৪০ হাজার লিটার জল সমুদ্রের মধ্যে এক বিন্দু ছাড়া কিছুই নয়: জেরেমি হপকিন্স

গাজা-ফিলিস্তিন চলমান যুদ্ধের দুই সপ্তাহ অতিক্রম হওয়ার পর গাজায় প্রথম ত্রাণ সরবরাহের একটি কনভয় শনিবার সকালে মিশর সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এই ২০ ট্রাক ত্রাণ বহরের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, সুপেয় পানি, জ্বালানি এবং চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি। যুদ্ধের কারণে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের ফলে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবের কারণে মৃত্যুঝুঁকি বেড়েই চলেছে অঞ্চলটিতে। গাজায় মৌলিক চাহিদাসামগ্রীর মজুদ কমে যাওয়ার ফলে মানবেতর পরিস্থিতিতে রয়েছে গাজাবাসী। আর এদিকে লক্ষ্য রেখেই জাতিসংঘের ইউনিসেফসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো এ অঞ্চলে সাহায্য বিতরণের জন্য একটি টেকসই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। 

তবে সামান্য এই ত্রাণবহর নিয়ে মিশরে কর্মরত ইউনিসেফের প্রতিনিধি জেরেমি হপকিন্স বলেছেন, ত্রাণ বহরের ৪০ হাজার লিটার বোতলজাত জল ভরা দুটি ট্রাক, "সমুদ্রের মধ্যে একটি বিন্দু জল ছাড়া কিছুই নয়।"

তিনি বলেন, "আমরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুবিধাসম্বলিত স্থানসমূহকে সংঘাতের লক্ষ্যবস্তুতে যেন পরিণত না করি। মানুষের প্রয়োজন নিরাপদে আমাদের সহায়তা পৌঁছে দেয়ার পথকে সুগম করা উচিত উভয় পক্ষের।" 

দক্ষিণ মিশরের রাফাহ সীমান্ত দিয়ে ত্রাণের কনভয়টি যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পরে মিঃ হপকিন্স জাতিসংঘের সংবাদ বিভাগের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বর্তমান মানবেতর পরিস্থিতি ও এই অঞ্চলের মানূষের বেঁচে থাকার জন্য সঠিকভাবে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে তার একান্ত মতামত তুলে ধরেন। 

সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো: 

জেরেমি হপকিন্স: আজ আমরা ৪০ হাজার পানীয় জলসহ ইউনিসেফের দুটি ট্রাক পাঠাতে  পেরেছি। আমার কাছে এটি বিশাল সমুদ্রের মধ্যে এক ফোঁটা জলের সমান। যেখানে একদিনে ২৭ হাজার লোকের কাছে পানীয় জল পৌঁছানো দরকার। সেই অনুপাতে এ পরিমাণ খুব অল্প। 

ইউএন নিউজ: পরবর্তী ত্রাণ সরবরাহের সম্পর্কে আপনার কাছে কোন তথ্য রয়েছে কী? পরবর্তী সরবরাহ কিসের ওপর নির্ভর করছে? যদি আপনাদের কাছে পরবর্তী সরবরাহের জন্য সবুজ সংকেত আসে তবে আপনার কাছে অতিরিক্ত জরুরি সরবরাহ পর্যাপ্ত পরিমাণ রয়েছে?

জেরেমি হপকিন্স: হ্যাঁ, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত জল, জল ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামাদি, ওষুধ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সরঞ্জামসহ শিশু সুরক্ষা এবং শিশু যত্নের জন্য অন্যান্য বিশেষ উপাদানগুলো বেশ ভাল পরিমাণ রয়েছে। যতটা জানি, সীমান্তে স্ট্যান্ড-বাই অবস্থায় আরও ১২টি ট্রাক, যেগুলো থেকে পণ্য খালাসে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। 

এছাড়াও বিমান ও ট্রাকে করে কায়রো থেকে ত্রাণসামগ্রী আসছে। একইসঙ্গে আরও চিকিৎসা সরবরাহ, জলসহ নানা প্রয়োজনীয় উপাদান পাইপলাইনে রেখেছি। কারণ আমরা জানি যে এই মুহূর্তে গাজার সবচেয়ে বেশি দরকার জল, খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানি। তাই আমরা সেই অনুযায়ী আমাদের সরবরাহের পাইপলাইন সাজিয়ে রেখেছি। আমাদের কাছে এক মিলিয়ন পানীয় জলের বোতল প্রস্তুত আছে। আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে। আমরা শুধু সীমান্ত করিডোর খোলার অপেক্ষায় রয়েছি। আমরা চাই টেকসইভাবে ধারাবাহিকভিত্তিতে ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য করে দিক। 

ইউএন নিউজ: পরবর্তী ডেলিভারি সম্পর্কে কোন তথ্য আছে আপনার কাছে?

জেরেমি হপকিন্স: আমরা জানি যে কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন পক্ষ তাদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে কীভাবে এই সীমান্ত দিয়ে অব্যাহতভাবে জরুরি ত্রাণসামগ্রী ভুক্তভোগীদের কাছে টেকসই উপায়ে পৌঁছানো যায়। আমরা আশা রাখছি তারা এটি করতে সক্ষম হবেন। আমার মনে হয় বিস্তারিতভাবে যত তথ্য আমাদের জানানো হবে ততই বিষয়টি স্পষ্ট হবে সবার কাছে। 

ইউএন নিউজ: এ মুহূর্তে গাজার অভ্যন্তরে আমাদের ২০টি ট্রাক রয়েছে। জীবনরক্ষাকারী পণ্যসামগ্রী সরবরাহের জন্য গাজা উপত্যকার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে যদি জানান।

জেরেমি হপকিন্স: আমি প্রথমে জানাতে চাই যে, ফিলিস্তিনের গাজায় ইউনিসেফের কর্মরত আমাদের একটি নিবেদিত কর্মী দল রয়েছেন, যারা সাহায্য বিতরণের জন্য ভয়ানক পরিস্থিতিতেও দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। শুরু থেকেই আমাদের সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। আমি জানি যে, গাজাবাসীদের জন্য আমাদের সহকর্মীরা কিছু জলের ব্যবস্থাও চালু রেখেছে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে চিকিৎসা সরবরাহের সাথে সংযুক্ত করেছে। আমি জানি আমরা আমাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার তুলনায় পাঁচ শতাংশেরও নীচে চলে এসেছি উপযুক্ত সুযোগের অভাবে। তবে কিছু জলের ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। একমাত্র ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট যা এখনও চলছে যা ইউনিসেফের সহায়তায় করা হয়েছে। সুতরাং, আমাদের সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাসমেত  জানাতে চাই তারা গাজায় দুর্দান্ত কাজ করে যাচ্ছেন। 

আমরা জানি এক মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত। আমরা এও জানি যে অন্তত ৩ লাখেরও বেশি শিশু বাস্তুচ্যুত। তার মানে এই মুহূর্তে তাদের কোনো বাড়ি নেই বা তারা বাড়িতে বাস করছে না। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় তাদের সবার জন্য মানবিক প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী-সুস্বাস্থ্য এবং মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি ব্যক্তির জন্য ১৫ লিটার জল দরকার। পান করার জন্য, ধোয়া এবং রান্নাসহ নানা প্রয়োজনে এ পরিমাণ জলের দরকার। এই মুহূর্তে গাজায় জনপ্রতি তিন লিটারেরও কম জল সরবরাহ করা হচ্ছে। অথচ এই চাহিদার অনুপাতে আমরা জানি এটির সঠিক সমাধান কীভাবে দিতে হবে। শুধু প্রয়োজন করিডোরটি দীর্ঘমেয়াদের জন্য খুলে দেয়া। 

ইউএন নিউজ: আপনি বলেছেন যে আজ যা সরবরাহ করা হয়েছে তা 'সমুদ্রের একটি বিন্দু মাত্র'। আপনি কি জানেন– আজ যে সরবরাহগুলো গাজায় পৌঁছেছে তা সেখানকার কতজন মানুষের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম?

জেরেমি হপকিন্স: আজ যা গেছে তা মোটেও চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এটি একটি খুব ক্ষুদ্র সুরবরাহ প্রয়োজন অনুপাতে। আমাদের প্রতিদিন ২০ ট্রাকের পরিবর্তে কমপক্ষে ১০০ থেকে ২০০ ট্রাক পৌঁছানো দরকার। যদিও সংখ্যাটি ট্রাকে কোন ধরণের পণ্য সামগ্রী রয়েছে সেটির ওপর নির্ভর করে, তবে আনুমানিকভাবে এটা বলতে পারি এসব বহরে খাদ্য, জল, ওষুধ এবং জ্বালানী সহ প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোই থাকবে। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোসহ এখনই উপযুক্ত সময় মানুষের কল্যাণে সাড়া দেয়ার। 

ইউএন নিউজ: যেহেতু এ অঞ্চলে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নেই, এমন অবস্থায় গাজায় ত্রাণ সরবরাহ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কেমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে আপনি মনে করেন?  

জেরেমি হপকিন্স: এটা খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সসবরাহ পৌছানো দরকার আর তা  মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই করতে হবে। পাশপাশি যুদ্ধবিরতির জন্যও আমাদের সবার প্রতি আহবান জানানো উচিত। আর তা হলেই কেবল নিরাপদে ত্রান সরবরাহ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। একইসঙ্গে উভয় পক্ষের প্রতি আহবান জানাই, তারা যেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগসমৃদ্ধ স্থানগুলোতে সংঘাত এড়িয়ে চলেন। যাতে করে আমরা নির্বিঘ্নে স্বাস্থ্যগত বিষয়সহ অন্যান্য সকল প্রয়োজনীয়তায় আমাদের সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারি। আমি সকল পক্ষকে এ অনুরোধও জানাচ্ছি, সেবাকাজে নিয়োজিতদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গেই তারা অবশ্যই দেখবেন। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //