আমার স্বপ্ন স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ: আশিকুজ্জামান টুলু

প্রিয় কবিতা, এই দূর পরবাসে, এমন অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী গানের স্রষ্টা আশিকুজ্জামান টুলু। বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতের একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিন দশক ধরে শ্রোতাদের মন জুগিয়েছেন তিনি। মাগুরা জেলার নাকোল গ্রামে জন্ম নেওয়া এই গুণী শিল্পী ১৯৮০ সালে সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজত্ব করেছেন এ দেশের ব্যান্ড জগতে। নিজস্ব গায়কী ইমেজ নিয়ে সফট রক ধাঁচের মেলোডিয়াস গান নিয়ে ‘চাইম’ ও ‘আর্ক’ ব্যান্ডের মাধ্যমে যিনি আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে আছেন। পরিশীলিত, মার্জিত ও অত্যন্ত প্রাণবন্ত এই শিল্পী বর্তমানে প্রবাসে রয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসছিলেন টুলু আর সে সময় সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে তিনি তার জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কীভাবে আজকের জনপ্রিয় সংগীত ব্যক্তিত্ব টুলু হয়েছেন সে গল্প জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাম্প্রতিক দেশকালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জাফর খান...

গানের প্রতি ভালোবাসা, শৈশবের স্মৃতি, সংগীত জীবনের শুরুর গল্প শুনতে চাই
আমার বেড়ে ওঠা একটি সংগীত পরিবারে। আমার বাবা ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন এ দেশের একজন স্বনামধন্য সংগীত শিক্ষক ছিলেন। বাচ্চাদের বেসিক সংগীত শিক্ষার জন্য একটি বই লিখে সে সময় তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। আমি শিশু-কিশোরদের দেখেছি আমার বাবার কাছে এসে গান শিখতে। ভোর থেকেই বাড়িতে হারমোনিয়াম, সুর-তালের লয়ে একটা অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হতো। নিজেকেও আর সংবরণ করতে পারিনি। তখন থেকেই তবলা বাজানো শিখতে থাকি। ১৯৭৬-৭৭-এর দিকে ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি- সে সময় বাবার অনুপ্রেরণায় ধীরে ধীরে তবলার তাল রপ্ত করি। পরে উদীচীতে যুক্ত হই। তবলার পরেই মন দেই ড্রাম বাজানো শিখতে। ১৯৭৮ সালে ড্রাম শেখার পর ১৯৭৯ সালে খালাতো ভাই জাহাঙ্গীরের কাছে গিটারের তালিম নেই। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোতে থাকি। 

প্রথম গানের অ্যালবাম কবে প্রকাশ হয়?
১৯৮০ সালে ‘গোল্ডেন হিটস অব জুলফিকার’ শিরোনামে আমার নিজস্ব প্রযোজনায় প্রথম অ্যালবাম, যা ছিল এ দেশের দ্বিতীয় ডিস্ক অ্যালবাম। আমার মনে আছে ৩০০০ কপি করেছিলাম। 

একক শিল্পী থেকে ব্যান্ড জগতের দিকে যাত্রার শুরুটা কীভাবে হলো?
আমি বিশ্বাস করি নেতৃত্ব মানুষের জিনগত একটা বৈশিষ্ট্য। হয়তো সবার মাঝে থাকে না। আমার মনে হয়েছিল যদি একটি ব্যান্ড গঠন করি তবে একা যা করতে পারব তার সঙ্গে আরও কিছু মানুষের গুণকে যুক্ত করে আরেকটি সৃষ্টিশীল ভুবন রচনা সম্ভব। আমি জানতাম আমার নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা হয়তো আছে আর সে ভাবনা থেকেই ১৯৮২ সালে ‘চাইম’ গঠন করি। ৯০ দশকের পর ‘আর্ক’-এর জন্ম। 

বর্তমানে প্রবাস জীবনে কর্মব্যস্ততার মধ্যেও গানের সঙ্গে কীভাবে নিজেকে যুক্ত রাখছেন?
আমার কাছে সংগীত মানেই হলো রক্তের সঙ্গে মিশে যাওয়া একটা বিষয়। একবেলা ভাত না খেয়ে আমি বাঁচতে পারব কিন্তু গানের জগৎ থেকে বাইরে থাকা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, প্রবাসে ‘ঐঁমব ঝপধষব’-এ হয়তো করতে পারছি না; কিন্তু গাইছি প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন প্রোগ্রাম, কনসার্ট কিংবা ঘরোয়া যে কোনো আসরে গানের জন্য শত কাজের মাঝেও আলাদা সময় রেখেছি। 

আপনার সুরের মধ্যে বিরহ, বিষাদ, নস্টালজিক গল্পের একটা ছোঁয়া থাকে, এ ধাঁচের কম্পোজকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়ার নেপথ্য কারণ কী?
আসলে একেক কম্পোজার একেকভাবে সুর সৃষ্টি করে থাকেন। আমার কাছে মাইনর স্কেলটা বেশি পছন্দের। আর এ স্কেলে কম্পোজ করতে গেলে সাধারণভাবেই একটা বিরহের সুর চলে আসে। যা শুনে হয়তো শ্রোতারা ভেবে থাকেন আমার ব্যক্তি জীবনে এমন বিরহ ব্যথা আছে কি না যা থেকে এমন সুর সৃষ্টিতে অধিক মনোযোগী! ফেলে আসা কষ্টের স্মৃতি সবারই কম-বেশি আছে। তবে আমার আসলে এই স্কেলের প্রতি একটা অদম্য টান আর ভালোবাসা থেকেই এমন সুর করে থাকি। 

টুলুর গল্প নামে আপনার একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, এর মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চান? 
আমি গান গাওয়ার পাশাপাশি ২০১২-১৩ সাল থেকে গল্প লেখা শুরু করি। তখন সবাই বলত আমি কেন আমার নিজের মিউজিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করছি না। এ থেকেই চ্যানেলের যাত্রা শুরু। যেখানে নিজ জীবনের সংগীত জগতে প্রবেশের শুরু থেকে আজ অবধি পুরো পথচলাটা কতটা বন্ধুর ছিল, বিফলতা, সফলতা, উদ্যম, অনুপ্রেরণা, পরিশ্রম সব মিলিয়ে এত দূর কীভাবে এসেছি সেই যাত্রার গল্পগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতেই এমন আয়োজন। আমি চাই নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের দেখাতে একসময় কত কষ্ট করে আমাদের সব শিখতে হয়েছে। এখনকার মতো ইউটিউব ছিল না, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ছিল না। কোনো গানের সুর, কথা এসব জানতে চাইলে অনেক কষ্ট করে তা জোগাড় করতে হতো আমাদের সময়ে। 

আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, এ যুগে মানুষের মধ্যে ‘অ্যাটেনশন স্প্যান’ কমে গেছে। মানুষ খুব বেশি পড়তে আগ্রহী না। কিছু শেখার জন্য ভিডিও বা ভয়েস ওভারের মাধ্যমে বিশেষ ঘটনা জানতেই বেশি আগ্রহী। এটাও আরেকটা কারণ এই জেনারেশনকে কমিউনিকেট করার জন্য। 

৮০-৯০ দশকের পর আপনাদের মতো গুণী শিল্পীরা যখন থেকে নতুন গান করা কমিয়ে দিয়েছেন এরপর থেকে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো গানের সুর, কথার খুব আকাল দেখা যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়? 
আমার একটা লজিক্যাল চিন্তা আছে- ভেবে দেখলাম আমরা যারা ৮০-৯০ দশকে গান করেছি তারা আমাদের শ্রোতাদের সঙ্গে করে নিয়ে চলে এসেছি। টাইম ফ্রেম একটা ইস্যু এ ক্ষেত্রে। আমরা যখন কাজ করতাম তখন বুঝতাম না সঠিক আর ভুলের পার্থক্য। ভালোবেসে একমনে কাজ করে যেতাম। এখন এসে দেখি আমরা বিশাল এক শ্রোতা তৈরি করে ফেলেছি। এ প্রজন্মের বিষয়টাও হয়তো তেমন। এখনকার শিল্পীদের গান যারা শুনছেন তারাও একসময় এই শিল্পীদেরই খুঁজবে ভবিষ্যতে যেভাবে আমাদের প্রজন্মের শ্রোতারা এখনো আমাদেরকেই মনে রেখেছেন। তবে এটা ঠিক, হয়তো হৃদয়গ্রাহী গান হচ্ছে না। তবে এ প্রজন্মও ভালো করার চেষ্টা করছে। 

গানের স্থায়িত্ব নির্ভর করে মেলোডির ওপর। ৭০, ৮০ বা ৯০ দশকের গানগুলো যেভাবে রিকল করি আমরা সেটার একটা ঘাটতি ভবিষ্যতে হতে পারে। মেশিননির্ভরতা কমিয়ে হিউম্যান টাচ ফিরিয়ে আনা খুব দরকার। 

নতুন প্রজন্মের জন্য আপনার বার্তা...
পুরনো বিখ্যাত দেশি-বিদেশি শিল্পীদের গান বেশি শোনা। তাদের কথা, সুর এসব নিয়ে গবেষণা করে সুরকে কীভাবে আত্মার মধ্যে ধারণ করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া। Music is a transferable process- এটাই পারে কেবল এক আত্মা থেকে আরেক আত্মায় আমার দর্শন, ভাবনা, কথার বিন্যাসকে দ্রুত নিউরন পর্যন্ত গেঁথে দিতে। অনেক রকমের ধারা থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে নতুন ধারা তৈরিতেও পুরনো ধারার সংযোগ লাগবে। 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে যদি বলেন...
আমার স্বপ্ন স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের। নিজ জীবনের কষ্ট, পরিশ্রম, অভাব-অনটন, সফলতা, সচ্ছলতা সব কিছুই দেখেছি এক জীবনে। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কতটা কাঠ-খড় পোড়াতে হয় তা নিয়েই ইচ্ছা আছে চলচ্চিত্র তৈরির। যা দেখে এ প্রজন্ম জানবে জীবনে সফল হতে চাইলে কতটা সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হয়। 

প্রিয় শিল্পী, সুরকার হিসেবে কাদের কথা বলবেন? 
সত্য সাহা, আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, আহমেদ ইউসুফ সাবের, বাপ্পী খান, আসিফ ইকবালসহ অনেকেই। তবে আমার খুব খুদে এক গীতিকারের কথা মনে পড়ে, নাম অপু। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার জন্য গান লিখে আনে। ‘স্বপ্নরানী ‘ নামে তার লেখা গান গেয়েছিলাম আমি। এটা খুব মজার স্মৃতি ছিল। 

আপনার অনুপ্রেরণা... 
আমার বাবা, আবার আমার কষ্টও আমার বাবা। আমার ৮ বা ৯ বছর তখন, যখন বাবাকে হারাই। যেটুকু সময় পেয়েছি বাবার সঙ্গেই লেগে থাকতাম। কাছে থেকে অনুসরণ করতাম তাকে। তিন ভাই বোনের মধ্যে ছোট ছিলাম আমি। তাই বাড়তি একটা ভালোবাসা আমার ওপর ছিল তার। তাই এত অল্প বয়সে বাবাকে হারনোর কষ্ট আজও আমি ভুলি না, এখনো খুঁজে ফিরি মানুষটাকে। স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও সংগীতে আসার পেছনে বাবার অনুপ্রেরণা, তার পরোক্ষ চাওয়াই আমাকে এ পর্যন্ত আসতে সহায়তা করেছে। যে অস্তিত্বকে আমৃত্যু ভুলব না তিনি হলেন আমার বাবা, আমার প্রেরণা, উদ্যমের মূল কারিগর। এখনো যখন কোনো এনজাইটিতে থাকি, কষ্টে থাকি সবার আগে মনে পড়ে বাবার মুখখানি। জীবনের সবচেয়ে বড় একটা সাপোর্ট হারিয়েছিলাম বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //