লেখক বছরের পর বছর বৃষ্টির জন্য বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন: পল লিঞ্চ

বুকার প্রাইজ-২০২৩ এর জন্য এবারে মনোনীত হয়েছেন আয়ারল্যান্ডের সাহিত্যিক পল লিঞ্চ। তার অনবদ্য সৃষ্টি ‘প্রফেট সং’ এর জন্য তিনি এবছর মনোনয়ন পেয়েছেন। চলতি বছরের আগস্টে তিনি তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে খোলাখুলি এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। কীভাবে তিনি তার জীবন থেকে দেখা নানা চরিত্র আর অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে তার লেখা গল্প উপন্যাসে বাস্তবতামিশ্রিত পটভূমি রচনা করে থাকেন। পল লিঞ্চ প্রখ্যাত লেখক হিসেবে জটিল প্রেক্ষাপটের পটভূমিকায় সাহিত্য রচনা করে থাকেন। 

তার সাক্ষাৎকারটির বিশেষ অংশ তুলে ধরা হল:

বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পেরে কেমন লাগছে এবং এই পুরস্কার জেতার অর্থটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

‘কাভাফি’ কবিতার প্রথম কটা চরণ মনে পড়ছে, 

A few lines from the Cavafy poem ‘The First Step’ come to mind:   

And it is a hard and rare thing  

to be written into the roll-books there….  

To arrive at that point is no small feat  

ছোট-বড় প্রতিটি পুরস্কারই লেখকের জন্য আশীর্বাদ। লেখকের ঘরকে আমি নিঃসঙ্গ মনে করে থাকি। আর একটি উপন্যাস লিখতে অনেক সময় লেগে যায়। একজন সংগীতশিল্পী বা অভিনেত্রী রাতের মঞ্চ আলোকিত করেন, সবার করতালি নিয়ে নিজেকে তৃপ্ত করেন কিংবা একজন চলচ্চিত্র তারকা যিনি কিনা আলোর মাঝে নিজের নামটি দেখেন। কিন্তু একজন লেখক বছরের পর বছর ধরে বৃষ্টির জন্য বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাই একটি মনোনয়ন বা একটি পুরস্কার, কিছু উচ্চস্বরে করতালি মহাবিশ্বের আলাদা একটি অনুভূতি। আর বুকার অবশ্যই এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি পর্যায়।

‘প্রফেট সং’ লিখতে কত সময় লেগেছে এবং আপনার লেখার প্রক্রিয়া কেমন ছিল? আপনি কী টাইপ নাকি  লংহ্যান্ডে লিখেন? একাধিক খসড়া, দীর্ঘ বিরতি বা বিশেষ কোন কাজের বড় রকমের স্মৃতির কথা মনে পড়ছে? আপনি লেখা শুরুর আগে গবেষণা এবং গল্প সাজাতে কীভাবে পরিকল্পনা করে থাকেন?

লেখাটি শেষ করতে আমার দীর্ঘ চার বছর লেগেছে। কোভিড মহামারি এবং স্বাভাবিক সময় সব মিলিয়ে এই সময় লেগেছে। লেখাটি শুরু করার আগে আমার ছেলে এলিয়টের জন্ম। মনে আছে লেখার শেষের দিকে সে একটি বাইক চালাচ্ছিল। আমি লিখি সপ্তাহে পাঁচ দিন করে, দিনে কয়েকশ শব্দের বাইরে নয়। যাতে তা নিয়ে গবেষণার সুযোগ থাকে, যে প্রক্রিয়ায় সহজেই সম্পাদনা সম্ভব। আর এভাবেই আমার প্রথম চূড়ান্ত খসড়াটি আমার কাছে চলে আসে। 

আমি এর আগে ছয় মাস ব্যয় করেছিলাম একটি ভুল বই লেখার জন্য। আর তা জেনেও একটি সাফল্যের আশায় পাথরের মধ্যে হাতুড়ি চালিয়েছি। তারপর কোন এক শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে আমি লেখা বন্ধ করে দেই এবং ভাবলাম এটা ভুল বই ছিল। ভাবলাম আমি সোমবার সকালে ফিরে নতুন বই শুরু করব। আমি বুঝতে পারছিলাম যে কিছু একটা মনের মধ্যে আছে যা দৃষ্টির বাইরে কিন্তু আমি জানতাম না এটা কী হতে পারে। সোমবার সকালে ম্যাক পেজে আমি একটি নতুন লেখা তৈরিতে মন দেয়া শুরু করি। জ্যানসন ফন্ট, ১.৫” মার্জিন, ১.৬ স্পেসিংয়ে লেখাটি শুরু করি। 

এই বছরের বুকার লিস্টে চারজন আইরিশ লেখক রয়েছেন যা আগের বছরের চেয়ে বেশি। অনেকেই মন্তব্য করছেন হয়ত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারত। আয়ারল্যান্ডে একটি সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ঐতিহ্য রয়েছে, কিন্তু বর্তমানে প্রচুর উত্তেজনাপূর্ণ বেশ কিছু সাহিত্য দেখা যাচ্ছে– কেন এমনটা হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

রাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া এর কিছুই সম্ভব নয়। দেখুন, এই বইটি লেখার জন্য চার বছরে আমি দুটি আর্টস কাউন্সিলের বার্সারি পেয়েছি, সেইসাথে মেনুথের রেসিডেন্সিও পেয়েছি। আর এর ফলে শিল্পীদের আয়কর দেয়া থেকে অব্যাহতি লাভ করি। আপনি যদি আপনার নিত্যখরচের বিষয়গুলো থেকে নিজেকে কিছুটা মুক্ত রাখতে পারেন তবে আপনি নিজেকে পূর্ণ-সময় লেখার জন্য উৎসর্গ করতে পারবেন। আর যদি এটি দিনের পর দিন করেন তবে আপনার মস্তিষ্ক উপন্যাসের বলয়ের মধ্যেই থাকবে। আর আপনি আপনার সেরা কাজটি তৈরিতে সক্ষম হবেন।

আপনি ছোট স্বাধীন প্রকাশকদের দ্বারা প্রকাশিত দীর্ঘ তালিকার বেশ কয়েকজন লেখকের মধ্যে একজন– আপনার ক্ষেত্রে যদি বলি যে একজন প্রকাশক যিনি আগে দুবার বুকার জিতেছেন। আপনার কাছে এটির  কী অর্থ দাঁড়ায় এবং একজন লেখক হিসাবে আপনাকে কিভাবে প্রভাবিত করে?

জুলিয়েট মাবে আমার ‘ওয়ানওয়ার্ল্ডের’ প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি যে বইগুলি প্রকাশ করেছেন তা এই গত এক দশকে যুক্তরাজ্যে প্রায় প্রতিটি বড় পুরস্কার জিতেছে ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। অ্যানি ডিলার্ড একবার লিখেছিলেন যে ভাল লেখকরা টেনিস খেলোয়াড়দের মতো কোর্টের এক প্রান্তে খেলেন। 'সেটিকেই উচ্ছ্বাস' আর 'লাইন আপ হিট’ বলে একজন লেখক মনে করতে পারেন। 

‘প্রফেট সং’ একটি ডাইস্টোপিয়ান আয়ারল্যান্ডকে উপস্থাপন করেছে। একটি সরকার কতটা নির্যাতনের পথে হাঁটতে পারে সেটিকে চিত্রিত করে। আপনার দেশের প্রেক্ষিতে এই উপন্যাসটির ভিত্তি কী? লেখার জন্য কোন বিষয় আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং এটি কি বাস্তব-বিশ্বের কোনো ঘটনা দেখে  অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?

আমি আসলে আধুনিক যুগের একটি বিশৃঙ্খলা দেখার চেষ্টা করছিলাম। পশ্চিমা গণতন্ত্রে অস্থিরতা। সিরিয়া সমস্যা, কীভাবে একটি সমগ্র জাতির বিলুপ্তি হচ্ছে, উদ্বাস্তু সংকটের মাত্রা এবং পশ্চিমাদের উদাসীনতা। ইউক্রেনে আগ্রাসন তখনও শুরু হয়নি। আমি সিরিয়া সম্পর্কে সরাসরি লিখতে পারিনি তাই আমি একটি সিমুলেশন হিসাবে আয়ারল্যান্ডের সমস্যা তুলে ধরেছি। বইটি এমন একটি সমস্যার সাথে শুরু হয়েছিল যার মুখোমুখি ল্যারি স্ট্যাক হয়েছিলেন আর তখন আপনি কিভাবে প্রমাণ করবেন যে একটি গণতান্ত্রিক কাজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ নয়-এমন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উপন্যাসটি জটিলতার মধ্যদিয়ে নিজেই নিজের যুক্তি তৈরি করেছে পাঠকদের উপলব্ধির জন্য।

বুকার বিচারকরা বলেছিলেন যে উপন্যাসটি 'আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক উদ্বেগ' এর প্রকাশ ঘটিয়েছে। তবে গল্পটি কী একটি সতর্কতামূলক হিসেবে কোনো প্রেক্ষাপটের উদ্দেশ্য?

অডেন একবার বলেছিলেন, 'কবিতা কিছুই ঘটায় না'। গভীরভাবে আমি মনে করি তিনি সঠিক এবং আমি কল্পকাহিনীকে অপছন্দ করি যা কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়। একজন নাগরিক হিসাবে আমি সেই মূল্যবোধের সাথে একমত। ‘প্রফেট সং’ লেখার সময় আমি খুব মনোযোগ দিয়ে ভাবছিলাম শিল্পকর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। ভাবছিলাম দুঃখ নয়– অভিযোগ, অন্ধত্ব এবং জটিলতা নিয়ে যা হয়ত ততটা প্রকাশ করতে পারিনি। 

এই বইটি লেখার সময় আমি সচেতন ছিলাম যে আমি একটি আধুনিক সমস্যাকে সম্বোধন করছিলাম। কেন পশ্চিমে আমরা আমাদের সীমান্তের দিকে বন্যার উদ্বাস্তুদের প্রতি কম সহানুভূতিসম্পন্ন? আমি সচেতন ছিলাম লেখার সময় যাতে আধুনিক সমস্যাগুলো উপস্থাপন করতে পারি। পশ্চিমাদের নীরবতা, শরণার্থী সমস্যা, আমাদের সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসা বন্যা– এসব কিছুর বিষয়ে। ‘প্রফেট সং’ আংশিকভাবে মৌলিক বিষয়গুলোকে তুলে ধরার একটা উপাখ্যান। আরও ভালভাবে বোঝার জন্য প্রথমে আমাদের নিজেদের সমস্যাটি অনুভব করতে হবে।

উপন্যাসটিতে দেখা গেছে একজন নারী তার স্বামীকে আটকের পর তার পরিবারকে একত্রে রাখার জন্য যা যা করা লাগে তা করতে বাধ্য হচ্ছেন। পুরো আখ্যানটি জুড়ে চরিত্রটির মধ্যদিয়ে চেতনাসমৃদ্ধ অনেক কিছু ওঠে এসেছে। আপনি কেন একজন মায়ের কণ্ঠ বেছে নিলেন বিষয়টি তুলে ধরতে? 

প্রকৃতপক্ষে গল্পে ‘চরিত্র’ বিষয়টি  আমার জন্য খুব কমই পছন্দ। তারা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে আর এটি নিয়ে লেখার একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে যার দাবি লেখক অস্বীকার করতে পারেন না। আর এমন একটি পরিস্থিতি হতে পারে যে বিষয়ে আমি আগ্রহী। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ‘প্রফেট সং’ একটি সামাজিক উপন্যাস হতে পারে যেখানে একটি পরিবারের ওপর ঘনিষ্ঠভাবে ফোকাস করা হয়েছে। যেখানে চরিত্রগুলো ভালভাবে ওঠে এসেছে। কিন্তু মনে হল খুব দ্রুতই যেন উপন্যাসটি এ বিষয়ে না বলছিল। আইলিশকে ঘিরেই বইটি ঘুরপাক খাচ্ছে যেটির মধ্যদিয়ে জীবনের অলিখিত ক্রিয়াকলাপের লুকানো অধ্যায়ের উত্থান, ক্রমাগত প্রশ্নের মুখে নানা জিজ্ঞাসা আর এতসব বিশাল শক্তির মধ্যে একজন ব্যক্তির কাছে কতটাইবা পথ থাকে? সে ক্ষেত্রে আমি বইটিকে রাজনৈতিকভাবে না ভেবে জীবন দর্শনের দিক থেকে ভাবতে বলব। 

আপনি এই মুহূর্তে কোন কোন বই পড়ছেন? আপনার দৃষ্টিতে এমন কোন লেখক রয়েছেন যাকে আপনি এই স্বীকৃতির যোগ্য মনে করেন?

নভেম্বরে জোনাথন কেপ প্রকাশিত সামান্থা হার্ভের অরবিটাল, এটি একটি বিস্ময় ছিল সবার কাছে। একটি নির্মল, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত এক সৃষ্টি ছিল এটি৷ আমি এটি পড়ার সময় বিস্ময়বোধ নিয়ে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার সংমিশ্রণ উপলব্ধি করেছি। দেখেছি কীভাবে বাক্যগুলোর অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্য ওঠে এসেছে পুরো বইজুড়ে। হার্ভে এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছেন যে স্থানটি শুধুই তার একার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হয়েছে। 

আপনার কাছে কী বুকার-বিজয়ী বা বুকার প্রাইজের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম এসেছিল এমন কোনো উপন্যাসের নাম মনে পড়ছে? আর যদি তাই হয়, তবে কোন দিকটি ভেবে এমন মনে হচ্ছে?

‘সেবাসটিয়ান বেরি’স এ লং লং ওয়ে’ (Sebastian Barry's A Long Long Way) সংক্ষিপ্ত তালিকার কথা বলা হলে এ বইটির কথা বলব। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি হতভম্ব হয়েছিলাম বইটি পড়ার সময়। আমার প্রপিতামহ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে আজীবন সদস্য হিসবে কর্মরত ছিলেন। তিনি রয়্যাল ফিল্ড আর্টিলারিতে একজন সার্জেন্ট মেজর হিসাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আমার কল্পনায় সর্বদা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাগুলো হৃদয়কে বিমোহিত করে রাখত। কিন্তু এ নিয়ে কখনই আমি উপন্যাস লিখব না কারণ সেবাসটিয়ানের বইটি এটির জন্য যথেষ্ট। 

আপনি পরবর্তীর জন্য এখন কোন কাজ করছেন?

আবারও আমি ভুল উপন্যাস নিয়ে কাজ করছি বলব। কিন্তু সম্প্রতি একটি সত্য বই প্রকাশের দিকে আমার মন-আত্মা ঝুঁকে গেছে। আমি এখন ৮০০০ শব্দের মধ্যে আবিষ্ট আছি। এ নিয়ে এ মুহূর্তে বেশি কিছু বলতে পারছি না। ভয় হয় পাছে না আমার লেখার বানানগুলো নষ্ট হয়ে যায়! যদিও আমি বলব যে এটি প্রথম ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাস।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //