শিশুমৃত্যু রোধ করতে পারে দক্ষ মিডওয়াইফদের ভূমিকা

আগামীকাল ৫ মে দেশে পালিত হবে বিশ্ব ধাত্রী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর এই দিনে পালিত হয় দিবসটি। সন্তান প্রসবে যুগ যুগ ধরে ঘরে ঘরে যারা সেবা দিয়ে আসছে, সেই ধাত্রী বা মিডওয়াইফদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই দিবসটি পালন করা হয়।

ধাত্রীদের উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার জন্য ১৯৮০ এর দশক থেকে আন্দোলন শুরু হয় আন্তর্জাতিকভাবে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে ৫ মে তারিখটিকে আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রতি বছরই এই দিবসটি পালনের প্রাক্কালে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ মিডওয়াইফ তৈরির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বুদ্ধিজীবী মহলের বক্তব্য হচ্ছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার বহুলাংশে হ্রাস করতে দক্ষ মিডওয়াইফ গড়ে তোলা দরকার। এই গুরুত্ব বিবেচনা করেই সরকারী প্রতিষ্ঠানে মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টির পাশাপাশি মিডওয়াইফ শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হচ্ছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে মিডওয়াইফ।দেশে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে নিবন্ধন করা মিডওয়াইফের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়ন সাব সেন্টারে প্রায় ২ হাজার ৫৫৭ জন মিডওয়াইফ কাজ করছেন। তবে সেবাগ্রহীতার তুলনায় মিডওয়াইফদের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দ্রুত মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া জরুরি। গত বছর চারটি কলেজে মাত্র ২০টি করে মোট ৮০টি সিটে মিডওয়াইফরা বিএসসি-ইন-মিডওয়াইফারির সুযোগ পেয়েছে। এ সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে।

বাংলার গ্রামীণ জনপদে মিডওয়াইফ বা ধাত্রী পেশা অতি প্রাচীন। অতীতে যখন চিকিৎসা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি, তখন কোন প্রসূতির সন্তান প্রসবে ধাত্রীই ছিল একমাত্র ভরসা। এরা প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছাড়াই বেশ দক্ষতার সাথেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে আসছে। দু’য়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া সন্তান প্রসবে সহযোগিতার কাজটি তারা সফলতার সঙ্গেই করছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে তাদের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। তাই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মিডওয়াইফদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর পেশাগত দিক থেকে হোক বা নিজের দায়িত্ববোধ থেকে হোক একজন মিডওয়াইফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সাধারণত সোজা বাংলায় মিডওয়াইফদের ধাত্রী নামে ডাকা হয় বা সবাই এই নামে চিনে থাকে।

সাধারণত মিডওয়াইফ বা ধাত্রীরা মাতৃসেবা দান করে থাকেন। গর্ভাবস্থায় থেকে শুরু করে প্রসব ও নবাগত শিশুর পরিচর্যা এবং পরামর্শ প্রদান করাই হলো মিডওয়াইফের আসল কাজ।

মিডওয়াইফদের নির্দিষ্ট কোনো পদন্নোতি না থাকলেও অভিজ্ঞতার আলোকে তারা সুপারভাইজার পর্যন্ত হতে পারেন। তাছাড়া এই পেশায় নির্দিষ্ট বেতনের পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা বাহিরে প্রচুর ইনকাম করতে পারেন। এই পেশায় আয় রোজগারের পাশাপাশি মানুষকে সহায়তা করার যে তৃপ্তি অর্জন করা যা তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে বলতে পারি আপনি যদি মানুষের সহায়তায় নিজেকে উজাড় করে তুলে ধরতে চান এবং ভালো একটি পেশা বা পদবীতে কাজ করতে চান তাহলে মিডওয়াইফ পেশাটি হতে পারে আপনার জন্য একটি আদর্শবান পেশা।

গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য জনিত বা অন্যান্য কোনো বিপদজনক উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। সন্তান প্রসবের পূর্বে গর্ভবতী নারীকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়া ও ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করা। গর্ভবতী নারী সন্তান প্রসবের পর তাকে প্রয়োজনীয় সেবাদান করা ও নবাগত শিশুর পরিচর্যা করা। গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারকে নব্য মা ও নব্য শিশুর যত্নে করণীয় সম্পর্কে বুঝিয়ে দেওয়া। উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও মিডওয়াইফ গর্ভবতী নারী, নব্য মা ও নব্য শিশুর প্রয়োজনে পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও আরো নানা ধরণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং সুস্থ ও নিরোগ জাতি গঠনের লক্ষ্যে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত নার্স ও মিডওয়াইফ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর।

বাংলাদেশের নার্সিং পেশার মানোন্নয়নের জন্য সর্ব প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি উচ্চ শিক্ষিত নারীদের এ পেশায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে সিনিয়র স্টাফ নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। বাংলাদেশের নার্সিং ও মিডওয়াইফারি পেশাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহযোগিতায় ২০১৬ সালে পূর্বতন সেবা পরিদপ্তরকে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে রূপান্তর করা হয়। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে আরো প্রায় ৫ হাজার নার্স নিয়োগের কার্যক্রম চলমান। নার্সদের পেশাগত ও শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এদেশে দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফদের বহি:বিশ্বে প্রচুর চাহিদা রয়েছে এদের মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেক রিমিটেন্স অর্জন করতে পারে। এতদপ্রেক্ষিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

নার্সিং স্বাস্থ্যসেবার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা বিশ্বে নার্সদের অত্যধিক চাহিদা থাকা সত্যেও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বাংলাদেশে দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফ তৈরি করা যাচ্ছে না। আর মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। দক্ষ ও পেশাদার মিডওয়াইফরা মা ও নবজাতকের মৃত্যু রোধের পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য সেবায়ও ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালনে জবাবদিহিতার জন্যও প্রস্তুত থাকা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা একজন দক্ষ মিডওয়াইফ বা ধাত্রীর সেই জ্ঞান থাকাটা জরুরি যে, কখন একজন মাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যুগ যুগ ধরে যে ধাত্রীরা মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে, সেই ধাত্রী পেশাই এখন স্বীকৃতি পেয়েছে। এদেরকে দেওয়া হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব সরকারের যতোটুকু, তার চেয়ে বেশি এই পেশায় নিয়োজিতদের। আর এক সময় গ্রামে-গঞ্জে এক শ্রেণির নারীরা হাজার হাজার গর্ভবতীর নরমাল ডেলিভারি করাতো। আমাদের সময় সুশীলা নামে একজন মিডওয়াইফ সব নরমাল ডেলিভারি করাতো। কিন্তু এই আমরাই তাদের ঘৃণার চোখে দেখেছি, অপমান করেছি, ফলে সেই সুশীলরা সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। সেই নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বৃদ্ধি ও অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার বন্ধে সেই সুশীলাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার প্রাণরক্ষাকারী পদক্ষেপ হলেও দেশে অপ্রয়োজনীভাবে এর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যত গর্ভবতী নারী নবজাতক শিশু প্রসব করেন তার শতকরা ২৩ ভাগ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া হারের প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে শতকরা ৩৮ ভাগ ও বেসরকারি পর্যায়ে শতকরা ৮০ ভাগ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার হয়, যা খুবই উদ্বেগজনক। আর বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের বিশেষ কিছু উদ্যোগের কারণে জনসাধারণ এখন মিডওয়াইফদের সেবা সম্পর্কে জানতে পারছে, সেবা নিতে হাসপাতালে ছুটে আসছে। মিডওয়াইফদের সংখ্যা আরো বাড়ানো গেলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কমিয়ে আনা কঠিন কিছু নয়। তাই মিডওয়াইফদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //