বাংলাদেশের ফুটবলে স্ট্রাইকারদের অবদান

বাংলাদেশের ফুটবলে ‘স্ট্রাইকার’ সমস্যা চিরন্তন। একজন ভালো মানের স্ট্রাইকারের জন্য মাথা কুটতে হয়। ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) দেশীয় স্ট্রাইকারদের দুরবস্থা স্পষ্ট। ২০০৯-১০ মৌসুমে এনামুল হক ছাড়া কোনো বাংলাদেশি ফরোয়ার্ড জিততে পারেননি বিপিএলের সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান। ঢাকা সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল যুগেও বিদেশিদের ‘সর্বোচ্চ গোলদাতা’র খেতাব জয়ের ঘটনা কম নেই।

একদা যদিও বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে দেশি ফরোয়ার্ডরা রাজত্ব করেছেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা লিগে প্রথম সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান জেতেন কাজী সালাউদ্দিন। ১৯৬৯ সালের ঢাকা লিগেও ওয়ারীর জার্সিতে সর্বোচ্চ ১৮ গোল করেছিলেন বাফুফে বর্তমান সভাপতি। স্বাধীনতার পর আবাহনীর হয়ে চারবার তিনি জিতেছেন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান। ক্লাব ক্যারিয়ারে  ১৫৩ আর দেশের হয়ে সাত গোল রয়েছে তার। ঢাকা লিগে ১৯৮৪-৮৭ পর্যন্ত টানা চার মৌসুম সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমেও ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। সবই আবাহনীর হয়ে। আবার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব ১৯৯৫ থেকে টানা চার মৌসুম সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে করেছেন সাতটি গোল।

সালাউদ্দিন, আসলাম আর নকীব ধারাবাহিকতায় ছিলেন অনন্য। লিগে  আসলাম সবচেয়ে বেশি ১৭৮ গোলের মালিক। শতাধিক গোল রয়েছে নকীবের। এ ছাড়াও গোলাম শহীদ নিলু, নওশের, এনায়েত, আব্দুল হালিম, হাফিজউদ্দিনরাও জিতেছেন একবার করে সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান। ১৯৮২ সালে মোহামেডানের হয়ে আব্দুস সালাম মুর্শেদী করেন ২৭ গোল। যা এখনো বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগে রেকর্ড।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলের মালিক কোনো স্ট্রাইকার নন। লেফট-উইঙ্গার আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু সর্বোচ্চ ১৭টি গোলের মালিক। আসলামের আন্তর্জাতিক গোলের সংখ্যা ১৪টি। ১১ গোল রয়েছে আলফাজ আহমেদের। ১৯৯৯ সালের এসএ গেমস ফাইনালে আলফাজ জয়সূচক গোল করেন নেপালের বিপক্ষে। ক্লাব ফুটবলেও মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা, ব্রাদার্স ইউনিয়ন আর শেখ রাসেলের হয়ে ধারাবাহিক গোল করেছেন। সফলতম স্ট্রাইকারদের তালিকা করলে রাখতে হবে জাহিদ হাসান এমিলির নামও। প্রথম দুটি পেশাদার লিগে করেছিলেন ২৫ গোল। ২০০২ সাল থেকে প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারে রয়েছে শতাধিক গোল। জাতীয় দলের হয়েও ১৫ গোল করা এমিলিকে উপেক্ষা করার উপায় নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে নাবিব নেওয়াজ জীবনের মধ্যে বড় স্ট্রাইকার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। ২০১৮-১৯ মৌসুমের বিপিএলে ঢাকা আবাহনীর হয়ে ১৬ গোল করে নজরও কাড়েন। কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি। জাতীয় দলের হয়ে ৩২ ম্যাচে মাত্র পাঁচ গোল তার। এ ছাড়া   মোহাম্মদ ইব্রাহিম কিংবা মতিন মিয়ারা প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারেননি।

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে ক্লাবগুলো বিদেশি ফরোয়ার্ড নির্ভর। তাতে আক্রমণভাগের দেশীয় খেলোয়াড়দের একাদশে জায়গা পাওয়াই কঠিন। বর্তমানে শাহরিয়ার ইমন, সুমন রেজা, ফয়সাল আহমেদ ফাহিমরাও ক্লাবের একাদশে নিয়মিত নন। তাই জাতীয় দলে ডাক পড়লে তাদের মধ্যে দেখা যায় আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। তুলনায় বরং উইঙ্গার রাকিব হোসেন আর মিডফিল্ডার মোরসালিনরা আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোল করার ক্ষেত্রে সফলতা দেখাচ্ছেন।

বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখেছিল এলিটা কিংসলেকে নিয়ে। নাইজেরিয়ার কিংসলে ২০১১-১২ বিপিএলে খেলছেন। বর্তমানে রয়েছেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন শিবিরে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে কিংসলের গোলের সংখ্যা ৭০টি। তিনি বিয়েও করেছেন বাংলাদেশে। পেয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। বিপিএলে মোটামুটি ধারাবাহিক পারফর্ম্যান্সের সুবাদে তিনি বাংলাদেশের গোল সমস্যার সমাধান করবেন-এমন আশা ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে সেসেলসের বিপক্ষে দুটি ম্যাচে খেলে কোনো গোল পাননি। প্রথম বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার রেকর্ড গড়েই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানা হয়ে গেছে যেন।

অতীত থেকে বর্তমান পর্যালোচনায় এটা সত্য, বাংলাদেশ কখনো আন্তর্জাতিক  মানের স্ট্রাইকার পায়নি। একসময় সালাউদ্দিন, আসলাম, নকীবরা ঘরোয়া ফুটবলে রাজত্ব করেছেন। তুলনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব বেশি সফল হননি। ১৯৯৯ সালের সাফ গেমসে মিজানুর রহমান ডন (৩) আর ২০০৯ সালে একই প্রতিযোগিতায় এনামুল হক (৪) যৌথভাবে সেরা গোলদাতা হয়েছেন। আর কোনো ফুটবলার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান পাননি। ফুটবলে বাংলাদেশের ছিটেফোঁটা যা সাফল্য, প্রায় সবই দলগত প্রয়াসে। বর্তমান বাংলাদেশ দলও চলছে একই ধারায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //