নৈতিক সাহিত্য

একজন লেখকের কাছে নৈতিক সেটিই যখন তিনি একটি লেখা শেষ করার পরে আনন্দ অনুভব করেন, তৃপ্তি অনুভব করেন। যদি লেখার পরে তিনি খারাপ বোধ করেন সেটিই অনৈতিক। ঠিক এই রকম করেই আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নৈতিকতা সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে, শিল্পের বোধ বদলে যাচ্ছে, নৈতিকতার ধারণা বদলাচ্ছে এবং দৃশ্যত লেখকেরা নৈতিক প্রতিশ্রুতি থেকে বেরিয়ে এসে অনেক বেশি স্বাধীন হয়ে উঠছেন। নৈতিকতাকেও তারা শৃঙ্খল মনে করছেন। আজকের লেখকেরা মনে করেন আমি সর্বৈব স্বাধীন, আমি লিখবো আমার যা ইচ্ছে, কোনো আইন, কোনো সামাজিক রীতি-নীতি বা নৈতিকতার শৃঙ্খলে আমাকে বাঁধতে এসো না। লেখক ডিএইচ লরেন্স কিন্তু তা বলেননি। তিনি বলেন, নৈতিকতা, সাম্য কিংবা ন্যায়বিচার কখনো সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় না।

আমি দেখেছি আমার বাঙালি বন্ধুরা কথায় কথায় আপেক্ষিকতার সূত্র টেনে আনেন। নৈতিকতার প্রসঙ্গেও তাদের বলতে শুনি, এটা আপেক্ষিক, ওটা আপেক্ষিক। একালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, আপেক্ষিকতার প্রয়োগ পদার্থবিদ্যায় খাটে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোনো আপেক্ষিকতা নেই। এই কথার মধ্যে নৈতিকতার একটি বৈশ্বিক ঐক্য দেখতে পাই। ভালো সকলের জন্যই ভালো এবং মন্দ সকলের জন্যই মন্দ।

ঊনবাঙালের ৩৯তম সভার থিমেটিক আলোচনা ছিল ‘সাহিত্যে নৈতিকতা’ নিয়ে। সভার আগে-পরে যা পড়েছি, সেসব সাহিত্যে নৈতিকতা কীভাবে এসেছে কিংবা দূরে থেকেছে তা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন মাহমুদ রেজা চৌধুরী। তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করেন, সমাজ, দেশ এবং আন্তর্জাতিক নানান অনুষঙ্গ নিয়ে ভাবেন, লেখেন।

যখন মানুষ বিশৃঙ্খল জীবন যাপন করত, নগ্ন থাকত, পেশিশক্তিই ছিল সমীহ আদায় করার একমাত্র উপায়, যা বুদ্ধিহীন প্রাণী অর্থাৎ পশুদের মধ্যে দেখা যায়, তখন অদৃশ্য কোনো বৃহৎ শক্তির অস্তিত্বের কথা বলতে শুরু করেন বুদ্ধিমান লোকেরা, সেই অদৃশ্যকে ভয় করতে বলেন, যা ক্রমশ সমাজে ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মেসিপটেমিয়ান সভ্যতার লোকেরা ভারতবর্ষে এসে বেদ রচনা করেন। তারা আমাদের বলেন, এটি অপৌরুষেয় গ্রন্থ। কাছাকাছি সময়ে যবুর আসে, ৭/৮শ বছরের মধ্যে তওরাত আসে, এর কিছুকাল পরে বাইবেল আসে, আরও ৫শ বছর পরে কোরআন আসে। দাবি করা হয় এর সবই ঐশী গ্রন্থ। এসব গ্রন্থই সর্বপ্রথম নৈতিক শিক্ষার বাণী প্রচার করে এবং সমাজে শৃঙ্খলা আনে।

মূলত ধর্মই নৈতিকতার জন্ম দেয়। অথবা বলা যায় নৈতিকতার প্রয়োজনেই ধর্ম সৃষ্টি করা হয়। ধর্ম মানেই এক অদৃশ্য শক্তির ভয়। সেই শক্তির নানান নাম আছে যদিও, প্রকৃতপক্ষে বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। যেহেতু সেই সুবৃহৎ শক্তি অদৃশ্য তাই তার স্বরূপ, শক্তি, মহত্ত্ব, ক্ষমতা ইত্যাদি জানার জন্য আমাদের এক শ্রেণির জ্ঞানী লোকের দ্বারস্থ হতে হয়। অদৃশ্য মহাপরাক্রমশালী বৃহৎ শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী দৃশ্যমান কিছু মানুষ, ক্রমশ এই মানুষেরাই সমাজের সবচেয়ে গণ্যমান্য লোক হয়ে ওঠেন, শাসক হয়ে ওঠেন। এভাবে সমাজে শাসক তৈরি হয়, শাসিত তৈরি হয়। ক্রমশ শাসক এবং শাসিতের সম্পর্ক প্রভু এবং দাসে রূপ নেয়। সময়ের পরিক্রমায় শাসক তৈরির নানান পদ্ধতি আবিষ্কার হয়, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি।

জার্মান কবি ও দার্শনিক ফ্রেডেরিক নিটশে এই জায়গাটিতেই আঘাত করেন। তিনি বলেন, নৈতিকতা একটি মন্দ জিনিস। নৈতিকতাই দাস এবং প্রভু তৈরি করেছে। নৈতিকতাই ঈশ্বর তৈরি করেছে। তিনি তার ‘দ্য গে সাইন্স’ গ্রন্থের এক কবিতায় একটি পাগল চরিত্র নির্মাণ করেন, সেই পাগল বলছে, ঈশ্বর মৃত। ঈশ্বরকে আমি মেরে ফেলেছি। নিটশে নিজেই আসলে সেই পাগল। তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল কাঠামো, মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, নৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাই ঈশ্বরকে তিনি হত্যা করেন। কারণ নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যই ঈশ্বরের জন্ম দিয়েছে মানুষ।

উনিশ শতকের দার্শনিক নিটশে নৈতিকতা পরিহার করার ধারণা কবি/সাহিত্যিকদের মধ্যে উসকে দিয়ে নতুন এক জাগরণ তৈরি করেন। ধর্ম থেকে উদ্ভূত নৈতিকতা, যা বহু বহুকাল ধরে ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইন দিয়ে সমুন্নত রাখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা কিছু মানুষের স্বাভাবিক এবং সহজাত চর্চার বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনের বা ধর্মের রক্তচক্ষু অনুপস্থিত থাকলেও তারা নৈতিকতার চর্চা অব্যাহত রাখেন। রাখেন এজন্য যে এতে করে সমষ্টিগতভাবে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মতৃপ্তি হয়, শান্তি অনুভূত হয়।

পরিণত বয়সের নিটশেকে বিশ্লেষণ করলে কিন্তু ঈশ্বরের হত্যাকারীর দেখা মেলে না। তিনি আসলে নাস্তিকও ছিলেন না। তার দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ভয়ে কিংবা প্রলোভনে নয় মানুষ নৈতিকতার চর্চা করবে বিবেকের তাড়নায়।

ইউরোপীয় লেখক/শিল্পী গোষ্ঠী অধিক বাক স্বাধীনতা উপভোগ করেন বলে তারা যা খুশি তাই বলতে পারেন, লিখতে পারেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের সাহিত্যে নৈতিকতারই বিজয় ঘটে। ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল ‘ঈশ্বর কি মৃত?’ শিরোনামে একটি কভার স্টোরি ছাপা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনে। কভারে বড়ো করে তিনটি শব্দ লেখা ছিল, ‘ইজ গড ডেড’। আমেরিকার মানুষ এটিকে ভালোভাবে নেয়নি। এ ধরনের কভার করার প্রতিবাদ জানিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের দপ্তরে ৩,৪২১টি চিঠি আসে।

আমার সহ-আলোচক মাহমুদ রেজা চৌধুরী নৈতিকতা প্রসঙ্গে ‘ধর্ম’ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের একাংশ উষ্মা প্রকাশ করতে শুরু করেন। ‘সাহিত্যে নৈতিকতা’ বিষয়টিই ভালো লাগেনি অনেকের। তারা আলোচকদের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, তাহলে কি সমাজের হাজারো অনৈতিক ঘটনা সাহিত্যে আসবে না? এটি ছিল সেদিনের শ্রেষ্ঠ জিজ্ঞাসা। আমার উত্তর ছিল, অবশ্যই আসবে, সমাজের একটি পরিষ্কার চিত্র সাহিত্যে উঠে আসবে। তবে সাহিত্য যেহেতু লেখকের সৃষ্টি তিনি শেষ পর্যন্ত বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং নৈতিকতার পক্ষেই রায় দেন। সফোক্লিসের ইডিপাস নাটকের কথাও উঠে আসে দর্শকের প্রশ্নের সূত্রে। পিতৃহন্তা ইডিপাস মাকে বিয়ে করেছিলেন, এই অনৈতিকতা কি সাহিত্যে আসেনি? প্রশ্ন করেন অভিনেতা বন্যা মির্জা। জবাবে আমি বলেছিলাম, এই অনৈতিকতা উঠে এসেছে এবং এটি যে অনৈতিক তা লেখক এই নাটকে দেখিয়েছেন। পুরো বিষয়টি ঘটেছে অজ্ঞতাবশত কিন্তু যখন ইডিপাস তা জানতে পারেন তখন নিজেই প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য নিজের দুচোখ অন্ধ করে ফেলেন। নৈতিকতা এবং অনৈতিকতার সংঘাতে শেষ পর্যন্ত নৈতিকতারই বিজয় হয়। এভাবে লেখকেরা নৈতিক এবং অনৈতিক বিষয়গুলো কখনো সরাসরি আবার কখনো প্রতীকের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করেন।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বড়ু চণ্ডীদাস লিখেছেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। কুসুমকুমারী দাশ লিখেছেন, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে”। মদনমোহন তর্কালঙ্কার লিখেছেন, “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি”। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান”। কবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন, “আমার এ-ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর”। এমনি অসংখ্য নৈতিক পদাবলিতে ঠাসা বাংলা কবিতার ভুবন। গদ্যেও প্রচুর নৈতিক সাহিত্য রচিত হয়েছে।

সাহিত্য হচ্ছে সমাজ বিনির্মাণের পরোক্ষ আইন। কেবল নৈতিক সাহিত্যই এই ভূমিকাটি পালন করতে পারে। আমরা যে যেই ধর্ম কিংবা মতবাদের অনুসারীই হই না কেন, কিংবা নিটশের মতো ধর্ম/মতবাদ-শূন্য মানুষ হয়ে শুধুমাত্র বিবেক-পরিচালিত হই না কেন একথা সকলেই মানেন, মানবতাই শেষ কথা। আমরা সকলে মিলে সর্বকালে একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠারই চেষ্টা করেছি এবং ভবিষ্যতেও করব। সেই সমাজ নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নৈতিক সাহিত্য।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //