আত্মবিশ্বাসই আমাকে পথ চলতে সাহায্য করে: নাজমা কবীর

চিত্রশিল্পী নাজমা কবীর, রঙ-ক্যানভাস আর তুলির জগতে যার চিরকালীন বসবাস। সম্প্রতি সেই মানুষটির আঁকা চিত্র নিয়ে ‘অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস’-এ শুরু হয়েছে তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী ‘লাভ ফর নেচার: আ সেলিব্রেশন অব প্যাশন’। দুই সপ্তাহব্যাপী এই চিত্র প্রদর্শনীতে অবিন্তা গ্যালারির দেয়ালে স্থান পেতে যাচ্ছে শিল্পী নাজমা কবীরের সর্বমোট ৬২টি জলরঙ ও অ্যাক্রিলিক চিত্রকর্ম। চিত্রশিল্পের বাইরে তিনি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে দুই দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। তিনি তার চিত্রকর্ম নিয়ে সম্প্রতি আড্ডায় মজেছিলেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উপ-সম্পাদক নাসরিন আখতার...  

ছবি আঁকা কখন শুরু করেন?
আমি ছবি আঁকা শুরু করি আমার পাঁচ বছর বয়সে। তখন আমরা আজিমপুর কলোনিতে থাকতাম। উদয়ন স্কুল যেখানে শুরু হয়েছিল, সেখানে তার আগে লেডিস ক্লাব ছিল। আমার মা ও ছোট খালা সেখানে যেতেন। লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই পড়ার জন্য নিয়ে আসতেন। খালা সেলাই করা শিখতেন। সেখানেই খবর পেলেন, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের গান, নাচ ও ছবি আঁকার ক্লাস শুরু হবে। আমার বড় বোন গান গাইতে চাইল। আর আমি ছবি আঁকার ক্লাসে ভর্তি হলাম। পরের বছর আমরা ধানমন্ডির সোবহানবাগ মসজিদের সামনের বাড়িতে স্থানান্তর হলাম। ঐ এক বছর বা তারও কম সময়ের জন্য একজন শিক্ষকের কাছে আমার ছবি আঁকার তালিম ও হাতেখড়ি হয়েছিল। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। 

এরপর ছবি আঁকা কি তাহলে আপনার হবি বা শখ হয়ে গেল?
ছবি আঁকা আমার শখ হিসেবেই থেকে গেল। এর কারণ ছিল, আমার বয়স যখন ১২ বা ১৩ ছিল, সেই সময় আমার বাবা জাপানে গিয়েছিলেন অফিসের কাজে। আমার জন্য একটি দারুণ ছবি আঁকার ব্যাগ এনেছিলেন, যার ভিতরে রং, তুলি ও নানা রঙের পেন্সিল ছিল। সেই উপহার পেয়ে আমার ছবি আঁকার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। তখনকার দিনে আব্বার Readers Digest-গুলো ঘেঁটেঘুঁটে সুন্দর সুন্দর ছবি খুঁজতাম। সেগুলো আঁকার চেষ্টা করতাম। শখ হিসেবেই ছবি আঁকাকে ধরে রেখেছিলাম স্কুল ও কলেজ পর্যন্ত। পরবর্তীতে পড়াশোনা, চাকরি ও পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে তেমন করে ছবি আঁকা আর হয়ে ওঠেনি। 

আপনার চাকরি জীবন কি কোনোভাবে আপনার ছবি আঁকার ইচ্ছাকে সাহায্য করেছে?
আমি প্রায় পঁচিশ বছর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। কাজের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেতে হয়েছিল। আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ দেশগুলোতে যেতে হতো। পৃথিবীর অসাধারণ ও সুন্দর দেশগুলো দেখবার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন শুধু ছবি তুলতাম। মনে মনে ভাবতাম, এসব সৌন্দর্য কি কখনো আমার ক্যানভাসে আঁকা সম্ভব হবে? ছবি আঁকার সময় ছিল না বলে, ফটোগ্রাফিকে শখ হিসেবে গণ্য করলাম। নিজের তোলা ছবিগুলো দিয়ে একটি বই ছাপালাম। এখন একজন শিল্পী হিসেবে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি আমার চিত্রপটে প্রকৃতি তুলে ধরতে, যেখানে একাধারে উঠে আসে সাগরের নীল জলরাশি থেকে শুরু করে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মাখা সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়। পাশাপাশি শহুরে জীবনের দৈনন্দিন দৃশ্য, ফুলের বাগান এবং মনের সকল ভাবনা তুলির ছোঁয়ায় আনার প্রচেষ্টা থাকে আমার প্রতিটি ছবিতে। 

আমার প্রতিটি চিত্রকর্মের অনুপ্রেরণা কাজ করে আমার ভ্রমণকালীন সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে দেখা বিভিন্ন অপরূপ দৃশ্য ও ধারণকৃত চিত্র হতে। এভাবেই দেশ বিদেশের নানারকম প্রাকৃতিক দৃশ্য আমার ছবির পটভূমি হিসেবে স্থান পায়। 

আবার নতুন করে কবে থেকে ছবি আঁকা শুরু করলেন?
বহু বছর দেশে বিদেশে চাকরি জীবন কাটিয়ে ২০১৬ সালে আমি অবসর নিয়ে, আবার পড়াশোনা করি। আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য এক বছরের একটি ডিপ্লোমা কোর্স করি লন্ডনে। শেষ পড়াশোনা করেছিলাম তারও ২৫ বছর আগে। সুইডেন থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে পিএইচডি করি। পড়ার অভ্যাস এতগুলো বছর পরে আবার গড়ে তোলা সহজ ছিল না। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের এই কোর্সটিই আমাকে শেখাল কী করে নিজের লক্ষ্য ঠিক করে এগোতে হয়। এই কোর্স শেষ করার পর আমার হাতে প্রচুর সময় ছিল। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে নতুন নতুন অনেক কিছুই করা শুরু করলাম। যেমন- গান গাওয়া, গিটার বাজানো, কবিতা লেখা, বাগান করা, ছবি তোলা, এবং নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। হঠাৎ করেই মনে হলো, সেই ছোটবেলার শখটি আরেকবার চেষ্টা করে দেখি। ছবি আঁকা শুরু করলাম। রং, তুলি, ক্যানভাস কিনলাম। শুরু হয়ে গেল এক নতুন চিত্রশিল্পীর জীবন। 

ছবি আঁকা কি এখনো শখ? নেশা নাকি পেশা?
‘দুটোই’ বলতে চাইলেও তা পারছি না। শখ হিসেবেই ছবি এঁকে যাচ্ছি। লন্ডনে অবস্থিত একটি আর্ট সোসাইটির সদস্য হয়েছি। ওদের মাধ্যমে প্রতিবছর লন্ডনে আমার আঁকা ছবির প্রদর্শনী করি। ঐ প্রদর্শনীর মাধ্যমেই আমার আঁকা ছবি বিক্রি হয়। আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। আমি আমার শিল্পকর্মে জলরং এবং অ্যাক্রিলিক পেইন্টিং ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যানভাসে আমার প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করে থাকি। ছবি আঁকা এখন আমার নেশা। জলরং বা অ্যাক্রিলিক ছবি আঁকতে যা খরচ হয়, তা উঠানো খুব মুশকিল। সব শিল্পীই এই সমস্যার মাধ্যমেই শিল্পকর্ম চালিয়ে যান। বড় মাপের শিল্পীদের কথা আলাদা। তাদের নামই যথেষ্ট হয় ছবি বিক্রি করার ক্ষেত্রে। আমার পেশাগত কর্মজীবন শেষ, তাই এই অবসরের সময়টুকু আনন্দের সাথে ছবি এঁকে যাব সেটাই ইচ্ছা। নেশার মধ্যেই তো সব আনন্দ, তাই না? 

কার ছবি আপনাকে বেশি প্রভাবিত করে?
আন্তর্জাতিক মানের শিল্পীদের মধ্যে ‘মনে’ (Monet), ভ্যান গঘ (van Gogh), গুস্তাব ক্লিমট্ (Gustav Klimt) আমার প্রিয়। আর আমাদের দেশের কামরুল হাসান, জয়নাল আবেদিন, সাহাবুদ্দিন, যাদের আঁকা ছবি সহজেই চিনতে পারি, তাদের ছবি দেখতেও ভালো লাগে। আজকাল ইউটিউবের মাধ্যমে অনেক দেশি-বিদেশি শিল্পীদের শিল্পকর্ম দেখতে পাই। এর মধ্যে আমার অনেক প্রিয় ও পছন্দের শিল্পী আছে, যাদের কাজ আমার ছবি আঁকার জন্য দারুণ উৎসাহ জোগায়। বিনে পয়সায় ছবি আঁকা শেখার জন্য অনেক ভিডিও আছে। সেসব দেখেই আমি আমার চলার পথকে সহজ করে নিয়েছি। এসব বড় শিল্পীরা অন্যদের শেখাতে এতটুকুও কার্পণ্য করে না। কী অসাধারণ ও নিখুঁতভাবে বিভিন্ন পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। আমি তো নেশার মতো ঐ সব ভিডিও দেখে নানারকমভাবে ছবি আঁকা, রং মেশানো, জলরঙের বিভিন্ন কাগজের গুণাবলি ও তুলির ব্যবহার ইত্যাদি শিখেছি। 

নবীন, প্রবীণ বা আগ্রহী শিল্পীদের প্রতি আপনার কি কোনো বক্তব্য আছে?
আজ আমি আমার সফল কর্মজীবন শেষ করে অবসর জীবন পালন করছি। অবসর নেওয়ার মানে এই নয় যে, ঘরে বসে, রান্নাবান্না করে, টিভিতে সিরিয়াল দেখে সময় কাটাব। আমি প্রথম থেকেই জানতাম যে একেবারে নতুন কিছু না করে এমনি এমনি বসে থাকা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য অনেক কিছুই শুরু করেছিলাম। কিন্তু এই ছবি আঁকাতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, অনেক আনন্দ পাই। প্রতিদিন ছবি আঁকি। এখন এই অভ্যাস ইচ্ছা করলেও ত্যাগ করতে পারি না। 

তাই নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই বলব, বয়স কোনো বাধা নয়, সময় কোনো বাধা নয়, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। ছবি আঁকার জন্য ইচ্ছাই যথেষ্ট। একটা লক্ষ্য স্থির করুন। চলতে থাকুন। ছবি আঁকার সময়গুলোতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মনের দুঃখ, কষ্ট সব অনেক দূরে চলে যায়। এক প্রশান্তির ছায়া আমাকে ঢেকে রাখে। আমি এক আনন্দের মহা সমুদ্রে ডুবতে থাকি । 

বাংলাদেশে কি এই প্রথম আপনার আঁকা ছবির প্রদর্শনী হলো?
না, এর আগেও আমি বাংলাদেশের আরেকটি শিল্পকর্মের প্রদর্শনীতে ছবি দিয়েছি। সেই ছবি প্রথম দিনেই একজন কিনবেন বলে চিহ্নিত করে রাখলেন। এ ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেকেই লন্ডনের প্রদর্শনীতে যান এবং আমার আঁকা বেশ কয়েকটি ছবি কেনেন। 

বাংলাদেশে এই প্রথম দুই সপ্তাহব্যাপী আমার একক চিত্র প্রদর্শনী ‘প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা’ “লাভ ফর নেচার : আ সেলিব্রেশন অব প্যাশন” হতে যাচ্ছে ঢাকার অবিন্তা গ্যালারিতে। প্রদর্শনীতে আমার সর্বমোট ৬২টি জলরং ও অ্যাক্রিলিক চিত্রকর্ম থাকছে। 

আমার চিত্র প্রদর্শনীটি ১৯ নভেম্বর হতে ২ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত সবার জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টা হতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে। 

ছবি আঁকা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আমি এঁকে যাব যত দিন আমি সুস্থ থাকব। আমি নিজের আনন্দের জন্য আঁকি। নিজেকে সুস্থ রাখতে আঁকি। অনেক অভিজ্ঞ চিত্রশিল্পী আমার ছবির ‘গ্রামার’ দেখে হয়তো ভুল খুঁজবেন। কিন্তু একটা জিনিস আমি শিখেছি, ছবি আঁকাতে কোনো ভুল বা শুদ্ধ বলে কিছু নেই। একেক শিল্পী তার নিজের মনে যা অনুভব করে সেটাই প্রকাশ করে তার ক্যানভাসে। বড় বড় অনেক শিল্পী আছেন যারা কোনো একাডেমিক শিক্ষা ছাড়াই ছবি এঁকে নাম করেছেন। তবে বেসিক পারস্পেকটিভ, আলো ছায়ার খেলা, রং মেশানো ইত্যাদি, বিশেষ করে জলরঙের জন্য জানা খুবই জরুরি। আমি গত বছর লন্ডনে একটি কোর্স করি। এরপর দিল্লিতে আরেকজন পেশাদার শিল্পীর কাছে তালিম নেই। আর আমার অনলাইনের বিভিন্ন টিউটোরিয়ালগুলো তো আছেই। আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই এখন ছবি আঁকার পেছনে ব্যয় করছি। ছবি আঁকার পর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে রেখে দেই। অনেক বন্ধু সেগুলো দেখে, উৎসাহ দেয়। আরও ছবি আঁকি। যদি কারও ভালো লাগে বা আমার ছবি তার দেয়ালে রাখতে চায়, আমার চেয়ে খুশি বোধহয় তখন আর কেউ হতে পারে না। জীবনকে তখন পরিপূর্ণ মনে হয়। আমার শিল্পকর্মে যে শৈল্পিক মনোভাব আছে তা যদি কিছু শিল্পপ্রেমী মানুষকে ‘শিল্পচর্চায়’ উদ্বুদ্ধ করে, তাহলেই আমি সার্থক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //