আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের সাফল্য হাতে গোনা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ‘ফুটবল’ দারুণ জনপ্রিয় হলেও মাথা কুটে মরতে হয়েছে আন্তর্জাতিক সাফল্যের আশায়। ১৯৮৪ সালে প্রথম সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনালে উঠে নেপালের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ। একই আসরের ফাইনালে বাংলাদেশ ১৯৮৫ সালে ভারত আর ১৯৮৯ সালে হেরেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে। নেপাল আর পাকিস্তানের মাটিতে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল হারার কষ্ট বাংলাদেশকে তাড়া করে বেড়াবে চিরদিন। ১৯৯৫ সালের সাফ গেমস ফাইনালেও বাংলাদেশকে হারতে হয়েছে ভারতের বিপক্ষে। আবার ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত কায়দে-আজম ট্রফি টুর্নামেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশ হেরে যায় উত্তর কোরিয়া একাদশের (মূল জাতীয় দল না) কাছে।
ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য আসে ১৯৯৫ সালে। মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে মিয়ানমারের আমন্ত্রণমূলক চার জাতি ট্রফি জয় করে লাল-সবুজের দল। কাটে বাংলাদেশের শিরোপা বন্ধ্যত্ব। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জিতেছে ১৯৯৯ সালের এসএ গেমস স্বর্ণ আর ২০০৩ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। তবে ১৯৮৯ সালেই বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু মেতেছিল শিরোপা জয়ের উল্লাসে। ঘরের মাঠে বাংলাদেশ জিতেছিল প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের দুটি দল (সবুজ ও লাল) অংশ নেয়। আর টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া বিদেশি দলগুলো মূল জাতীয় দল পাঠায়নি। তাই এটি আন্তর্জাতিক ট্রফি হিসেবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু শিরোপাটি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বেশ গুরুত্ববহ। কারণ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের দলীয় কোনো খেলায় এটিই ছিল প্রথম চ্যাম্পিয়ন ট্রফি।
১৯৮১ সালে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ। অভিষেক টুর্নামেন্টের ফাইনালেও উঠেছিল বাংলাদেশ লাল দল। কিন্তু হেরে যায় দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। ১৯৮৯ সালের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে বাংলাদেশের লাল এবং সবুজ দল অংশ নেয়। ২১ মে মিরপুর স্টেডিয়ামে শুরু হয় এই টুর্নামেন্ট। ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ৩১ মে। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ লাল আর দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দল। প্রায় ৫০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ফাইনালে লড়াই রুদ্ধশ্বাস চলে ১২০ মিনিট। খেলা শেষ হয় ১-১ সমতায়। বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে প্রথম গোল করেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। আর সেই গোল শোধ দেন দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দলের সু জং-ওন। ফলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। যেখানে গোলরক্ষক সেলিমের অনবদ্য নৈপুণ্যে বাংলাদেশ লাল দল ৪-৩ গোলে হারিয়ে দেয় অতিথি কোরিয়ানদের। মাতে শিরোপা জয়ের উল্লাসে। লাল দলের সাফল্যে পুরো দেশে রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়েছে আনন্দ মিছিল।
ফাইনালে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের পেনাল্টি ঠেকিয়ে রাতারাতি নায়ক বনে যান গোলরক্ষক সেলিম। অথচ গোলপোস্টের নিচে তিনি বাংলাদেশ লাল দলের প্রথম পছন্দ ছিলেন না। দলে ছিলেন সাইদ হাসান কানন। তিনি ছিলেন অধিনায়কও। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ইনজুরিতে মাঠ ছাড়েন কানন। শেষ হয়ে যায় তার প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ। তাতেই সেলিমের সুযোগ মেলে লাল দলের পোস্ট আগলাবার। এ ছাড়া কাননের ইনজুরিতে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব বর্তায় কায়সার হামিদের কাঁধে। সৌভাগ্য বলতে হবে, বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল শিরোপাজয়ী অধিনায়ক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে যায় কায়সার হামিদের নামও।
১৯৮৯ সালের প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে অংশ নেওয়া সব দেশ জাতীয় দল পাঠায়নি। তাই টুর্নামেন্ট পায়নি আন্তর্জাতিক মর্যাদা। আবার ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি টুর্নামেন্টকেও পুরোপুরি ‘আন্তর্জাতিক’ বলার উপায় নেই। মিয়ানমার, বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার জাতীয় দল খেললেও সিঙ্গাপুর পাঠায় সশস্ত্র বাহিনী দল। যা-ই হোক, আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট না হলেও ১৯৮৯ সালের প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপের মাধ্যমেই বাংলাদেশ প্রথম দেখেছিল শিরোপার মুখ। এতে বাংলাদেশ ফুটবল দল যে শিরোপা জিততে পারে, সেই আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল ফুটবলার আর সমর্থকদের মনে। বলা যায়, ১৯৮৯ সালের মে মাসেই বাংলাদেশের ফুটবল ছড়িয়েছিল বিরল ‘মে ফ্লাওয়ার’ ফুলের সৌরভ। আজও যা হয়ে আছে দারুণ সুখস্মৃতি।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh