করোনার মৃদু লক্ষণেও মারাত্মক ক্ষতি

আক্রান্তদের মস্তিস্ক আর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে করোনাভাইরাস, যা রোগীদের সাইকোসিস, পক্ষাঘাত ও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো ধরা পড়ে শেষ পর্যায়ে। 

করোনা মানুষের ফুসফুস, শ্বাসনালী থেকে শুরু করে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে, এমন প্রমাণ আগেই পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যার মধ্যে হৃদযন্ত্র, স্নায়ু, কিডনি ও ত্বকও আছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতায় করোনাভাইরাস নিরীহ অসুখই মনে হবে। দশজনে আটজন মানুষের জন্যই কোভিড-১৯ একটি নিরীহ সংক্রমণ এবং এর প্রধান উপসর্গ কাশি ও জ্বর। শরীরে ব্যাথা, গলা ব্যাথা ও মাথাব্যাথাও হতে পারে, তবে হবেই এমন কোনো কথা নেই। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার ফলে গায়ে জ্বর আসে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে শত্রুভাবাপন্ন একটি ভাইরাস হিসেবে শনাক্ত করে এবং বাকি শরীরে সাইটোকাইনস নামক কেমিক্যাল পাঠিয়ে বুঝিয়ে দেয় কিছু একটা ঠিক নেই। এর কারণে শরীরে ব্যাথা ও জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

এ ভাইরাস প্রথমে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে ও সংক্রমিত করে। এরপর কাশির সৃষ্টি করে, শ্বাসকষ্ট হয়। এটি কিছুদিনের মধ্যেই ফুসফুসের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। মারাত্মক এই ভাইরাসটি ফুসফুসের সুস্থ কোষগুলোতে প্রবেশ করে বহুগুণে বংশবিস্তার করে। ফুসফুসে প্রদাহজনক পরিবর্তন ঘটে ও টিস্যুকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাস শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি করে। এর ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরো কমে যেতে শুরু করে। যারা ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আগে থেকেই আক্রান্ত কিংবা অতিরিক্ত মোটা; তাদের ক্ষেত্রে করোনা মারাত্মক হতে পারে। 

এখানেই শেষ নয়। ব্রিটিশ স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় মস্তিস্কেরও বড় ধরনের ক্ষতি হয়। যেসব রোগীর মৃদু লক্ষণ থাকে বা যারা সেরে ওঠেন, তাদের ক্ষেত্রেও সমস্যাটি রয়ে যায়। সেটি অনেক ক্ষেত্রে দেরিতে ধরা পড়ে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধরাই পড়ে না। এই গবেষণাটি ‘ব্রেইন' নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। 

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা এজন্য ব্রিটেনের ৪০ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ জনই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের প্রদাহে ভুগেছেন। ১০ জন মস্তিস্কের ট্রানসিয়েন্ট এনসেফেলোপাথি রোগে, আটজন স্ট্রোক ও আরো আটজন পেরিফেরাল স্নায়ু সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন, যা পক্ষাঘাত ও পাঁচভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হয়।

কোভিড ১৯-এর মতো মস্তিস্কে কোনো ভাইরাসের এমন অতর্কিত হামলা বিজ্ঞানীরা এর আগে দেখেননি, বলেছেন গবেষক দলের প্রধান ডা. মাইকেল জান্ডি। বিশেষ করে, মৃদু লক্ষণেও রোগীদের মস্তিস্কের এমন মারাত্মক ক্ষতি হওয়া বিরল বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির ছাপ রেখে যায়। অনেকে সেরে ওঠার পরও শ্বাসকষ্ট ও দীর্ঘ ক্লান্তিতে ভোগেন। অসাড়তা,  দুর্বলতা আর স্মৃতি সংক্রান্ত জটিলতাও দেখা গেছে বাকিদের ক্ষেত্রে। তবে মস্তিস্কের অসুখে দীর্ঘমেয়াদে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে সে বিষয়ে গবেষকরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।

করোনাভাইরাস শরীরে মারাত্মক প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাইরাসটি যখন শরীরের এসই২ রিসেপ্টরগুলোর সাথে একবার নিজেকে সংযুক্ত করে; তখন রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার প্রোটিন তৈরি করতে চাপ দেয়।

চিকিৎসকরা রক্তের জমাট বাঁধার লক্ষণগুলো শুধু ফুসফুসেই (ফুসফুসীয় এম্বোলিজম) নয়, করোনা রোগীর পায়ে (গভীর শিরা থ্রোম্বোসিস) ও শরীরের অন্যান্য অংশেও লক্ষ্য করেছেন। 

যারা আগে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত; তাদের ক্ষেত্রেও করোনা মারাত্মক হতে পারে। করোনাভাইরাস হার্টের পেশিগুলোতে বড় ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। হার্ভার্ডের স্বাস্থ্য প্রকাশনা অনুসারে, হাসপাতালে ভর্তি প্রায় এক-চতুর্থাংশ গুরুতর কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে হার্ট ইনজুরির লক্ষণ থাকে (রক্তের প্রবাহে এনজাইম ট্রপোনিনের মাত্রা বেড়ে যায়)। এক্ষেত্রে উপসর্গ হিসেবে বুক ধড়ফড়, ঘন ঘন শ্বাস নেয়া, বুকে ব্যথা ও দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির সংক্রমিতদের মধ্যে দেখা যায়।

শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতোই গুরুত্বপূর্ণ কিডনিরও ক্ষতি করে করোনাভাইরাস। যারা কিডনির বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত; তাদের জন্য মারাত্মক হতে পারে করোনার প্রভাব।

করোনা শরীরের সুস্থ কোষগুলোকে প্রথমে সংক্রমিত করে। যেখানে ভাইরাল স্পাইক প্রোটিনগুলো এসিই২ রিসেপ্টরগুলোতে সংযুক্ত হয়, যা কোষের সেলুলার ঝিল্লিতে বসে কিডনিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে বাসা বাঁধে।

ভাইরাস কিডনি কোষে প্রবেশের পরে এটি মারাত্মক প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং কিডনির সুস্থ টিস্যুগুলোকে বড় ধরনের আহত করতে পারে। এটি কম প্রস্রাবের আউটপুট ও অপ্রতুল প্রস্রাবের কারণ হতে পারে এবং কিডনি-অকার্যকর পোস্ট-কোভিডের পরেও বিকশিত হতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //