ফিদেলের প্রতি ভালোবাসাই ম্যারাডোনার রাজনীতি

একজন হলেন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী ও স্বনামধন্য রাজনীতিক। অপরজন ফুটবল খেলোয়াড়, ক্রীড়া জগতের কিংবদন্তি। আজকের দিনে এমন ভিন্ন জগতের দু’জন মানুষের মধ্যকার বন্ধুত্বের কথা চিন্তা করাও কঠিন। 

তবে দিয়াগো ম্যারাডোনার কাছে ফিদেল ক্যাস্ত্রো ছিলেন বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। তিনি এই কিউবান নেতাকে তার ‘দ্বিতীয় পিতা’ বলে গণ্য করতেন। তিনি একজন বিরল ক্রীড়াব্যক্তিত্ব- সমসাময়িকদের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে থাকা একজন, যাদের কারও কারও মধ্যে রাজনৈতিকতা ও প্রতিভা দুটিই ছিল ত্রুটিপূর্ণ।

ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে ফুটবলের মতোই জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল রাজনীতি। নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশে, বিশেষত লাতিন আমেরিকার বামপন্থী রাজনীতিকদের সমর্থন করার ক্ষেত্রে এই কিংবদন্তি ফুটবলার কোনো রাখঢাক করতেন না। ম্যারাডোনা ছিলেন ফিদেলের একনিষ্ঠ ভক্ত। সাবেক এই কিউবান নেতাকে তিনি নিজের আদর্শ হিসেবে ধারণ করতেন- তার বাম পায়ে ফিদেলের ও ডান বাহুতে আরেক আর্জেন্টাইন বিপ্লবী চে গুয়েভারার ট্যাটু করা ছিল।

ম্যারাডোনা-ক্যাস্ত্রোর বন্ধুত্ব

আর্জেন্টিনাকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপ জেতানোর পরের বছর, ১৯৮৭ সালে ফিদেলের সাথে প্রথম দেখা হয় ম্যারাডোনার। তবে তাদের বন্ধুত্ব বিকশিত হয় শূন্য দশকের প্রথম ভাগে, যখন এই ফুটবল কিংবদন্তি মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে কিউবায় বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত কোকেন গ্রহণের ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মরতে বসেছিলেন ম্যারাডোনা। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে প্রায় চার বছর কিউবায় ছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ওই সময়গুলোতে কীভাবে ফিদেল তাকে সহায়তা করেছেন। 

ম্যারাডোনা বলেন, ‘যখন আর্জেন্টিনার সব ক্লিনিকের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, কারণ তারা কেউ ম্যারাডোনার মরদেহ বহনের দায় নিতে চায়নি, তখন তিনি (ফিদেল আমার জন্য কিউবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন।’ 

ম্যারাডোনা আরো জানান, এই শক্তিমান কিউবান নেতা তাকে প্রাতঃভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাতেন এবং তার সাথে রাজনীতি ও খেলাধুলা নিয়ে আড্ডা দিতেন।

২০০৫ সালে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ফিদেলের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা, যেখানে দুইজনই তাদের মার্কিনবিরোধী অবস্থান সুস্পষ্ট করেছিলেন। ফিদেল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের পুননির্বাচিত হওয়ার পর তাকে ‘প্রতারক, মিয়ামির মাফিয়া সন্ত্রাসী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর ফিদেল মৃত্যুবরণ করার পর ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন ম্যারাডোনা। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কাঁদছিলাম। আমার বাবার চলে যাওয়ার পর এটিই আমার জন্য সবচেয়ে কষ্টের অনুভূতি।’ পরম বন্ধু ও ‘দ্বিতীয় পিতা’কে শ্রদ্ধা জানাতে ম্যারাডোনা তখন হাভানায় গিয়েছিলেন। চারবছর পর ঠিক একইদিনে, বুয়েনস আইরেসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই ফুটবল কিংবদন্তি।

এটি কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, ম্যারাডোনার সাথে ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শ্যাভেজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এক টেলিভিশন শো’তে ম্যারাডোনা মার্কিনবিরোধী অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছিলেন- ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রতিটি জিনিসকেই আমি ঘৃণা করি। আমি সর্বশক্তি দিয়ে তা ঘৃণা করি।’

ফুটবল স্টার হিসেবে তার প্রাথমিক দিনগুলোতেই ম্যারাডোনার রাজনৈতিক সচেতনতার দেখা পাওয়া যায়। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ গোলে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত জয়ের পর ম্যারাডোনা বক্তব্য দিয়েছিলেন। ম্যারাডোনার মতে, এটি ছিল একটি ফুটবল ম্যাচ থেকেও বেশি কিছু। এটি ছিল প্রতিশোধ, ১৯৮২ সালের যুদ্ধে ব্রিটেনের কাছে আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ হারানোর প্রতিশোধ। ২০০০ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম দিয়াগো’তে ম্যারাডোনা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই জয়টিকে ‘আমাদের পতাকার মান রক্ষা করা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ম্যারাডোনা বলেন, “এটি ছিল ‘লাস মালভিনাস’ পুনরুদ্ধারে আমাদের একটি প্রচেষ্টা।” ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জকে আর্জেন্টিনায় লাস মালভিনাস বলা হয়। ফুটবল কিংবদন্তি আরো বলেন, ‘এটি ছিল কোনো খেলা জেতার চেষ্টার চেয়েও বেশি কিছু। আমরা বলেছিলাম, খেলার সাথে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু ওই যুদ্ধে আর্জেন্টাইনরা মরেছিল, তারা তাদের পাখির মতো হত্যা করেছিল, সেটি আমাদের অজানা ছিল না। আর এটি ছিল আমাদের প্রতিশোধ। এটি আমাদের নিজেদের চেয়েও মহান: আমরা আমাদের পতাকার মান রক্ষা করছিলাম।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //