায়, সাহিত্যে, তারপর অন্যান্যভাবে বিস্তার লাভ করেছে। পরবর্তী কয়েক শতকে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, এরপরে নতুন কোনো পরিবর্তন ঘটবে বলে আপনি মনে করেন? 

পুরো পৃথিবীতে ডিজিটালের পরে যেটা এসেছে সেটাকে বলে ইন্সটলেশন, পারফরম্যান্স অ্যান্ড কনসেপচুয়াল। অনেকেই বলে যে আমরা নতুন কিছু করছি। আমি সবসময় বলি, এখনো বলছি, Nothing new in the world! তুমি আবিষ্কার করতে পারবে না, আবিষ্কার হয়ে গেছে অনেক আগেই। তুমি ডিসকভার করতে পারবে। আমাদের দেশেও তরুণ অনেক ছেলেমেয়ে কাজ করছে। একজনকে কিছুদিন আগে জিজ্ঞেস করলাম, চীন থেকে শিখে এসে কী করছ। বলে, সুতা দিয়ে কাজ করি। এটা New Media. আমি বললাম New Media মানে? যে সুতা দিয়ে আমার দাদি-মা কাজ করত। তুমি তোমার মতো করছ। কিন্তু সুতা দিয়ে তুমি নতুন কিছু করছ না। নতুন বলে কিছু নেই। 

তবে এখন যেটা করছে, বাংলাদেশে হচ্ছে, অন্যান্য দেশেও হচ্ছে ইনস্টলেশন অ্যান্ড পারফরম্যান্স। যারা পারফরম্যান্স আর্ট করেন, তারা একে আর্ট দাবি করেন। বেশ করো; কিন্তু আমাদের দেশের ‘যাত্রা’র থেকে বড় পারফরম্যান্স আর্ট আর কী আছে? এটা শুনে একজন আমাকে বলেছে, এটা আপনি কোত্থেকে পড়েছেন? আমি বললাম, এটা আমি কোথাও পড়ি নাই, ফিল করেছি। সে বলল, জার্মান এক ড্রামা ক্রিটিক বলেছে, পৃথিবীতে যদি কোনো পারফরম্যান্স থাকে তো সেটা হলো বাংলাদেশের যাত্রা। যেখানে কোনো গ্রিনরুম নেই! মঞ্চ থাকে দর্শকদের মাঝখানে। কোনো পর্দা নেই! অভিনয় শিল্পীরা ডায়লগ বলতে বলতে স্টেজের উপরে আসে, সেখানে যুদ্ধ করে এবং সেখানে মানুষের সামনে মরে যায়। মানুষ কাঁদে, তারপর উঠে আবার হেঁটে চলে যায়। 

হ্যাঁ, এটা আমি কয়েকবার দেখেছি। আমাদের অঞ্চলে এখনো বিশেষ কিছু সময়ে এটা হয়ে থাকে। দারুণ ব্যাপার। 

একটা বাক্স নিয়ে তার উপরে কয়েকটা কাপড় দিয়ে কবর তৈরি করল। যে মারা গেছে, তার স্ত্রী এসে কাঁদছে! পরে কবর থেকে উঠে হেঁটে চলে গেল, মানুষের সামনেই! আরও আশ্চর্যজনক হলো-এই যে বিবেক, বিবেকের ইংলিশ হলো কনসাস, তাই না? যাত্রায় বিবেক চরিত্র রূপে আবির্ভূত হয়। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল। দর্শকরা দেখে-বিবেক গান গাইছে, ন্যায়ের গান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। মানুষ শুনছে, কাঁদছে এবং অভিনেতারা তার মধ্যে যুদ্ধ করছে! কিন্তু তারা বিবেককে দেখে না! অভিনেতারা ওর দিকে তাকায়ই না। এর পেছনের ফিলসফিটা হলো, অভিনেতারা জানে না যে বিবেক আছে। কারণ বিবেক তো ভেতরে থাকে; কিন্তু মানুষের (দর্শক) জন্য বিবেক তৈরি করেছে। এর চেয়ে আধুনিক আর কিছু পৃথিবীতে হয়নি। পারফরম্যান্স! এটাকে অতিক্রম করতে পারবে না, যত যা-ই করুক।

এখন আপনি কী নিয়ে কাজ করছেন? 

এটা ভালো বলেছেন। আমার কোনো, কী নিয়ে নেই। আমার কোনো বিষয়ও নেই। যে জিনিস আমার মনে ধরে, যেমন সুকান্তর কবিতা আছে না? ঝলসানো রুটি; কবিতাটা ছোটবেলা থেকেই আমার ভালো লাগত। ২০১৬ সালে, আমার একটা এক্সিবিশন ছিল। আমার বাসায় যে মহিলা কাজ করত তাকে বললাম আমাকে রুটি বানিয়ে দিতে। সে আমার জন্য পাতলা রুটি আর আলুভাজি নিয়ে এসেছে। আমি খেয়ে বললাম, এটা তো আমি চাইনি। আমি চাই মোটা রুটি যেটা আপনারা বাড়িতে বানান। বলে যে ওটা তো কড়াইয়ের উল্টা দিকে বানায়। আমি বললাম হ্যাঁ ওইরকম। পরদিন নিয়ে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, বের করে না। আমি বললাম কী হয়েছে? বলে, স্যার পুড়ে গেছে। আমি বললাম, দেখান তো আমাকে। দেখে বললাম এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। তারপর সেই পোড়া রুটিটাকে প্রথমে আঠা দিয়ে রোদে শুকিয়েছি, আঠার সঙ্গে তুঁত দিয়েছি, যেন পোকায় না কাটে। ছাদে নিয়ে শুকানোর পরে একটা কাঠির মধ্যে লাগিয়েছি। এরপর রুটিটি পাশে রেখে আমার লে আউটে (যেটাতে আমরা কাজ করি) এর ইন্টারপ্রিটেশন করেছি। বুঝতে পেরেছেন? আমি কপি করিনি। 

ইন্টারপ্রিটেশন আর্টে, কীভাবে সেটা যদি বলতেন?

ইন্টারপ্রিটেশন করেছি আমার মতো করে; কিন্তু দেখলে বোঝা যায় একটা রুটি ফোস্কা পড়ে আছে। এটা কয়েক দিন আগে দিয়েছিল তো ফেসবুকে। এটা যে আমার কাছে থেকে কিনেছে, তার কাছ থেকে লোনে নিয়েছে আর্ট সামিট। ‘ক্ষুধা’। যে জিনিসটা আমাকে ব্যথা দেয়, অথবা আনন্দ দেয় সেই জিনিসটা আমি দেখি অথবা ভাবি। সেটা নিয়ে কাজ করি। আমার কোনো ধরন নেই। দেখবেন যে, গাছ, ল্যান্ডস্কেপ ও নিসর্গ আঁকছি, আবার এক থালা ভাত। এখন আঁকছি এক থালা ভাত আর শুকনা মরিচ। বলবেন, এই এক থালা ভাত আপনি দেখেছেন? হ্যাঁ এটা আমি দেখেছি ছোটবেলায়। আমার বাবা ছিলেন দারোগা, কিন্তু অনেককেই দেখেছি শুধু পোড়া মরিচ দিয়ে ভাত খাচ্ছে। পোড়া মরিচ আর কাঁচা মরিচ। ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছে-এটা আঁকছি। ব্যাপারটা এমন নয় যে ডালই আঁকব সারা জীবন। পরদিন হয়তো আমি অন্য কিছু আঁকছি। একই সময় আমি আঁকছি জবা ফুল; কিন্তু যে জিনিসটা আমি আঁকি, আমি কোনো সময় কল্পনা করে আঁকি না, আমি তা-ই আঁকি, যা আমি দেখি।

এই সময়ে আপনার সমসাময়িক যারা আঁকেন তাদেরকে নিয়ে কিছু বলার আছে? 

এখন যারা করছেন, তাদের এবং সবার জন্য, এবং আমার নিজের জন্যও কথাটা : It is not a profession, it is a vocation. ভোকেশনের বাংলা কী? সাধনা। যারা কাজ করছেন, সাধনা করার চেষ্টা করেন উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এবং একটা শিল্পীর সবচেয়ে বড় যা থাকতে হবে-তা হলো মানসিকভাবে স্বাধীন। কোনো রাজনৈতিক দল, অর্থনৈতিক দল, কোনো প্রতিষ্ঠান, তাদের তাঁবেদারি করা যাবে না। ইতিহাসে যাদের আর্টের কথা আছে তারা কখনো কারও তাঁবেদারি করেনি। কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয় প্রশ্রয়ের ছায়ায় থাকেনি। তাহলে তো সেটা আর্ট থাকবে না। 

একজন শিল্পানুরাগী, যে আর্টের কিছু জানে না, কিন্তু ছবি দেখতে ভালোবাসে তাকে নিয়ে আপনার কী বলার আছে? 

তার জন্য বলব, আপনি দেখেন আগে, দেখলে ভালো লাগলে দুবার দেখেন, তিনবার দেখেন। ভালো না লাগলে দেখবেন না, আপনাকে জোর করা হচ্ছে না। কিন্তু এটার বিপক্ষে কিছু বলার চেষ্টা করবেন না। কারণ আমাদের ধর্মেও আছে, তোমার কাছে অতিরিক্ত পয়সা বাঁচলে তুমি ফুল কিনো। হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কথা যে তোমার খাদ্য কিনে, তারপর পয়সা থাকলে ফুল কিনো। তার মানে কী? যে জিনিসটা তোমার ভালো লাগে, ফুল তো আর তুমি খেতে পারবে না। আর যে ছবি পছন্দ করবে, সুর যার কাছে ভালো লাগবে সে কোনোদিন কারও ক্ষতি করতে পারবে না। 

শিল্পের অনেকগুলো মাধ্যম আছে, তো আমার মনে হয় কি, আর্ট একমাত্র মাধ্যম যেটার মধ্যে সব কিছু আছে। যেমন একটা বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকি আমরা, পুরো বইয়ের ঘটনা ওই প্রচ্ছদ দিয়েই বোঝা যায়। এটা নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে কিনা? 

আমার এক বন্ধুর বোন, মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। খুব জ্ঞানী মানুষ। উনি বলছেন যে তোমরা শ্রেষ্ঠ। তোমরা রূপ দিতে পার। আকার দিতে পার। ফটোগ্রাফাররা আকার দিতে পারে; কিন্তু মেশিনের মাধ্যমে। সাহিত্যিকরা লিখতে পারে। গায়করা সুর দিতে পারে। কিন্তু আকার, যে শেপটা দেওয়া, একমাত্র তোমরা দিতে পার ঈশ্বরের পরে। শুধু তোমরা জীবন দিতে পার না, এই হলো পার্থক্য। এটা উনি আমাকে বলছিলেন। যেমন এখানে যে রবীন্দ্র সংগীত গায়, যে লেখে, তিনি যদি ইংল্যান্ডে যায় বা বাংলা ভাষার বাইরে কোথাও যায় তাহলে উনার কবিতা গান বুঝবে না। কিন্তু ছবির রঙ; পৃথিবীর সব দেশের সবুজ, সবুজই। তুমি যদি মানুষ আঁকতে পার বাংলাদেশে, পৃথিবীর যে কোনো জায়গার মানুষ বুঝবে এটা মানুষের আকার। 

বিদেশে খাবার খেতে গিয়ে একটা ঘটনা আছে জয়নুল আবেদিনের। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খাবেন, কিন্তু অর্ডার করতে পারছেন না। কারণ সেখানকার ভাষা তো জানেন না। তখন পাশে দেখলেন একজন চিংড়ি খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে খাতা কলম বের করে চিংড়ি এঁকে দিলেন। হাশেম খান এটা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন। 

আমি নিজেও তো এমন করছি। আমি যখন স্পেনে গেছি তখন তো আমি ভাষা জানতাম না। তখন একটা খাতা নিয়ে বের হতাম, দোকানে গিয়ে একটা মুরগি এঁকে ডিম আঁকতাম নিচে। আমার মনে আছে এখনো, আমার রসুন লাগবে, পেঁয়াজ দিয়েছে। তখন পেঁয়াজের মতো এঁকে সাদা কাপড়ের দিকে দেখানোর পরে বুঝল। একজন চিত্রশিল্পীর ভাষাটা রঙ ও আকার। এবং গান্ধী একটা কথা বলছিলেন, তোমার শিশুকে লেখা শেখানোর আগে, অক্ষর শেখানোর আগে আকার আকৃতি আঁকতে শেখাও। যখনই ভালো আঁকতে পারবে, তখনই একটা ভালো অক্ষর লিখতে পারবে। এটা আমি জানতাম না, কয়েক দিন আগে শুনেছি। 

একটা কথা কি এভাবে বলা যায় কিনা যে, আর্টের বাজার। সরাসরি বাজারই বলে ফেলে, যারা বায়ার বা আর্ট বাজারে কাজ করেন। সংগ্রাহকদের কথা বলব না, গ্যালারিওয়ালারা বলে আর্ট বাজার। এই বিষয়টা নিয়ে যদি কিছু বলতেন। 

আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশি যারা আমার ছবি ছয়, সাত বা আট লাখ টাকা দিয়ে কেনে, সে এটা না কিনে আরেকটা গাড়ি বা বড় টেলিভিশন কিনতে পারে, কিন্তু উনি আমার ছবিটা কিনছেন। যার কথা বলছি, ওর নাম রিজোয়ান। আমার এক্সিবিশনের আগে, ও ওর স্ত্রীকে নিয়ে আমার গ্রিন রোডের বাসায় এসে সিলেক্ট করেছে, চরের যে মেয়েটা শাড়ি শুকাচ্ছে, আর রুটিটা। এক্সিবিশনের দিন সকালে আমি যখন গ্যালারিতে যাচ্ছি, তখন আমাকে ফোন দিয়ে বলে, স্যার একটা জরুরি কথা আছে। গ্যালারিতে গিয়ে বলে দেবেন যে রুটিটা বুকড। আমি সারা রাত আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। সবাই বলছে যে পোড়া রুটি, কিন্তু পোড়া রুটির যে ফিলোসফি এবং ওখানে যেভাবে কাজ করেছেন, ওটাই আমার ভালো লেগেছে। তো ওই রুটিটা উনি কিনেছেন। 

আজকের মতো আমরা তাহলে শেষ করছি। অনেক ধন্যবাদ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //