পেলেকে ছাড়ালেও ‘মহানায়ক’ হতে পারেননি নেইমার

তর্কসাপেক্ষে ফুটবলের ‘জনক’ হিসেবে ব্রিটিশদের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। আর ফুটবলকে সারা দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলায় পরিণত করার দাবিদার শুধুই ব্রাজিল। যাদের ছন্দময় খেলার অপর নাম ‘জোগো বোনিতো, অর্থ ‘ভয়ংকর সুন্দর’। ছোট ছোট পাস, ছন্দময় গতি আর শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিখুঁত আক্রমণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল ব্রাজিলের ফুটবলের ট্রেডমার্ক। পেলে, গারিঞ্চা থেকে শুরু করে রোনাল্ডো নাজারিও আর রোনালদিনহো গাউচারা ছন্দময় ফুটবলের অনুপম প্রদর্শন করেই শাসন করেছেন বিশ্ব। 

দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাজিল বড় ছন্দহীন। তাদের খেলায় খুঁজে পাওয়া যায় না জোগো বোনিতোর শিল্প। ২০০২ সালের পর থেকেই ব্রাজিলের ছন্দময় ফুটবলের অবনতি। মূলত ইউরোপিয়ান ঘরানার ফুটবলে অভ্যস্ত হয়ে পড়া ফুটবলাররা ভুলতে বসেছেন নিজেদের চিরায়ত ছন্দের ব্যবহার। যা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ফুটবলবোদ্ধারা। ঠিক সেই সময়েই স্বস্তির মৃদুমন্দ হাওয়া হয়ে আসেন নেইমার জুনিয়র। 

নেইমারকে বলা হয় জোগো বোনিতো ধারার শেষ প্রতিনিধি। যার খেলায় রয়েছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। পুরো দলকে খেলানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে নেইমারের। সময় ধরে পায়ে বল রেখে এগিয়ে যাওয়া, নিখুঁত পাসে সতীর্থদের দিয়ে গোল করানো কিংবা নিজে গোল করায় সিদ্ধহস্ত। সম্প্রতি ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের মালিক বনে গেছেন তিনি। ভেঙেছেন ফুটবলের রাজা পেলের রেকর্ড। 

সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছে ২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। ল্যাটিন আমেরিকায় নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ব্রাজিল উড়িয়ে দিয়েছে বলিভিয়াকে। ব্রাজিলের ৫-১ গোলের জয়ে নেইমার বড় ভূমিকা রাখেন। নিজে করেছেন জোড়া গোল। ম্যাচের শুরুতে পেনাল্টি মিস না করলে হ্যাটট্রিক পেতে পারতেন। কাতার বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৭৭তম গোল করে তিনি ছুঁয়েছিলেন পেলেকে । বর্তমানে নেইমারের গোলের সংখ্যা ৭৯টি। পেলের রেকর্ড ভাঙলেও পেলে হতে পারেননি তিনি। ফুটবলের কালো মানিক ব্রাজিলকে এনে দিয়েছেন তিনটি বিশ্বকাপ। সেখানে নেইমারের আন্তর্জাতিক শিরোপা বলতে ২০১৩ সালের কনফেডারেশন্স কাপ। ২০১৬ সালের অলিম্পিক স্বর্ণ আছে, কিন্তু সেটা আন্তর্জাতিক ফুটবলের স্বীকৃতি না। 

নেইমারকে একটা সময়ে লিওনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করা হয়েছে। কিন্তু ইনজুরি প্রবণতায় নেইমার বারবার ছিটকে গেছেন। ফুটবল ইতিহাসে নেইমারের চেয়ে বেশি ইনজুরিতে পড়া খেলোয়াড় কেউ আছে কিনা সন্দেহ। ২০১৪ সালে নিজ দেশের মাটিতে ব্রাজিল ছিল হট ফেভারিট। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ভয়াবহ ইনজুরিতে পড়েন। তার অনুপস্থিতিতে সেমিফাইনালে ব্রাজিল ১-৭ গোলের লজ্জায় ডোবে জার্মানির কাছে। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পূর্বে কয়েক মাস ছিলেন মাঠের বাইরে। ২০২২ সালের বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি গ্রুপ পর্বের দুটি ম্যাচ। খেলতে পারেননি ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা। চলতি বছরেই ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মাস ছিলেন মাঠের বাইরে। 

বার্সেলোনায় মেসি আর লুইস সুয়ারেজের সঙ্গে নেইমারের ভয়ংকর ‘এমএসএন’ ত্রয়ী ফুটবলে চিরস্মরণীয়। ক্লাব ক্যারিয়ারে স্যান্তস, বার্সেলোনা আর পিএসজির হয়ে ৫৮৪ ম্যাচে তার গোলের সংখ্যা ৩৫৯টি, অ্যাসিস্ট ২৫৩টি। বিপুল সম্ভাবনা নিয়েও শুধু চোটের কারণে নেইমার পিছিয়ে গেছেন মেসি আর রোনালদোদের চেয়ে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ফুটবলে বড় কোনো স্বীকৃতি না পেলেও নেইমার বরাবর বড় খেলোয়াড় হিসেবেই বিবেচিত হয়েছেন। 

বর্তমান ব্রাজিল দলেও নিউক্লিয়াস নেইমার। শুরুতেই বলা হয়েছে, অতীতের তুলনায় বর্তমান ব্রাজিল দল বড় বেশি সাদামাটা। ব্রাজিলের খেলায় নেই রাজসিক ছন্দ। পাঁচবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হাহাকার করছে ষষ্ঠ শিরোপার জন্য। সেই স্বপ্নপূরণে নেইমার ছিলেন কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। অথচ অতিরিক্ত নেইমার নির্ভরশীলতার কারণেও ব্রাজিল হোঁচট খাচ্ছে। কিন্তু নেইমার ছাড়া ব্রাজিল অচল সেটাও প্রমাণ হয়েছে অনেকবার। তবে নেইমারকে নিয়ে ব্রাজিল অন্তত বড় কোনো লজ্জায় পড়েনি, হেরেছে লড়াই করে। নেইমার ব্রাজিলের প্রাণশক্তি এটা বারবার প্রমাণ হয়েছে। ব্রাজিলের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সেরা ফুটবলার তিনি, সর্বকালের সেরা গোলদাতা। কিন্তু তিনি পাননি রোলাদিনহো, রিভালদো আর রবার্তো কার্লোসদের মতো সঙ্গী। তাই সৃষ্টিশীল হয়েও তিনি পাননি মহানায়কের সম্মান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //