স্বদেশ ও স্বাধিকারের রঙ রেখা

মানুষ কেবল তার আয়ুষ্কালেই বাঁচে না, যদিও কারও কারও বেঁচে-বর্তে থাকা হয়তো কেবল বর্তমানে বলয়িত। আর এক পদের মানুষ বাঁচেন সর্বদা অনিবার্য বর্তমানে আর তার যোগসূত্রে অনাগত ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সীমাহীন আয়ুষ্কাল পকেটে পুরে। তেমনি একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী রশিদ চৌধুরী, যিনি একার স্বার্থপর শিল্পযাত্রায় নয় সমষ্টির শিল্পপুরাণ পালার বিবেক হয়ে বেঁচে থাকেন। 

‘সৎসাহস জ্যাঠামি নয়, সৎসাহস হচ্ছে দূরকে দেখতে পাবার ক্ষমতা।’-  আহমদ ছফা 

এক শিল্পসর্বস্ব জীবন বলতে যা বোঝায় তা শিল্পী রশিদের একান্ত আরাধ্য ছিল সেটা বলাই যায়। চাক্ষুষ না দেখলেও গবেষণা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিস্তর জেনেছি, জানার আছে আরও অনেক। প্রণবরঞ্জন রায়, মাহমুদ শাহ কোরেশী, বেলাল চৌধুরী, মীজানুর রহমান, ওবায়েদ জায়গীরদার, বোরহানউদ্দিন জাহাঙ্গীর, জুলফিকার চৌধুরী, শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক, জুনাবুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, চন্দ্রশেখর দে, হাসি চক্রবর্তী, সুবীর চৌধুরী, মোহাম্মদ মহসিন, সুনীল দাস, মতলুব আলী, স্বপন চৌধুরী, রফিকুল আলম, তরুণ ঘোষ, রণজিৎ দাশ, সেলিম আহমেদ, হাবিব ভাই এমনি অনেকের কাছে শুনেছি তাঁকে নিয়ে। আর যেটুকু শোনা বা জানা হয়নি তা গত তেত্রিশ বছরব্যাপী আমার টানাপোড়নের সঙ্গতে বলাবলি করেছি। বয়নচিত্র চর্চার মাধ্যমে জানাশোনা তৈরি করতে চেয়েছি। সে পথ সহজ নয় জেনেও। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে মাত্র ৫৪ বছরের শিল্পীপ্রাণ তাঁর মর্ত্যধাম ছেড়েছিলেন। সেদিন ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর, বিজয় দিবসের মাত্র চার দিন আগে। আজকে তাঁর পঁয়ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে এক শিল্প-উত্তরসূরির স্মরণশ্রদ্ধার এ অর্ঘ্য নিবেদন। 

শিল্পী রশিদ তাঁর যাপনকালে যেমন প্রতিনিধিত্বমূলক সৃজনকর্মের ঐশ্বর্যময় ভুবনের স্রষ্টা তেমনি পূর্ব ও উত্তরকালে উত্তরণ ও সিদ্ধি অর্জনে শিল্পকলা দৃশ্যপট পাল্টে দিতে অনুকূল হাওয়া বইয়ে দিতে তৎপর হয়েছিলেন, তা সকলেরই কম বেশি জানা হলেও এটুকু বলা সঙ্গত যে, তাঁর শিল্পী সংবেদ তাড়িত ব্যাকুলতা স্বপ্নময়তার দ্বান্দ্বিকতায়। তাঁর সামনে ছিল স্থান ও কালের সঙ্গে নিজের শিল্পতৎপরতাকে সম্পৃক্ত করবার সংগ্রাম। সমকালীন যুগশিল্পী হয়ে ওঠার তৎপরতা। যা সমকালকে ছাড়িয়ে ভবিষ্যদ্বাদী সৃজন কল্পলোকের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। তাঁর সমকালে সহপাঠীদের কাউকেই কার্যত তাঁর সমধর্মী ভূমিকায় দেখা যায়নি! এই না পাওয়া যাওয়া চট্টলার শিল্পের কুরুক্ষেত্রে তখন সুদূর প্রসারী পরিপ্রেক্ষিতের সামনে বুক চিতিয়ে যিনি দাঁড়িয়ে যান, তিনি বোধ উপনীত রশিদ স্বয়ং। অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু ‘দায়’ এড়াতে যারা অক্ষয় আলোর কৌটোয় চোখ সেঁধিয়ে দেখেন প্রাত্যহিকের ‘বিপ্লবের স্তর’ তারা সেখানে অন্ধকারের প্রলেপ দেখতে পান- অথচ রূপকথার কৌটোর মতো সে চোখের মিছিলে আলো ছড়ায়, মায়া দিগন্তের অভ্যুদয়ের ইতিহাস তৈরি করে তা দেখেন না। তখন ছিল ইতিহাস সৃষ্টির পূর্বরাগ। বাংলার বুকে তখন  প্রাক সত্তর দশকের রাজনৈতিক হিংসা, বোমা, খুন, তাণ্ডব, বিদ্রোহ, দখলের আখ্যান-উপাখ্যানের উপত্যকা।  

শিল্পের তথা শিল্পীর কাজ মনোরঞ্জন করা! রহস্য করা! এমনটাও এক পক্ষের মতো! ‘রহস্য যদি, তবে আর দায়-দায়িত্বের কথা ওঠে কী করে? ওঠে এ কারণে যে, জাদুরহস্য যাকে চমৎকৃত করে- তা মানুষের নির্বুদ্ধিতা; কিন্তু শিল্পরহস্য যাকে অভিভূত করে, তা মানুষের বোধ। এবং বোধ কথাটির প্রথমপাঠই হচ্ছে দায়িত্ববোধ।’১ 

সমাজে পরস্পরবিরোধী সামাজিক দর্শনের বিরোধ বিতর্ক সংগ্রাম মানব সমাজের সৃষ্ট; কিন্তু আপামর জনগণ তার সংঘাতের বীভৎসতায় দীর্ণ, উৎপীড়িত। সদলে সেখানে মুখোমুখি ন্যায় অন্যায় প্রগতি কল্যাণ সংঘাতের অনিবার্যতায় পর্যবসিত। ফ্যাসিস্ট শাসকের অত্যাচার, লুণ্ঠন, দুর্ভিক্ষ, হত্যা, বলাৎকার এর বিরুদ্ধে দ্রোহ প্রতিবাদ প্রতিরোধের শিল্প কালের সাক্ষী হিসাবে যতখানি তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এর ভেতরের অনর্নিহিত শিল্প উৎকর্ষ। তা কি শিল্পের একধরনের রাজনীতি নয়? এই এক চলমান তর্কের বিষয় বটে। বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে এমন অনেক শিল্পীর নাম করা যায় যাঁরা কি-না দায়িত্ববোধের তাড়নায় মানব ইতিহাসের সেসব ক্রান্তিলগ্নে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্টের মর্যাদার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছেন। সংঘাতের মধ্য দিয়ে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় ‘অভিশপ্ত রাজনীতির’ বিরুদ্ধে শাশ্বত মানবিকতার শৈল্পিক আয়োজনে উদ্বুদ্ধ হয়ে রচনা করেছেন কালজয়ী সব শিল্পকর্ম।

ফরাসি শিল্পী দ্যালাক্রোয়ার ‘লিবার্টি লিডিং টু দ্য পিপল’ (১৮৩০) তা ছাড়া গোইয়ার ‘দ্যা ম্যাসাকার অব দ্য থার্ড অব মে ১৮০৮, কাথে কোলভিতসের  ‘মেমোরিয়াল অব আর্ট লিয়েরকেনেকট’, শিল্পী পিটার পল রুবেন্স এর আঁকা ‘নিরপরাধীদের গণহত্যা’, ‘যুদ্ধের আতংক’ (১৬১১- ১৬১২) ও শিল্পী থিওডোর জেরিকো’র ‘মেডুসার ভেলা’ (১৮১৮-১৮১৯), পিকাসো ও তাঁর গুয়ের্নিকা শিল্পকর্মটি ইত্যাদি প্রতিবাদী শিল্পের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জয়নুল আবেদিনের মন্বন্তরের রেখাচিত্রগুলো সমগ্র বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে মানবিক বিপর্যয়ের এক অসামান্য দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তেভাগা আন্দোলন ও মন্বন্তরের ছবি নিয়েই বৃহত্তর সামজিক দায়বোধের আঙ্গিনায় প্রবেশ করেছিলেন শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ও শিল্পী সোমনাথ হোর। 

সংগ্রাম, যুদ্ধ, বিজয় এসব যেমন প্রত্যাশার স্মারক তেমনি স্বপ্ন ভঙ্গ, অপ্রাপ্তিতে দৈন্যতা, অক্ষমতাকেই প্রকট করেছে! অধিকার আদায়ের সংগ্রাম রাজনৈতিক বিজয় হলেও জাতির চেতনাগত বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক প্রত্যাশার অগম্যতা জনিত হতাশা আছে অপূরণীয়তা আছে, আছে শিল্পকলা চিত্রকলায়ও। প্রশ্ন হলো এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা কেমন ছিল, সামগ্রিকতার বিচারে আদৌ সেই প্রচেষ্টা যথেষ্ট ছিল কি? সংক্ষুব্ধতা ছন্দিত লাবণ্যে রূপান্তরিত হয়, চৈতন্যের আলোকিত জয়যাত্রাই মানুষের সৌন্দর্যবোধের উৎস। যেখানে জীবন নন্দিত হয় আবহমানের শিল্পে।  

প্রতিটি মানুষের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরিধি আছে, যা সমাজ কাল পরিবাহী। শিল্পী যত দিন নিজে কার্যকারণ দিয়ে অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করতে না পারবে, ঠাহর করতে করতে যদি পাল্টে দেবার প্রতিবাদের বিশ্বাসে স্থিত হতে না পাওে, তবে পরিস্থিতির ধারাভাষ্য গোছের সেই শিল্পমেধা ক্ষণস্থায়ী হয় এর বিস্তার ঘটে না! ফলে এ জাতীয় শিল্পচর্চায় ঘূণ ধরে এর বিস্তার অভ্রভেদী হতে পারে না।

এখনো ক্ষমতা প্রতিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়! কেউ কেউ বলেন, এই ছোট ছোট প্রতিবাদের সদর্থকতার বৃত্তগুলোকে সঞ্জীবিত রাখাই ললিতশিল্পের কাজ। শিল্প সৌন্দর্য্যরে কৌশলের ও তাই কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই মানুষের শিল্পপ্রক্রিয়ার। শিল্পকলা স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে।

শিল্পীর সচেতন জীবন সমীক্ষা নিজের আত্যন্তিক প্রবাহে জমিন ফুঁড়ে উত্থিত হওয়ার প্রনোদনার ঢঙে চিত্রকলায় কেবল তাৎক্ষণিক স্লোগানধর্মী প্রচার উদ্দীপনায় উচ্চকিত হতেই পারে, হয়েছেও বিস্তর; কিন্তু একটা জাতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের ক্ষেত্রে কালজয়ী সৃষ্টির লক্ষণ কি সেখানে যথাযথ প্রতিভাত? দ্যালাক্রোয়ার স্বাধীনতা, রুবেন্স, জেরিকো, গোইয়ার চিত্রকর্ম বা পিকাসোর গুয়ের্নিকার মত স্মারকসম সৃষ্টির জন্য কি বাঙালির বিগত কালের দ্রোহ- স্বাধিকার- যুদ্ধ ও বিজয় ইত্যকার ঘটনাবলি যথেষ্ট কিনা, তা হয়তো আরও বিশ্লেষণের দাবি রাখতেই পারে! যা বাংলার মানুষের লড়াই সংগ্রামকে কালোত্তীর্ণ আবেদনম-িত শিল্প বিবেকের মর্যাদায় আসীন করতে পারত? হয়ে উঠতে পারত বাঙালির চিরায়ত সংগ্রাম মুখরতার আবেগ মথিত সমষ্টির শিল্প পুরাণ।

একটা পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় নতুন ধরনের শিল্প আন্দোলন বা শিল্প অভীপ্সা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। যার মাধ্যমে গড়ে ওঠে নতুন চিত্রভাষা, চিত্ররীতি। আর আন্দোলনের সুদূর প্রসারী ঢেউ গিয়ে পরে জনতার ওপর। জনতার প্রতিক্রিয়া ফিরে আসে শিল্পীর কাছে। এই প্রতিক্রিয়া কত তৎপর হবে, তা নির্ভর করে সামাজিক পরিস্থিতির ওপর।

‘যদি তুমি ফিরে না আসো,

দেশের প্রত্যেক চিত্রকর বর্ণের অলৌকিক ব্যাকরণ 

ভুল মেরে বসে থাকবেন। প্রত্যেক কবির খাতে 

কবিতার পঙ্্ক্তির বদলে পড়ে থাকবে রাশি রাশি মরা মাছি।’ ২ 

‘শিল্পীর কতটা স্বাধীনতা দরকার? নির্বোধেরা  মনে করে এবং দাবি করে যে শিল্পীর দরকার অবাধ স্বাধীনতা। যেন শিল্পীকে সমাজ রাষ্ট্র অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেবে, আর সে মনের আনন্দে শিল্পকলা সৃষ্টি করে চলবে। এটা শিল্পকলা ও স্বাধীনতা সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী ভ্রান্তি। সত্য এর বিপরীত। সাধারণ মানুষের থেকে একবিন্দুও বেশি স্বাধীনতা শিল্পীর দরকার নেই। সাধারণ মানুষেরই দরকার অবাধ স্বাধীনতা, কেননা তারা স্বাধীনতা সৃষ্টি করতে পারে না; শিল্পীর কোনো দরকার পড়ে না, দিয়ে দেওয়া স্বাধীনতার, কেননা শিল্পীর কাজই স্বাধীনতা সৃষ্টি করা, আর স্বাধীনতা সৃষ্টি করার প্রথাগত নাম হচ্ছে শিল্পকলা।’ (হুমায়ুন আজাদ) 

গত শতকের ৬৯ থেকে ৭১ সাল। গনগনে আঁচে বাংলা তখন রাজনৈতিক তথা সংগ্রামের উত্তাপে অগ্নিগর্ভ। শিল্পী রশিদ চৌধুরী তখন হার্ভেস্টিংয়ের বছর দুই পর আঁকলেন ‘বাংলায় বিদ্রোহ’। একাত্তরে করা তাঁর সৃষ্ট ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ স্কেচ বা পরবর্তীকালে ওসমানী মিলনায়তনের জন্য করা সুবৃহৎ ট্যাপেস্ট্রির পটভূমি জুড়ে মানুষ গাছপালা প্রাণীসহ বাংলার চিরায়ত প্রকৃতির রূপ, প্রতিরোধ প্রত্যয় প্রতীয়মান হয়। তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর রঙ রেখায় স্বদেশ ও স্বাধিকারের ইচ্ছার প্রতিফলন স্পষ্ট। এই পর্যায়ে বক্ষমান নিবন্ধে ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালে শিল্পী রশিদ চৌধুরীকৃত দুটি চিত্রকর্মের শিল্পবীক্ষণ হাজির করার প্রয়াস।

হারভেস্টিং, বয়নচিত্রে উৎকীর্ণ স্বদেশ

তখন ঊনসত্তর সাল। উত্তাল ঊনসত্তর। অসহযোগের ঊনসত্তর। পরের বছরই জাতীয় নির্বাচন। তার পরের বছর মুক্তি সংগ্রাম। বাংলার জনজীবন শিল্পীর রঙ ও বিশেষণের মতোই বিশেষায়িত। ফসল সংগ্রহের সে কালে এমন করেই ধরা দিয়েছিল শিল্পীর মানসলোকে। যেখানে যাপিত জীবনের সব রঙ আগ্রাসী উচ্ছ্বাসে দেদীপ্যমান। ধান্যলোকে মৌসুমের সোনালি আভায় যেমন চাষির ভবিষ্যৎ রচিত হয়, তেমনি কি তিনি জাতির অনাগত বিজয়ের স্বর্ণালী আভা তাকে বিমোহিত করেছিল? তবে এই স্বর্ণালু অর্জন যে বিষাদ মাড়িয়ে ছাড়িয়ে অর্জন তাও স্মরণে রেখেছেন। ফলে মৃত্যুর কালো আর কাফনের সাদাকেও তাই তাঁর রঙ যাপনের অংশ করে নিয়েছেন। দর্শকদেরও এমন এক রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। 

রঙিন পোড়েন সুতায় বোনা এই বয়নচিত্রটি তাঁর অনেক শিল্পকর্ম থেকেই আলাদা। অনেক বিশেষত্ব আছে তাঁর এই কাজে। রশিদ চোধুরীর ট্যাপেস্ট্রিতে শিল্পীর নিজস্ব স্বাক্ষর চিহ্ন জঈ দেখতেই আমরা অভ্যস্ত; কিন্তু একদা তিনি নিজের নামের আদ্যাক্ষর ‘রচৌ’ ব্যবহার করতেন। বাংলা হরফে স্বাক্ষর চিহ্ন ও সন যে সামান্যসংখ্যক কাজে দেখতে পাওয়া যায় এই শিল্পকর্ম তার একটি। পুরো চিত্র জমিনজুড়ে সাতটি অসমাপ্ত বাক্য আছে। যেমন-১. শরতের নীল ২. মৃত্যুর কালো ৩. বাসন্তী হলুদ ৪. টিয়ার সবুজ ৫. কাফনের সাদা ৬. রক্তের লাল ৭. সোনালি ফসল। প্রতিটি দুই শব্দের। ছয়টি ধ্বনি বর্ণ আছে দুটি শব্দ মিলে। সাতটি রঙের নাম উল্লিখিত হয়েছে তাতে। প্রতিটি রঙের পরিচিতিমূলক বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। রংগুলো যথাক্রমে, নীল, কালো, হলুদ, সবুজ, সাদা, লাল, সোনালি। বিশেষণসমূহ শরত, মৃত্যু, বাসন্তী, টিয়া, কাফন, রক্ত, সোনালি। সাতরঙ এখানে সাত সংখ্যা, বাংলার সাতরঙা আলোর মশাল!

নবান্নে ফসল সংগ্রহের প্রতীকী প্রতীতির মধ্য দিয়ে কী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি জাতির আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন? তখন দেশভাগের পর আড়াই দশক অতিক্রান্ত, পূর্ববঙ্গের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিবাদের আর এক ক্রান্তিলগ্ন উনসত্তর সাল। কৃষক যেমন মৌসুমজুড়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ফসল সংগ্রহ করে, তেমনি জাতির আশা আকাক্সক্ষার রাজনৈতিক অধিকারের ফসল স্বাধিকার অর্জন প্রতীকায়িত হয় শিল্পী রশিদ চৌধুরীর এই বয়নচিত্রে।

চিত্র জমিনের ওপর থেকে পর্যায়ক্রমে বাম থেকে ডানে অক্ষরভাষলগ্ন সাতটি অসমাপ্ত বাক্য উৎকীর্ণসহ গঠন করেছেন এই চিত্রনির্মিতি। সঙ্গে আছে বর্ণ, আর তাতে সংহতি এনেছে আকার আকৃতির যোজনা। সাধারণত অক্ষরের আকার যেমন হয় এখানে তা নয়, বাংলা অক্ষরগুলো মাত্রা ছাড়া ব্যবহার করেছেন। এই বর্ণ ব্যবহার রেখা ও রঙের সামঞ্জস্যে ভারসাম্যপূর্ণ। অক্ষরের মাত্রা সর্বদাই সোজা রেখায় হয় বলে তিনি চিত্র গঠনের সঙ্গে পরিপূরক করতে মাত্রাকে পরিহার করেছেন সজ্ঞানে। ফলে বাংলা হরফের যে নানামুখী রেখা সমৃদ্ধ গঠনভঙ্গি তা অপরাপর বিষয় আকৃতির সঙ্গে স্বনিষ্ট।

হার্ভেস্টিং বয়নচিত্রে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙ আলাদা ভাবে আপাত বিরোধাত্মক হলেও, ব্যবহারের মুন্সিয়ানায় তাদের পৃথক বর্ণ উজ্জ্বলতা নিয়ে দিব্যি ভারসাম্য বজায় রেখেছে। রশিদ চৌধুরীর বয়নচিত্রে যেমন অসংখ্য ফুটকি, বিন্দু রেখার অবয়ব নানা নির্মিতিতে হাজির হয়, এখানেও অক্ষরের অংশে একাধিক রঙ ব্যবহারে যে বিন্দুক্রম তৈরি হয় তা বর্ণ-উজ্জ্বল্যে থিতু হয়েছে। পাখি, প্রাণীর অবয়বী গঠনাভাস, চকিত ইশারা যেন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার চেয়েও খানিক বেশি বয়েসী এই চিত্রকথনটি যেন আমাদের আপন কথা। চেনা স্বরূপ, চেনা কথা, আটপৌরে অনাড়ম্বর অথচ চিত্তাকর্ষক। সবটা মিলে গোল বা বৃত্তাকার বেষ্টনীর আঁটোসাঁটো বিষয় সজ্জা। কোনো বিলাসী প্রকরণ নয়, দ্বিমাত্রিক তলে রঙ, আকার, রেখার বিন্যাসে বাঙালির বয়ন কারিগরিতে সৃষ্ট। ষড়ৈশ্বর্য্যরে পালায় যেমন চক্রাকার বা বৃত্তাবদ্ধ প্রকৃতিচিত্র, তারই মননশীল অভিক্ষেপ। 

কেন্দ্রীয় কাঠামোর যে জগৎধাত্রী রূপ তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত সাতরঙা রশিদীয় প্রতিবেশ। রশিদীয় আকাশ। গোড়া কেন্দ্রমুখীনতার অবগুন্ঠন নয় বরং বিকেন্দ্রিক হয়েও কেন্দ্রাভিভূত নিমগ্ন আস্থার রূপ সন্নিবেশ। রচৌ, ‘রঞ্জিত চৌপর’ রূপে হাজির হন এহেন ললিতকলার ধামে। রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণে যেমন আছে-

‘কুটুম্ব বান্ধব যত সভে রহে চারি ভিত।

নাট গীত করে গতি এ চারি চৌপর রাতি।’

বাংলায় বিদ্রোহ, দ্রোহ ও স্বাধিকারের সারাৎসার : ১৯৭১ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশ যুদ্ধজঠর থেকে কিছুদিন বাদে ভূমিষ্ঠ হবে। আর তার আগেই রশিদের শিল্পজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হলো ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ নামের অসাধারণ ‘সময় চিহ্নিত কাল’ এর সাক্ষী, রেখা নির্ভর অনাড়ম্বর এক সাহসী সংবেদী শিল্পকর্মের।

দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার আগেই নানা পেশাজীবী মানুষেরা একাত্ম হয়েছিলেন। চিত্র শিল্পীদের মধ্যে রশিদ চৌধুরী ও একাত্ম হয়েছিলেন শুধু নয় একাত্মতা গড়ে তুলতে প্রেরণাদায়ী চিত্র এঁকেছেন। তিনি তখন চট্টগ্রামে। তাঁর এক যুগের চট্টগ্রাম বসবাসের সময়টা ছিল দেশমাতৃকার অত্যন্ত ক্রান্তিকাল। তখনকার চারুকলা শিক্ষার প্রসারের দায়িত্ব, মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বদেশ ও স্বাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ শিল্পঅন্তঃপ্রাণ রশিদ চৌধুরী। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের উদযাপন সময়ে তাঁর আঁকা ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ শিল্পকর্মেরও পঞ্চাশ বছরে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

বাংলার সনাতন সংস্কৃতি তার প্রতিবেশ যেমন উদ্ভিদ পশুপাখি সবই পরস্পর নির্ভরশীল সঙ্গী। প্রাকৃতিক জীবনাচার ঘনিষ্ট এই একাত্মতা। সংগ্রামে সংক্ষোভেও তারা প্রত্যেকেই সহযোগী। এমনতরো ভাবতে পারা রশিদ তাদেরকে এককাতারে প্রতিরোধে শামিল করতে পারেন। অবয়বী চিন্তাকে তার ‘খোলনলচে’ সমেত ভাবগতিককে ধরেছেন। যেখানে নির্মিত অবয়বহীনতা কোনোভাবেই বস্তু সকলের ভাবভঙ্গি বিচ্যুত করে না। ফলে দৃশ্যের পরতে পরতে বিনির্মাণের তোড়জোর চলে দৃশ্যায়নে পরিব্যাপ্ত চরিত্রাবলির সমিল স্থির লক্ষ্যে আগুয়ান ভঙ্গিতে।

১৯৭১ সালে ‘শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ মঞ্চ, চট্টগ্রাম’ এই নামে সাংগঠনিক উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ শিরোনামের চিত্র প্রদর্শনীর প্রকাশনায় তাদের বক্তব্য ছিল- “বাংলায় আজ বিদ্রোহ। হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়: বাংলা যুগে যুগে বিদ্রোহ করেছে- অন্যায়, অবিচার আর অনুশাসনের বিরুদ্ধে। জনগণের কল্যাণ কামনায়, গণমানুষের মুক্তির জন্যে বাঙালির সংগ্রাম বিরামহীন। 

আজকের বিদ্রোহ আমাদের আগামী দিনের বিপ্লবেরই পূর্বাভাস। বাংলা দেশের প্রতিটি মানুষ আজ সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। অংশগ্রহণে সংকল্পবদ্ধ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমাজ।

চট্টগ্রামের ছ’জন বিশিষ্ট শিল্পী সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনের অভিযাত্রী। রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, সাবিহ-উল-আলম, মিজানুর রহিম, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ এবং আনসার আলী অঙ্কিত ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ ছয়টি চিত্র সংগ্রামী জনমানসে নতুন অভিব্যক্তি সঞ্চার করবে বলে আশা করি।”

মশাল ও পতাকা হাতে দুর্নিবার ভঙ্গিতে অগ্রসরমান প্রতিরোধ প্রত্যয় চিত্রটির প্রাণ। যেখানে সাদাকালো এই ছাপ ছবিটিতে একটি পরিবার সন্তান-সন্ততি, গবাদি পশু, বাঘ, সাপ, কুমির ও সহযাত্রী হয়েছে। আসন্ন যুদ্ধের চিন্তা তাতে অংশগ্রহণের সামগ্রিকতাকে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলার সর্বব্যাপী বহিঃশত্রুর আগ্রাসনে, আক্রমণে মানুষ, পশু, পাখি, জলজ ও ডাঙ্গার সকল প্রাণ-বৈচিত্রই যে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শত্রুকে পরাজিত করতে হবে এটাই এই চিত্রের সার্বজনীন বাণী। যুদ্ধের সার্বজনীনতাকে এখানে মানুষের যাপন বেষ্টিত প্রাণবৈচিত্র্যের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সমেত প্রতীকী সারাৎসারসহ প্রতিষ্ঠা দেয়।

শিল্পী দর্শকের জন্যও অনেকটা কাজ ফেলে রাখেন। উত্তীর্ণ মহৎ শিল্পে এই অব্যক্ত অনির্বচনীয় ভারটুকুই মুখ্যত শিল্পের মূল রসদ। সেখানে শিল্পের রস আছে। অমোঘ রসালঙ্কার জন্ম হয় শিল্পভোক্তার মনে, শিল্পীর দায় কেবল ভোক্তাকে তার সন্ধান বাৎলে দেওয়া। শিল্পী আয়না বাড়িয়ে দেয়, যে আয়নায় কলা দর্শক নিজেকে দেখার সঙ্গে মুগ্ধতা পাশ কাটিয়ে দেখেন ছাইচাপা আগুনও, সেই উস্কে দেওয়ার উস্কানিটুকুই দ্রোহী শিল্পের কাজ।

একটি দেশের জাতির রাষ্ট্রিক উদ্বোধনের যে সাংঘর্ষিক বিদ্রোহাত্মক সংগ্রামী যুদ্ধের জাগরণ তার মর্মমূলীয় ভাষা আত্মস্থ করে ইতিহাসের সেই বিশেষ ক্ষণের মানবমুক্তির তথা অত্যাচার নিগ্রহের নিগড় থেকে পরিত্রাণের পরিসমাপ্তি তথা বিজয় অর্জন এই বৃহত্তর চিন্তার সঙ্গে নিজের সৃজনকর্মকে ওতপ্রোত করে নিতে পারাই স্মরণযোগ্য দ্রোহের আত্মপ্রেরণাচালিত শিল্পীর শিল্পিত উৎসর্জন এর প্রতিভাস বলে চিহ্নিত হতে পারে।

তথাকথিত সমসাময়িক আধুনিকতার যে সব চর্চিত প্রবণতা তার বাইরে থেকেই রশিদ চৌধুরীর সমাজ ও দেশ চেতনার স্বরূপকে বুঝতে উদ্যোগী হতে হয়। তাঁর দ্রোহ ও প্রতিবাদের রকমও ভিন্ন, বাকি সব চেনা প্রক্রিয়ার ভাষা থেকে পৃথক। ফলে শিল্পী রশিদের শিল্প ভাষা নির্মাণে তাঁর রূপকাশ্রয়ী আদলে সমাজনিষ্ঠ বয়ান তৈরি হয়। সমাজ তার দেশ মাতৃকার প্রাণ প্রকৃতিকে অক্লেশে প্রতীকায়িত করে দ্রোহের সনদে জায়গা করে দেন। তা সরাসরি আঘাত প্রতিঘাত না হয়ে বিবেকের ‘ধ্বংস ও স্থিতি’ ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্মিত হয়। তাঁর শিল্পকর্মে স্বদেশ ও স্বাধিকারের রঙ রেখা হয়ে ওঠে উদ্বুদ্ধ-উৎকর্ষ-উৎসর্জনের উস্কানি। রশিদ চৌধুরীর স্বদেশ ভাবনাজাত ছবিই আসলে রশিদীয় ছবি, রশিদের ছবি, ছবির রশিদ। ফলত বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে রশিদ স্বাতন্ত্র্যেই প্রাসঙ্গিক ছিলেন, আছেন, থাকবেন। জয়তু রশিদ।

উদ্ধৃতি-

১. রণজিৎ দাশ 

২. শামসুর রাহমান, যদি তুমি ফিরে না আসো

চিত্র পরিচিতি 

১. হারভেস্টিং 

১৯৬৯, ট্যাপেস্ট্রি 

সংগ্রহ- বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর 

২. বাংলায় বিদ্রোহ

১৯৭১- লিথোগ্রাফ 

৩৫×৪১ সেন্টিমিটার

৩. রশিদ প্রতিকৃতি-সুনীল কুমার পথিক

৪. গৃহ কর্মশালায় রশিদ চৌধুরী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //