নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা

বাংলাদেশে জন্মের এক মাসের মধ্যে যত শিশু শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এদের ৩০ শতাংশের রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা থাকে। এই শিশুরা নিউমোনিয়া আক্রান্ত। এই বয়সী অন্য শিশুরা নিউমোনিয়া সমস্যা ছাড়াও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকলেও ৫ শতাংশের রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা থাকে। 

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের ৬০ শতাংশ চিকিৎসা নিতে পারে। বাকি ৪০ শতাংশ যেন চিকিৎসা নিতে পারে সে জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বাড়ানো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বছরে ২০ হাজারের বেশি শিশু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর বিশ্বে প্রায় ৩৫ সেকেন্ডে একটি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। 

নিউমোনিয়া কেন হয় 

বাংলাদেশে মোট শিশুমৃত্যুর ১৮ শতাংশের কারণ নিউমোনিয়া। সরকারি তথ্যে বলা হয়েছে, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ছাড়াও নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। বাচ্চাদের নাকে যেসব জীবাণু থাকে সেগুলো এক সময় ফুসফুসে নেমে গিয়ে প্রদাহ তৈরি করতে পারে এবং তা থেকে নিউমোনিয়া হতে পারে। এ ছাড়া নিউমোনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশি থেকে বের হওয়া শ্লেষ্মা থেকে এবং জন্মের পরপর রক্ত থেকেও ছড়াতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ। সময়মতো ও সঠিকভাবে চিকিৎসা পেলে নিউমোনিয়া থেকে সুস্থ হওয়া যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, শরীরে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুষ্ঠু কার্যক্রমের জন্য দরকার অক্সিজেন। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৭ থেকে ১০০ শতাংশ থাকা উচিত। ফুসফুসে সংক্রমণ বা নিউমোনিয়া হলে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। ক্রনিক অবস্ট্র্যাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) ও হাঁপানি রোগীদের ক্ষেত্রেও অক্সিজেন স্বল্পতা একটি সমস্যা। ফুসফুসের কার্যক্ষমতায় ঘাটতির কারণে তাদের শরীরে এমনিতেই অক্সিজেন কম থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, হাঁপানি বা ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের রোগীর সমস্যা বেড়ে গেলে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমে যায়। তীব্র মাত্রার রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) রোগীদের মধ্যেও এই উপসর্গ দেখা যায়।

নিউমোনিয়া হলে কী হয়

নিউমোনিয়া হলে মানুষের ফুসফুস আক্রান্ত হয়। ফুসফুসের বায়ু থলিতে তরল ও পুঁজ জমা হয়ে থাকে। ফলে বুকে কফ জমে যায় এবং আক্রান্ত রোগীর জ্বর, ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চিকিৎসকরা রোগীর অবস্থা দেখে অথবা বুকের এক্স-রে করে নিউমোনিয়া শনাক্ত করে থাকেন।

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া এবং নিউমোনিয়ায় যত শিশু মারা যায় এর ৪৬ শতাংশেরই মৃত্যু হয় অপুষ্টির কারণে। অপুষ্টি ছাড়াও বায়ু দূষণ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, পুষ্টিহীনতার শিকার শিশুদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। পুষ্টির ঘাটতি মেটাতে শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধ গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় বলা হয়েছে, শালদুধ পান করানোসহ নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ানো হলে শিশুর মধ্যে পুষ্টিহীনতার ঘাটতি দূর হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তা ছাড়া নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে মাকে বারবার হাত ধুতে হবে। শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিলে হাতের মাধ্যমে আসা অনেক রোগজীবাণু প্রতিরোধ করা যায়। কারণ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসসহ অন্যান্য জীবাণু হাত দিয়েই বেশি আসে।

নিউমোনিয়ার রোগীদের হাইপোক্সিমিয়া বিপজ্জনক

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের রক্তে কম অক্সিজেন (হাইপোক্সিমিয়া) থাকা বিপজ্জনক। বাংলাদেশে এমন শিশু মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ। বৈশ্বিকভাবে এই হার ৩১ শতাংশ। আইসিডিডিআরবির ড. জোবায়ের চিশতী জানান, রক্তে কম অক্সিজেন থাকা নিউমোনিয়ার রোগীদের মৃত্যু বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ২২ গুণ বেশি। একটি অক্সিমিটার এই সমস্যার সমাধানে সহায়তা করতে পারে। এই যন্ত্রটি দিয়ে বাড়িতে বসেই নিউমোনিয়ার রোগীদের রক্তে কী পরিমাণ অক্সিজেন আছে তা মাপা যায় এবং অক্সিজেন কম থাকলে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। উল্লেখ্য, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ শতাংশের নিচে নেমে গেলে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে এবং পরিমাণমতো অক্সিজেন দিতে হবে।

বছরে ২৪ হাজার মারা যায় নিউমোনিয়ায়

নিউমোনিয়া এখনো বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনটি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় এবং বছরে মারা যায় ২৪ হাজার। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি হাজার জীবিত জন্মের ৭.৪ শিশুর মৃত্যু হয় নিউমোনিয়ায়। নিউমোনিয়ার কারণে বছরে ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়। মারাত্মক এই রোগটির বিরুদ্ধে এখন অনেক অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পরিচালিত আইসিডিডিআরবির গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতন হওয়ার জন্য আইসিডিডিআরবি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, অ্যান্টিবায়োটিক এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যেন রোগের উপশম হয় আবার জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যেন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে শক্তিশালী হয়ে না ওঠে। 

ধূমপান হয় এমন ঘরে শিশু নিউমোনিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ

ড. জোবায়ের চিশতী গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলেন, ঘরের মধ্যে বাতাসের গুণগতমান উন্নত করার মাধ্যমে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেক করা সম্ভব এবং কেবল সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ২১ শতাংশ নিউমোনিয়া সংক্রমণ কমানো যায়। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতীদের আরএসভি ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও তা নবজাতক শিশুদের গুরুতর নিউমোনিয়া এবং হাইপোক্সেমিয়া প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে ড. চিশতী জানান, যে ঘরে ধূমপান করা হয় সেখানে বেড়ে ওঠা শিশুর নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আবার অনেকেই বাইরে থেকে ধূমপান করে ঘরে প্রবেশ করেন। মনে করেন, তার ধূমপান অন্যদের ক্ষতি করবে না। এ প্রসঙ্গে ড. জোবায়ের চিশতী বলেন, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এতে শিশুদের কোনো উপকার হয় না। বাইরে থেকে ধূমপান করে আসলেও মুখে বা শরীরে তামাক জাতীয় পণ্যের গন্ধ লেগে থাকে। এটাও শিশুর জন্য ক্ষতিকর এবং শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। 

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের অক্সিজেন স্বল্পতা রোধের চিকিৎসায় ড. জোবায়ের চিশতীর স্বল্পমূল্যের বাবল সিপ্যাপ সফলতার সঙ্গে কাজ করছে বলে জানান। এই বাবল সিপ্যাপ নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের ৭৫ শতাংশ মৃত্যুহার হ্রাস করতে সক্ষম। এই ডিভাইসটি বাংলাদেশ ছাড়াও ইথিওপিয়ার ১৬টি হাসপাতালে সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও স্বল্পমূল্যের এই যন্ত্রটি সর্বত্র ব্যবহার নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর অক্সিজেন স্বল্পতা কম খরচে কমে যাবে এবং শিশুর জীবন রক্ষা পাবে বলে ড. চিশতী আশা প্রকাশ করেন।

বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, নিউমোনিয়া থেকে শিশুকে রক্ষা করার সব থেকে কার্যকরী উপায় হলো শিশুকে নিউমোনিয়ার টিকা দেওয়া। বাংলাদেশে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় শিশুদেরকে নিউমোনিয়ার টিকা প্রদান করা হয়। এর বাইরে নিউমোভ্যাক্স-২৩ নামের একটি ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যায়। পাশাপাশি যেসব শিশুর অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদেরকে প্রতিবছরই ফ্লু ভ্যাকসিন দিয়ে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করার ভালো উপায়। 

এগুলোর সঙ্গে শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করা, বুকের দুধ পান করানো এবং প্রচুর শক্তি সমৃদ্ধ বাড়তি খাবারও দেওয়া প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //