অতৃপ্তি শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে: রফিকুন নবী

২৮ নভেম্বর শিল্পী ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবীর আশিতম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেছেন- দীপান্ত রায়হান...

অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের তুলনায় চিত্রশিল্পীরা খুব কম জনপ্রিয় হতে পারেন। আপনি সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
জনপ্রিয়তা কিনা জানি না তবে দীর্ঘ এই জীবনে মানুষের ভালোবাসায় আমি অভিভূত। একটা বিষয় বলে রাখি, আমাকে সবাই যতটা বড় শিল্পী ভাবে আমি নিজে তা ভাবি না। এই ৮০ বছর বয়সে এসে ভাবি অনেক কাজ করা বাকি রয়েছে। আমি যদি তা না করতে পারি পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা তা করবে। বাংলাদেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষের মতো সহজ জীবন যাপন করে না। তাদের অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়, চিন্তা করতে হয়। অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে যেতে হয়। আমিও এভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিলাম। নিজে যে কাজগুলো করতে চেয়েছি কিন্তু সমাপ্ত করতে পারিনি সেই কাজগুলোর জন্য আফসোস হয়। মনে হয় আমার সময় ফুরিয়ে যাবে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।

এটা কি আপনার সামগ্রিক কাজের অতৃপ্তির কারণে? মানে আপনি আপনার কাজে সন্তুষ্ট নন?
অতৃপ্তিই বটে। এটা মন্দ না। এই অতৃপ্তি একজন শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে। কর্মমুখর রাখে। সব শিল্পীরই এ অতৃপ্তিটা থেকে যায়। প্রতিটি ছবি আঁকার সময় মনে হয়, এটিই বোধহয় আমার শ্রেষ্ঠ কাজ হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। এ অতৃপ্তি নিয়েই শিল্পীদের বিদায় নিতে হয়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতো শিল্পীরাও এ অতৃপ্তি নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন। পাবলো পিকাসো মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, যা করতে চেয়েছিলাম, হলো না। পারলামই না। জয়নুল আবেদিন মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন যে অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল। হলো না। আমারও সে অতৃপ্তি আছে। আমার শ্রেষ্ঠ কাজ কোনটি হবে তা এখনো জানি না। হয়তো কোনোদিন হতে পারে।

শিল্পচর্চা ছাড়া জীবনে আর কোনো ক্ষেত্রে অতৃপ্তি আছে?
আশি বছরকে আমার সুহৃদরা যতটা আনন্দের মধ্য দিয়ে উদযাপন করছেন আমার মনে হয় তা ঠিক আমার জন্য অতটা আনন্দের নয়। এর মাঝে পঁয়ষট্টিটি বছরই শিল্পের সঙ্গে কেটেছে। এই পথচলা সহজ ছিল না। আমরা এই দেশের মানুষেরা সব সময় সহজে পথ চলতে পারি না, পারিনি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলতেন, ‘এই পথ চলতে গিয়ে যে মানুষের কাছে থেকে শিখতে হবে। মানুষের প্রতি সহমর্মী হতে হবে।’ এই কথা তিনি বলতেন, কারণ তিনি নিজে ছিলেন একজন মানবিক শিল্পী।

কার্টুন আঁকার শুরুটা কীভাবে?
আমাদের সময় ছাত্ররা সমাজ, রাজনীতি এবং পরিপাশ্বিক বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তখন চারুকলায় পড়তে এসে শিক্ষক শিক্ষার্থী সবাই ছবি আঁকার পাশাপাশি রাজনীতি সচেতন, সমাজ পরিবর্তন নিয়ে ভাবছে। আমিও ছাত্রাবস্থাতেই ছবি আঁকার পাশাপাশি সবাই সমাজ সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করি। সেখান থেকেই আমি দেশ, মানুষকে ভালোবাসতে শুরু করি। আমরা সংগ্রামী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠি। ছবি আঁকতে গিয়ে দেখি সব বিষয় ছবিতে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। যা কার্টুনে সরাসরি বলা যায়। এভাবেই কার্টুন আঁকার শুরু।

আপনার টোকাই চরিত্রটি এখন মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এটাও তো কম সাফল্য নয়...
ধুর, কী যে ভাবো তোমরা! এটাকে কি শিল্পের সাফল্য বলা যায়? শোনো, জয়নুল স্যারের কথা ভাবো। ঐ যে গরুর গাড়ি ঠেলার একটা ছবি আছে। গাড়িটা কাদায় আটকে গেছে। পোড়ামাটির মধ্যেও এই কাজটা দেখবা সবখানে পাওয়া যায়। পাট দিয়ে পাতলা বাঁক দিয়ে কিংবা কাঠের মধ্যেও এই ছবিটার রেপ্লিকা দেখেছি। লোকজন এগুলো কেনে। ঘরে সাজিয়ে রাখে। একটা পেইন্টিং কতটা শক্তিশালী হলে এটা সম্ভব! সাধারণ লোকশিল্পীরা নানা ফর্মে ছবিটা আঁকার চেষ্টা করে। এখানেই শিল্পের সার্থকতা বা সাফল্য। টোকাই শেষ পর্যন্ত শিল্প হয়ে উঠেছে কিনা জানি না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //