নিরাপত্তাহীনতায় টাকা পাচার বাড়ছে: ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী

গত এক দশকে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত একটি শব্দ হলো কানাডার বেগমপাড়া। তবে শুধু কানাডাই নয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ নানা দেশে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়েছে বলেও উঠে এসেছে গোয়েন্দাসহ নানা প্রতিবেদনে।


সম্প্রতি দেশের টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কিনেছেন এমন ২৫২ জন আমলা, পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি তালিকা তৈরি করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের শীর্ষ মহলে পাঠানো হয়েছে সেই তালিকা। এই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই তালিকায় সরকারের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছাড়াও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাও আছেন। এরা সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। শুধু এই সরকারের আমলে নয়, বিগত সরকারগুলোর সময়ও আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। তখনো কয়েকশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিদেশে সম্পদ থাকার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এই অর্থ পাচার ইস্যুর প্রতিবাদে সংসদে সক্রিয় ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সংসদে একাধিক বক্তব্যে তিনি বিদেশে বাড়ি-গাড়ি আছে এমন আমলাদের তালিকা সংসদে প্রকাশেরও দাবি করেছিলেন।

সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে সংসদে এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলে ওই পরিবারের জন্য সমস্যা হয়, তাই আইনে খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে আত্মসাৎ ও চুরি হলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়বে এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। লাখ লাখ মানুষ কষ্ট পায় এবং অনেকের মৃত্যু হয়। কেন অর্থ পাচারকারীদের ফাঁসি দেওয়া হবে না সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে টাকা পাচার করে বাড়ি করা ২৫২ আমলা-পুলিশের তালিকা তৈরির পর বিদেশে টাকা পাচার ইস্যু নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে একান্ত কথা বলেছেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ সেলিম।

আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিদেশে স্থায়ী সম্পদ গড়ার প্রবণতা বাড়ছে কেন? তারা কি দেশেকে নিরাপদ মনে করেন না?

বিদেশে টাকা পাচার, সেখানে স্থায়ী সম্পদ তৈরি- এটা খুবই অন্যায়। কারণ আপনি যে দেশে রাজনীতি করবেন, ব্যবসা করবেন, চাকরি করবেন; সেই দেশে থেকে কোনো একদিন চলে যেতে হবে বা আপনি পালিয়ে যাবেন অথবা সেখানে স্থায়ী হবেন বলে সম্পদ করছেন। এখানে প্রথম অন্যায়টি হচ্ছে বৈধভাবে এই সম্পদ আয় সম্ভব নয়, দ্বিতীয় অন্যায় হচ্ছে অবৈধভাবে এই টাকাটা বিদেশ পাঠাচ্ছেন। তৃতীয়ত হচ্ছে তার মানে সব রাজনীতিবিদ এমন একটা দেশ তৈরি করছে, যেখানে সে নিজেকেও নিরাপদ বোধ করছে না। তারা মনে করছে, এদেশে সম্পত্তি করা যাবে না, রাখা যাবে না। তাহলে দেশকে আমরা কী সেবা দিলাম? কী কাজ করলাম দেশের স্বার্থে? এগুলো খুবই খারাপ লক্ষণ। বাংলাদেশে এগুলো আগে খুবই কম ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে গত এক দশক থেকে এটি খুবই বেড়েছে। এগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

এই ব্যর্থতা কার?

এটি একটি সম্মিলিত ব্যর্থতা। সরকার থেকে শুরু রাজনীতিবিদ, আমলা কেউই এর দায় এড়াতে পারবেন না।

বিদেশে কীভাবে টাকা পাচার হচ্ছে?

যারা সরকারি চাকরি করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করছেন তারা নিশ্চয়ই অবৈধ পথে টাকা উপার্জন করেছেন। কারণ তারা যে বেতন পায় তা দিয়ে বিদেশে বাড়ি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর থেকে বড় কথা আমি একাধিকবার সংসদেও বলেছি, বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে বিদেশে এই টাকা যাওয়া অসম্ভব। আইনি পক্রিয়ায় টাকা পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় বেআইনি একটি প্রক্রিয়ায় টাকাগুলো বিদেশে পাঠিয়েছেন। আর টাকাগুলো পাচারের সঙ্গে আবার জড়িত আছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যারা আইন রক্ষা করবে, আইন বাস্তবায়ন করবে তারাও টাকা পাচারে জড়িত।

টাকা পাচারের ফলে দেশের ওপর কী প্রভাব পড়ছে?

যে টাকাগুলো পাচার হচ্ছে তা অবশ্যই দুর্নীতি করে আয় করা হয়েছে। আবার এই অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাঠানোর পথটা খুবই কমন হয়ে গেছে। এই যে তারা কানাডা, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বাড়ি-গাড়ি করছেন, এটার জন্য পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ কিন্তু অনেক বিশাল। এর টাকা পাচারের ফলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় চলে গেছে। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে। 

টাকা পাচার বন্ধ করার উপায় কী?

প্রথম হচ্ছে সবকিছুতে স্বচ্ছতা রাখতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেন অন্য কোনো ব্যবসা না থাকে। কমিশন খাওয়ার সুযোগ না থাকে, কোনো প্রজেক্টে যাতে অবৈধ লেনদেন না হয় এই জিনিসগুলো মনিটর করতে হবে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে। এবং প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তাদের কী পরিমাণ সম্পদ আছে তার বিবরণ নিতে হবে। যারা সঠিক তথ্য দিতে পারবে না তাদের বরখাস্ত করতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগ না করলে এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও যারা বাড়ি করেছেন ওই বাড়ি বিক্রি করে টাকা দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

পাচার হওয়া অর্থ দেশে এনে সাদা করার সুযোগ দেওয়া কি ঠিক হবে?

কর পরিশোধ করে বিদেশে পাচার হওয়ায় টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে দুর্নীতি আরও বাড়বে। ভারতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সফলতা আসেনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //