ফুটবল যখন স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার

বাংলাদেশের নারীরা দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে প্রতিষ্ঠা করেছে নিরংকুশ আধিপত্য। জাতীয় দল থেকে শুরু করে নারীদের বয়সভিত্তিক সাফ ফুটবলেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব। সর্বশেষ নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৬ দলের মেয়েরা উল্লাস করেছে সাফ ট্রফি নিয়ে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে ছেলেদের ফুটবল ছিল রমরমা। নানামুখী ঘরোয়া আয়োজনে ফুটবলাররা ছিলেন ক্রীড়াঙ্গনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। লিগ কিংবা ঘরোয়া আয়োজন চলছে নিয়মিত। তুলনায় নারী ফুটবল আর ফুটবলাররা বড় বেশি অবহেলিত। নারীদের ঘরোয়া লিগ মাঠে গড়ায় ২০১১-১২ মৌসুমে। সেই থেকে লিগ আয়োজন হয়েছে মাত্র পাঁচবার। আর বাংলাদেশের মেয়েরা নেপালের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি। মাত্র এক যুগের সামান্য বেশি সময়ে সেই মেয়েরাই এখন সাফে রাজত্ব করছে।

ফুটবলে বাংলাদেশের নারীদের উত্থান রূপকথার গল্পকে হার মানায়। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্ডা, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তারের মতো ফুটবলার। সিংহভাগ ফুটবলার উঠে এসেছেন হতদরিদ্র পরিবার থেকে। চলতি বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলে ভারতের সঙ্গে শিরোপা ভাগাভাগি করেছে মেয়েরা। সেই দলের সাগরিকা ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার মেয়ে। বাবা চায়ের দোকানি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় খেলেন বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট। পরবর্তীকালে সুযোগ পান নারী লিগের এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া দলে। ১০ গোল করে নজর কাড়েন সাবেক কোচ গোলাম রাব্বানি ছোটনের। 

সদ্য-সমাপ্ত সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক ইয়ারজান। ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে টাইব্রেকারে তিনটি পেনাল্টি ফিরিয়ে দেন। তিনি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে। দিনমজুর মায়ের সামান্য রোজগারে জরাজীর্ণ ছোট টিনের ঘরে বসবাস। স্থানীয় কোচ আবু তালেবের একাডেমির মাধ্যমে ফুটবলার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমে ইয়ারজান এখন বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক নারী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। একই টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন সুরভি আকন্দ প্রীতি। তাকেও ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে শুনতে হয়েছে সমাজের কটুবাক্য। 

বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী ফুটবলারের রয়েছে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামের ইতিহাস। ফুটবলকে ঘিরেই তারা দেখছে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন। নারী ফুটবল ইতিহাসের সেরা তারকা ও অধিনায়ক সাবিনা খাতুন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে খেলছেন বিদেশের বিভিন্ন লিগে। সানজিদা আক্তার ভারতের ইস্ট বেঙ্গলে প্রথম বিদেশি নারী ফুটবলার হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন। কৃষ্ণা রানী সরকারও খেলেছেন ভারতে। তারা এখন সাগরিকা আর ইয়ারজানদের অনুপ্রেরণা। এটা সত্যি, সাফের সাফল্যে জীবনের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে কিশোরী ফুটবলারদের। ইয়ারজান আর সাগরিকার ভাঙা ঘর মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও ইয়ারজানদের পুরো দলকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা এসেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) সিনিয়র দলে চুক্তিবদ্ধ নারী ফুটবলারদের বেতন বৃদ্ধি করেছে। এবার সেই চুক্তির আওতায় বয়সভিত্তিক দলের (অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-১৬) ফুটবলাররাও আসবেন, দাবি বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারপারসন মাহফুজা আক্তার কিরণের। 

বাফুফের পক্ষ থেকে নারী ফুটবলারদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি সুখবর। কিন্তু এখানেই বাফুফের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। জাতীয় কিংবা বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়ের সংখ্যা সীমিত। বাফুফের চুক্তির বাইরে থাকা খেলোয়াড়দের কোনো আর্থিক নিশ্চয়তা নেই। তৃণমূল পর্যায়ের খেলোয়াড়দের উঠে আসা আর উপার্জন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ক্লাব ফুটবলের নিয়মিত আয়োজন। মূলত একটা দেশের ফুটবল কাঠামো গড়ে ওঠে ক্লাব ফুটবলের ওপর ভিত্তি করেই। এখানেই পিছিয়ে বাংলাদেশ।

শোনা যাচ্ছে, এপ্রিলের মাঝামাঝি মাঠে গড়াবে পরবর্তী নারী ফুটবল লিগ। কিন্তু সেখানে নেই পুরুষ ফুটবলের বড় কোনো ক্লাব। এমনকি চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসসহ ঝরে গেছে বরিশাল ফুটবল একাডেমি, কুমিল্লা ইউনাইটেড ও এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নতুন যোগ হয়েছে বাংলাদেশ আর্মি স্পোর্টস ক্লাব। তাতে দলের সংখ্যা বিগত আসরের তুলনায় নেমে এসেছে ১২ থেকে ৯-এ। এতে নারী ফুটবলাররা লিগে ‘ভদ্রস্ত’ পারিশ্রমিক পাওয়া নিয়েই শঙ্কিত। আবার দল কমে যাওয়ায় যোগ্য সকলেই ক্লাব পাবেন- নিশ্চয়তা নেই। যা চিন্তিত করে তুলেছে সাবিনা আর মারিয়া মান্ডাদের। অতীতে নিয়মিত লিগ খেলতে না পারা আর আর্থিক অনিশ্চয়তার হতাশা থেকে অল্প বয়সে ফুটবল ছেড়েছেন একাধিক নারী ফুটবলার। ভবিষ্যতে এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে নারী ফুটবল লিগের কাঠামো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তাতে নারীরা ফুটবলকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পারবেন। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //