পুষ্টির ডিনামাইট ‘সুপার ফুড’ সজিনা

সজিনা আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় সবজি। সজনে বিভিন্নভাবে রান্না করা হয়। এটির বৈজ্ঞানিক নাম Moringa oleifera। সজিনার পাশাপাশি সজিনা পাতারও অনেক উপকারিতা রয়েছে। গবেষকরা সজিনা পাতাকে সুপার ফুড বলে থাকেন। বীজের শুঁটির আকৃতির কারণে ইংরেজিতে একে বলা হয় "ড্রামস্টিক ট্রি’।

পুষ্টি, ঔষধিগুণ ও সারা বছর ফলন পাওয়া যায় বলে বাড়ির আঙিনায় জন্মানো এই সজিনা গাছকে ‘মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ’ও বলা যায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে সজিনার উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ এশিয়া। শীত প্রধান দেশ ছাড়া প্রায় সারা পৃথিবীতেই এটি জন্মে। বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এর চাষ হয়। সারা বিশ্বে ১৩ প্রজাতির সজিনা পাওয়া যায়। এসব অঞ্চলে প্রদাহ থেকে শুরু করে গনোরিয়া কিংবা ম্যালেরিয়ার মতো রোগের প্রচলিত চিকিৎসায় সজিনা ব্যবহৃত হয়। একইসঙ্গে পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ থাকায় সজিনাকে ‘অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ’ ও ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। সজিনাকে ‘অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ’ ও ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।

সজিনার ব্যবহার

সজিনার পাতা, শিকড় এবং অপরিণত শুঁটি সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এছাড়া এই গাছের বাকল, শুঁটি, পাতা, বাদাম, বীজ, কন্দ, শিকড় এবং ফুলসহ গোটা অংশই খাওয়া যায়। সবজির চেয়ে এর পাতার গুণাগুণ আরও বেশি। সজিনা পাতায় নয় ধরনের অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো এসিডসহ ৩৮ শতাংশ আমিষ বিদ্যমান। এছাড়াও এতে আছে আয়রন, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ, বি এবং সি। সজিনার বীজে থাকে প্রোটিন এবং ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। কিন্তু সজিনার কার্যকারিতা কেবল ‘স্বাস্থ্যের জন্য ভালো’ বলেই শেষ করলে এর যথাযথ মূল্যায়ন হবে না বলেই ম্যাগাজিনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিপক্ক সজিনার বীজ উদ্ভিজ্জ তেল হিসেবেও পাওয়া যায়, যা রান্নার কাজে বা মেশিনে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া সজিনার বীজে থাকা আমিষ ব্যাকটেরিয়াকে জমাটবদ্ধ করে আলাদা করে ফেলে। তাই পানীয় জল বিশুদ্ধ করতে বীজের গুড়ো করে পাওয়া পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। সজিনায় প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট এবং অ্যামিনো এসিড থাকায় এটি ত্বকের এবং চুলের জন্য খুব উপকারী।  সবজির চেয়ে সজিনার পাতার গুণাগুণ আরও বেশি।

সজিনার ঔষধি গুণাগুণ

কেবল খাদ্য উপাদানই না, সজিনায় ঔষধিগুণও বিদ্যমান। এর বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাও বিভিন্ন রোগের প্রতিকার হিসেবে কাজ করে। পাতা বছরে সাতবার পর্যন্ত কাটা যায়। বর্ধনশীল, খরা-প্রতিরোধী এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এই গাছের অনেক অংশ আয়ুর্বেদিক ওষুধে ব্যবহৃত হয় বলে "অলৌকিক গাছের" তকমাও পেয়েছে সজিনা। ভারতীয় আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে, সজিনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। আধুনিক বিজ্ঞানও এ ধারণাকে সমর্থন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার দ্বারা পরিচালিত বিশ্বের বৃহত্তম চিকিৎসা গ্রন্থাগার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে সজিনার ঔষধি গুণাগুণের উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানি চিকিৎসায় সজিনা ব্যবহৃত হয়। এমনকি প্রথাগত পদ্ধতিতেও অনেক রোগের চিকিৎসায় সজিনা ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে পরীক্ষাগারে প্রাণীদের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, সজিনা গাছের পাতা এবং বীজে সুরক্ষার জন্য জৈবসক্রিয় যৌগ উৎপাদিত হয়। ফলে এতে কার্ডিও-প্রতিরক্ষামূলক এবং প্রদাহ, হাঁপানি, জীবাণু এবং ডায়াবেটিক প্রতিরোধী শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য থাকে, যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় এমনকি শরীরে টিউমার ছড়িয়ে পড়াও প্রতিরোধ করে।

সজনের শুঁটিতে "ভালো" কোলেস্টেরল উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। সজনের শুঁটিতে ওলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ বীজ রয়েছে যা শরীরে উচ্চ মাত্রার "ভালো" কোলেস্টেরল উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। ২০১৩ সালে ওষুধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ফাইটোথেরাপিতে সজিনার প্রচলিত ব্যবহারের ওপর একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, সজিনা গাছের শুকনো পাতায় কমলালেবুর সাত গুণ ভিটামিন সি, দইয়ের চেয়ে নয় গুণ বেশি প্রোটিন, গাঁজরের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভিটামিন এ এবং কলার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি পটাসিয়াম থাকে। এছাড়াও এতে দুধের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম এবং পালং শাকের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি আয়রন থাকার ধারনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

অর্থাৎ কোন খাদ্য উপাদানের জন্য যেসব খাবারের ওপর আমরা তুলনামূলক অনেক বেশি নির্ভরশীল, সেই একই খাদ্য উপাদান কয়েকগুণ বেশি পরিমাণে থাকে সজিনার পাতা, শুঁটি ও বীজে। এছাড়া প্রদাহ, ক্ষত এবং টিউমার প্রতিরোধী হিসেবে সজিনার শিকড়ের নির্যাস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সজিনায় প্রচুর পটাশিয়াম থাকায় এর পাতার রস বা সবজি বা চা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে ও কমাতে সাহায্য করে।

চিকিৎসায় সজিনার ব্যবহার

কৃষি তথ্য সার্ভিস ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্যমতে,

  • শরীর, কান ও মাথাব্যথার মতো সমস্যায় সজিনা বিশেষভাবে উপকারী।
  • শরীরের কোনো স্থানে ব্যথা হলে বা ফুলে গেলে সজিনার শিকড়ের প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ফোলা সেরে যায়।

  • সজিনার আঠা দুধের সাথে খেলে ও কপালে মালিশ করলে মাথা ব্যথা সেরে যায়।
  • সজিনার ফুল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে।

  • আর ফুলের রস দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে মূত্রপাথরি দূর হয়। একইসঙ্গে তা হাঁপানি রোগের ক্ষেত্রেও বিশেষ উপকারী।

  • সজিনা পাতার রসের সাথে লবণ মিশিয়ে খেতে দিলে বাচ্চাদের পেট জমা গ্যাস দূর হয় এবং এর চাটনি হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।

  • এই রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়।


বাংলাদেশে সজিনার চাষ

বারোমাসি সজিনার জাত প্রায় সারা বছরই বার বার ফলন দেয়। এই গাছে সব সময় ফুল ও কচি শুঁটি দেখা যায়। আমাদের দেশে দুই থেকে তিন প্রকার সজিনা পাওয়া যায়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ৬৭৫ হেক্টর জমিতে ৮৩ হাজার ৩৮১ মেট্রিক টন সজিনা আবাদ করা হয়েছে।

এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৩ কেজি সজিনা রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। তবে এই পরিমাণ অত্যন্ত কম।

সজিনার অপকারিতা

কিছু ক্ষেত্রে সজিনার পাতা প্রজননরোধীও হতে পারে।

সজিনা পাতায় অনেক বেশি পরিমাণে পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ থাকলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত প্রবন্ধে এর কয়েকটি ঝুঁকির দিক উল্লেখ করা হয়েছে।

  • গর্ভবতী নারীদের জন্য: সজিনার পাতা প্রতিদিনের আয়রন এবং ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রজননরোধীও হতে পারে।
  • থাইরয়েড চিকিৎসায়: সজিনা থাইরয়েডের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও থাইরয়েডের চিকিৎসার সময় অন্য কোনো ওষুধের সাথে মেশালে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • ডায়াবেটিকসের ক্ষেত্রে: সজিনা পাতা রক্তে শর্করা কমিয়ে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি রক্তে শর্করার মাত্রা খুবই কমিয়ে দিতে পারে।
  • রক্তচাপের ওষুধের জন্য: রক্তচাপ কমাতে সজিনা ব্যবহৃত হয়। তবে রক্তচাপ কমানোর ওষুধের সাথে এটি খেলে তা রক্তচাপ অতিরিক্ত কমিয়ে দিতে পারে।

*উৎস: বিবিসি বাংলা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //