সুনাম রক্ষার ভার সানজিদার কাঁধে

কলকাতা ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে বাংলাদেশের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। মোনেম মুন্না, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, রুমিরা লাল-হলুদ শিবিরে খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। অকাল প্রয়াত বাংলাদেশের কিংব্যাক মুন্না তো ইস্ট বেঙ্গলের কিংবদন্তি, যাকে এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে ক্লাবের সমর্থক আর কর্তারা। ভারতের সেই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশের সাফজয়ী নারী ফুটবলার সানজিদা আক্তার। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রথম বিদেশি নারী ফুটবলার হিসেবে সানজিদা ইতোমধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।

ইতিহাস বলছে, ১৯৪২-৪৩ মৌসুমে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রথম বিদেশি ফুটবলার খেলেছেন তৎকালীন বার্মার (মিয়ানমার) ফরোয়ার্ড ফ্রেড পাগসলি। আর প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার হিসেবে খেলতে গিয়েছিলেন খন্দকার ওয়াসিম ইকবাল। ঢাকা ব্রাদার্স ইউনিয়ন এবং আবাহনীর হয়ে মাঠ কাঁপানো ওয়াসিম ১৯৮৬ সালে উড়ে গিয়েছিলেন ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে খেলতে। অবশ্য জাতীয় দলের সাবেক উইঙ্গার ওয়াসিম কলকাতা লিগে খেলেননি। ফিরে এসেছিলেন রোভার্স কাপে অংশ নিয়ে। পরে মুন্না, আসলাম, রুমি, গোলাম গাউসরা গড়েছেন ইতিহাস। ১৯৯১ সালে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ইস্ট বেঙ্গলকে। ১৯৯৫ সালে রাকিব হোসেন আর মিজানুর রহমান ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল স্কোয়াডে।

ইস্ট বেঙ্গলে নাম লেখানোর আগেই মুন্না ছিলেন বাংলাদেশের মহাতারকা। তিনি ঢাকা আবাহনী আর জাতীয় দলে ‘স্টপার ব্যাক’ পজিশনে খেলেই হয়ে উঠেছিলেন দেশের জনপ্রিয় ফুটবলার। কিন্তু ১৯৯১-৯৩ পর্যন্ত তিন মৌসুমে ইস্ট বেঙ্গল যেন তার ক্যারিয়ার বদলে দেয়। স্টপার মুন্নাকে ইস্টবেঙ্গলের কোচ নাইমুদ্দিন খেলিয়েছেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার বা লিবেরো হিসেবে। যে পজিশনে মুন্নাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে ফুটবল দর্শকরা। মুন্নার অবিস্মরণীয় খেলা আজও দাগ কেটে আছে কলকাতা দর্শকদের মনে। পরে অবসর পর্যন্ত মুন্নাকে দেখা গেছে ‘লিবেরো’ ভূমিকাতে খেলতে।

প্রচলিত আছে, পশ্চিম বাংলার ফুটবল দর্শকদের মধ্যে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে উন্নাসিক ভাব বরাবরের। কিন্তু মুন্নারা কলকাতা লিগে নিজেদের দক্ষতা আর দাপট দেখিয়ে দর্শকদের বাধ্য করেন মানসিকতা পরিবর্তনে। একই সময়ে কলকাতার ঘরোয়া ফুটবলে খেলেছেন কায়সার হামিদ, সাব্বির, রক্সি, গাউসরা। আর মুন্না তো জায়গা করে নিয়েছেন ইস্ট বেঙ্গলের ‘হল অব ফেমে’। ইস্ট বেঙ্গল ২০২৩ সালে ক্লাবের ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলারদের।

বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের মধ্যে প্রথম ভারতীয় লিগে খেলেছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ২০১৮ সালে সেথু এফসির জার্সিতে ৭ ম্যাচে ৬ গোল করেছিলেন সাবিনা। সেবার সাবিনার সঙ্গে খেলেছিলেন কৃষ্ণা রানী সরকারও। ২০২৪ সালেও সাবিনা আছেন। খেলবেন কর্ণাটকের কিকস্টার্ট ক্লাবে।

সানজিদাকে নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসেছে কলকাতার গণমাধ্যম। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ তো লিখেই দিয়েছে, ইস্ট বেঙ্গলে প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে সানজিদা ফিরিয়ে আনবেন মুন্নাদের গৌরব। আসলে ২০১৬-১৭ মৌসুম থেকে শুরু হওয়া নারীদের আই-লিগে কখনো কলকাতার কোনো দল শিরোপা পায়নি। সর্বশেষ তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন গোকুলাম কেরালা। চলমান সাত দলের আসরেও ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান তলানির দিকে। তাই কলকাতার ফুটবলভক্ত আর মিডিয়া উচ্ছ্বাসে মাতলেও সানজিদার জন্য ইস্ট বেঙ্গলে অপেক্ষা করছে কঠিন পরীক্ষা।

সানজিদার সঙ্গে তিন মাসের জন্য চুক্তি করেছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে সেরাটা দেওয়ার প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে সানজিদা বলেন, ‘আসলাম ভাই, মুন্না ভাইয়েরা ভারত থেকে সাফল্য নিয়ে এসেছেন। উনারা ইতিহাস গড়েছেন। ভারতে গিয়ে আমার একটাই কাজ, আমি যাব এবং খেলব। প্রত্যেকটা ম্যাচই আমাকে খেলতে হবে। ঢাকায় যেমনটা খেলেছি। এর চাইতে আরও ভালো খেলার চেষ্টা করব।’

সানজিদার তুলনায় সাবিনার জন্য কাজটা কিছুটা সহজ। সানজিদা প্রথমবারের মতো বিদেশি লিগে খেলছেন। কিন্তু সাবিনার ইতোমধ্যে মালদ্বীপ আর ভারতের ঘরোয়া লিগে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তা ছাড়া তার কেরালা দলটিও শক্তিশালী আর শিরোপাপ্রত্যাশী। দেখার বিষয় হচ্ছে, সাবিনা কেরালাকে শিরোপা জেতাতে সাহায্য করতে পারেন কিনা। আর সানজিদার মিশন মুন্নার মতো কিংবদন্তিদের সুনাম রক্ষা করা। দলীয় শক্তির বিবেচনায় ইস্ট বেঙ্গল শিরোপা না জিতলেও সানজিদার পারফরম্যান্সে যদি লিগ টেবিলে সম্মানজনক উত্তরণ ঘটে, তাতে নিশ্চিত তৃপ্ত হবে প্রয়াত মোনেম মুন্নার আত্মা। গর্ব বোধ করবেন আসলাম, রুমি আর গাউসদের মতো ইস্ট বেঙ্গলের জীবন্ত কিংবদন্তিরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //