গাজার পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ জর্ডানের কাছে দেয়া উচিত: কিসিঞ্জার

অক্টোবরের ১৮ তারিখ আমি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখনও বুঝতে পারিনি এটাই তার সঙ্গে আমার বলা শেষ কথা হবে। আর এটাই যে শেষ সাক্ষাৎকার সেটিও আমার বোধগম্য হয়নি। গত ২৯ নভেম্বর হেনরি কিসিঞ্জার মৃত্যুবরণ করেছেন। আর মৃত্যুর আগে শেষবারের মত ১৮ অক্টোবর তিনি ওয়ার্ল্ড ডট মাইন্ডস নামক অলাভজনক একটি ফাউন্ডেশনে ভার্চ্যুয়াল এক আয়োজনে অংশ নিয়ে কথা বলেছিলেন। এ সময় আরও ২৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিলেন। তাদেরও ছিল কিসিঞ্জারকে নিয়ে নানান বিষয়ে প্রশ্ন। নায়াল ফার্গুসন, স্টিফেন কোটকিন, বিল অকম্যান ও নেরি অক্সম্যানের মত বিখ্যাত স্থপতি ও শিল্পীগণসহ ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ওই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি চ্যাথাম হাউজ রুলস মেনে হওয়ায় এ সময় পূর্ব নির্ধারিত কোনো প্রশ্ন কিসিঞ্জারকে করা হয়নি। আমরা সম্প্রতি চলমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছি। পরে তার সাক্ষাৎকারটি ২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পলিটিকোতে প্রকাশ করা হয়। এ আয়োজনে কিসিঞ্জারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ডট মাইন্ডসের প্রতিষ্ঠাতা সুইস উদ্যোক্তা ও দ্য আর্ট অব থিঙ্কিং ক্লিয়ারলি বইটির রচয়িতা রল্‌ফ ডোবেলির। 

সাক্ষাৎকারটির সম্পাদিত ও বিশেষ অংশ তুলে ধরা হল 

প্রশ্ন: আমরা দেখতে পাচ্ছি, হামাসের বিরুদ্ধে পূর্ণশক্তি নিয়ে ইসরায়েল জবাব দেয়া শুরু করেছে। আপনি যদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর স্থলে থাকতেন, তবে কী বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাতেন?

কিসিঞ্জার: দেখুন, আমি নেতানিয়াহুর জায়গায় নেই। আর তাই তার ওপর প্রভাব ফেলবে বা বিব্রত করতে পারে এমন কোনো কথা দিয়ে এ মুহুর্তে সব শক্তির বিচার আমি করতে সক্ষম নই। আমি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। তবে আমি হামাসের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িয়ে কোনো শান্তিপূর্ণ ফলের আভাস পাচ্ছি না। আমি মনে করি আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আসতে পারে। বিশেষ করে এ ঘটনার (সর্বশেষ সংঘাত) পর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সরাসরি আলোচনা হলেও খুব একটা যে ফলপ্রসূ, আশাবাদী কিছু একটা হবে বলে আমি মনে করি না।

প্রশ্ন: মধ্যপ্রাচ্যে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বাইরে গিয়ে কখনো স্থায়ী শান্তি আসতে পারে?

কিসিঞ্জার: আনুষ্ঠানিক শান্তি কখনই স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা আনতে পারে না। হামাসের বিষয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাতে বুঝা যাচ্ছে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান জটিল বিষয়। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের শাসনামলে একটি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সম্ভাবনার বিষয়ে পরীক্ষামূলকভাবে গাজাকে আধা স্বাধীন করা হয়েছিল। তখন বাস্তবে দেখা যায় উদ্ভূত পরিস্থিতি আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে। এমনকি ২০০৫ সালের পরিস্থিতির চেয়েও গত দুই বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠেছে। সুতরাং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না যে আমরা গত সপ্তাহগুলোতে যা ঘটতে দেখেছি, তা আবার ঘটবে না।

প্রশ্ন: ক্ষণিকের জন্য জন্য কল্পনায় আনুন আপনি এ মুহুর্তে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আর আমরাও বর্তমান সময় থেকে কয়েক মাস সামনে এগিয়ে রয়েছি। এটা কী আশা করা যেতে পারে হামাসের হাত থেকে ইসরায়েল রেহাই পেয়েছে। এরপর আমরা কী করব? গাজার কী হবে? ইসরায়েল কীভাবে নিজেকে বিশ্বের মধ্যে নিরাপদ অবস্থানে থাকবে? এমন একটি ফলালফল পেতে আপনি কীভাবে আলচনা করবেন?

কিসিঞ্জার: দেখুন আমি বিশ্বাস করি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে না হেঁটে পশ্চিম তীরকে জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিন। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উৎখাতকারী সংঘবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ একটি অঞ্চল একেবারেই চলে গেল। আর মিসর আরবদের একদম কাছে চলে যাওয়ায় ইসরায়েলের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ বেশ কঠিন। আমি আশা করি সবকিছু শেষে শেষে একটি আলোচনা হবে। কারণ, আমি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় যা ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ নামে পরিচিত সেসময়েও আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম। সে সময় প্রতিবেশী অন্যদের শক্তির তুলনায় ইসরায়েল শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। তবে বর্তমানে এই অব্যাহত সংঘাত প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। 

প্রশ্ন: আপনি কী মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি তাদের দৃঢ় সমর্থন দেখাতে বেশি আগ্রহী?

কিসিঞ্জার: এটা ছাড়া তো কিছু দেখছি না, তাই করতে হবে।

প্রশ্ন: আমার কাছে মনে হচ্ছে, হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে ইসরায়েলে হামলা চালালে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থা নেবে। হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে ইসরায়েলে হামলা পরিচালনা করলে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থা নেবে এমন কোনো বার্তা দিচ্ছে না বাইডেন প্রশাসন। বরং এর পরিবর্তে যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে তাতে অনেকটা ইরানকে খুশি করার মত বলে মনে হচ্ছে। এমন বোঝানো হচ্ছে যে, হামাসের হামলায়  ইরানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নেই। আজ যদি আপনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতেন, তবে ইরানকে ভিন্ন বার্তা দিতেন?

কিসিঞ্জার: আমি মনে করি এটা তারা চাইলেই করতে পারে। ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর হাতে কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এটি বিপজ্জনক বিষয়ের সংমিশ্রণ। 

প্রশ্ন: ইউক্রেনে রাশিয়ার সমস্যা থেকে সবার নজর সরাতে আংশিকভাবে রাশিয়া কী মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক আকারে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে ? 

কিসিঞ্জার: ইউক্রেন যুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে আরব সংঘাতের কারণে দেশটি ইসরায়েলের পক্ষে ছিল। রাশিয়া এখন যদি হস্তক্ষেপ করে, তবে দুটি বিকল্প পথ রয়েছে তার জন্য, আর তা হলো আরবদের পক্ষে যুক্ত হওয়া কিংবা সংকটকালীন সময়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের জানান দেয়া। তবে এমনটা আবার ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অদ্ভুত বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

প্রশ্ন: বর্তমান সংকটের ফলে তাইওয়ানে চীনের আক্রমণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে? গত কয়েক সপ্তাহ আগেও সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ছিল।

কিসিঞ্জার: আমার মনে হয়, চীন এরকম সংঘাতের জন্য প্রস্তুত নয়। এটি একটি তাত্ত্বিক সুযোগ চীনের জন্য। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীন সম্পর্ক স্থাপনের ভাল একটা সক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমাদের অধিক মনোযোগী হওয়া দরকার যাতে করে বর্তমানে যেমন মনোভাব তৈরি হচ্ছে তাতে যেন বিষয়টি অসম্ভব না হয়ে যায়।

প্রশ্ন: তাহলে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী হওয়া উচিত?

কিসিঞ্জার: যুক্তরাষ্ট্রের উচিত চীনের সঙ্গে সবকিছু মিটমাট করে ফেলা। 

প্রশ্ন: নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় অর্জন ছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিতাড়িত করা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোভিয়েতদের তাড়াতে আপনার যতটা সুনাম রয়েছে তার অধিক খ্যাতি আপনি অর্জন করেছেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মপধ্যদিয়ে। আমাদের কি এখন সময় এসেছে রাশিয়া বা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বের করে দেয়ার? এটি কি একটি ভালো পদক্ষেপ হবে বা এর মাধ্যমে কি বর্তমান সংকটসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে?

কিসিঞ্জার: মূলত চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তির ওপর নির্ভর করছে এসব শক্তিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিতাড়িত করার সক্ষমতা রয়েছে কী না বা তাদের ইতিবাচক ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করা হবে কী না। দেখছি যেটা এই সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে না। এ মুহুর্তে রাশিয়ার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, তাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তারা যা বলছে বা ভাবছে আমরা তা শুনিনি আর এটির কারণ রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের কোনো সংলাপ নেই।

প্রশ্ন: ১৯৯০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যকার দশকের দিকে যদি ফিরে যাই দেখা যায়, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হিসেবে সময়কালটি তুলনামূলক শান্ত ছিল। আমরা কেন সৌহার্দ্যপূর্ণ ও খোলামেলাভাবে বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে বর্তমান সময়কে আরও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব তৈরির দিকে যাচ্ছি না? 

কিসিঞ্জার: দেখুন, কে বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ করে তোলার এই কাজটি করবে বা কার করা উচিত? মধ্যপ্রাচ্যের দিকে আসুন, যদি মিসর, সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলো মৌলবাদ ও উগ্রতা দর্শনের অনুসারীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ তৈরিতে ইচ্ছুক হতো, তাহলে সেটির মাধ্যমে সর্বোত্তম একটা ফলাফল পেতা পারতাম আমরা। কিন্তু আমার শঙ্কা, গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলি বরং তাদেরকে আরও উগ্র মনোভাবের দিকে পরিচালিত করতে বাধ্য করবে আর এটি এমন এক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করতে পারে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে সমীকরণের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

প্রশ্ন: আমাদের মধ্যে বিশ্বে নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। নেতৃত্বের এই সংকট যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, রাশিয়ায়ও আছে। আপনার দৃষ্টিতে ভবিষ্যতের নেতাদের জন্য কেমন গুণাবলী থাকা উচিত বলে মনে করেন?

কিসিঞ্জার: বিশ্বনেতারা ব্যর্থ হয়েছেন। তার সকলেই অকার্যকর ধ্যানধারণাগুলো বাতিল করে মৌলিক ও প্রাত্যহিক কৌশল আয়ত্তে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ক্রমাগত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত পুষে না রেখে সমাজের জন্য সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা দরকার ছিল আর এটাই চ্যালেঞ্জ। আমরা ক্রমাগত ও অব্যাহতভাবে একের পর এক সংঘাতের মুখোমুখি হচ্ছি, বড় বড় যুদ্ধ দেখছি। ফলে এত দিনের গড়ে ওঠা সভ্যতার বড় একটা অংশ এবারে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। 

প্রশ্ন: ড. কিসিঞ্জার, আপনাকে এখনও ১০০ বছরের তরুণ লাগে দেখতে। আমরা দেখি আপনি সবসময় প্রাণবন্ত থাকেন, এর নেপথ্যেররহস্য কী?

কিসিঞ্জার: আমি আমার মা–বাবার কাছ হতে উত্তরাধিকারসূত্রে ভালো জিন পেয়েছি মনে করি। তাদের ধারা বেশ ভালোভাবেই হয়ত নিজের মধ্যে পেয়েছি। 

প্রশ্ন: আপনার পরিকল্পনা কী?

কিসিঞ্জার: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে যুক্ত হওয়া ও যেসব বিষয়ে যুক্ত হলে কিছুটা অবদান রাখতে পারব এমন কিছু ছাড়া আমার আর কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। 

সূত্র: পলিটিকো 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //