দ্য প্রফেট- মানব প্রেম ও ঈশ্বরের সম্মিলনে প্রস্ফুটিত

‘কাহলিল জিব্রান’ প্রাচ্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি তার রচনার মাধ্যমেই প্রকাশিত পুরো পৃথিবীময়। অসাধারণ শব্দ চয়ন, দুর্লভ অভিব্যক্তি আর ব্যতিক্রম রচনার শব্দময় দ্যোতনায় জিব্রান এক অনন্য নাম। মানবাত্মার পূজারী জিব্রানের দর্শন পরিবিষ্ট হয়ে আছে তার প্রতিটি রচনার পরতে পরতে। বাইবেলের ত্রোস্ত কিংবা শ্লোকের অনুরণন কিংবা রচনাশৈলীর মানবীয় প্রকাশ যেন ‘দ্য প্রফেট’। তাঁর রচনার মধ্যে তিনি একাধারে মরমী, দার্শনিক, ধার্মিক, ধর্মদ্বৈষী, শান্ত, বিদ্রোহী, সমকালীন এবং সর্বোপরি চিরকালীন।

‘দ্য প্রফেট’ বইটিকে লেখক সাজিয়েছেন মানবজীবনের সবগুলো মানবীয় বিষয়গুলোকে নিয়ে- যা সহজ, সরল কিংবা পারিপার্শ্বিকের চাপে যান্ত্রিক ও জটিল মানব মনের রিক্ততাকে অতিক্রম করে উষ্ণ করে তুলতে সচেষ্ট। প্রতিটি লেখার প্রকাশ পেয়েছে আত্মার অবিনশ্বরতার বিশ্বাসে, ঈশ্বরের বিশ্বাস কিন্তু সে ঈশ্বর বিশ্বাস কিংবা আত্মার অবিনশ্বরতার বিশ্বাস মানুষকে পরিত্যাগ করে নয়।

সে বিশ্বাস মানবাত্মার, মানবতার সহযাত্রীক বিশ্বাস। সেখানে ঈশ্বরও আছেন মানুষের মতো করে, মানুষের ভেতরে। ধর্মীয় গোঁড়ামির অচলায়তনে ঢাকা পড়েনি সে নান্দনিকতা বরং প্রস্ফুটিত হয়েছে স্নিগ্ধ শতদলের মতো। ‘একটা হৃদয়ের কথা ভাবো- যে হৃদয়ে মিলে গেছে সমস্ত হৃদয়, একটা ভালোবাসার কথা ভাবো- যার অধিবৃত্ত পথে ধরা পড়েছে সব ভালোবাসা; একটা আত্মা- যেখানে মিলেছে সব আত্মা; একটা স্বর যেখানে মিশে গেছে সকলের স্বর; একটা নীরবতা- যা তোমাদের সমস্ত নীরবতাকে অতিক্রম করে যায় এবং যা সময়হীন।’ কিংবা ‘যতো কম বলো ঈশ্বরের বিষয়ে, ততোই ভালো; তাকে আমরা বুঝতে পারিনা, যখন বুঝি, তখন পরস্পরকে বোঝার চেয়েও বেশি বুঝে নিতে পারি তাকে। তবুও বলবো যে, আমরা তার নিঃশ্বাস, তার সুগন্ধ। পত্রালিতে, পুষ্পে এমনকি ফলেও আমরাই ঈশ্বর।’ 

জিব্রানের ঈশ্বর তত্ত্ব এতেই পরিষ্কার হয়ে যার সকলের কাছে, যে তিনি সে ঈশ্বরের কথা বলেছেন- সে ভালোবাসার কথা বলেছেন, বলেছেন সে পবিত্র আত্মার অনুশাসন তা কখনোই মানুষকে অতিক্রম করে নয়, বরং মানুষের মধ্যেই অনন্ত সৌন্দর্য্য, অনন্ত প্রশান্তি ও নির্জনতার অনন্ত আলোকেই জিব্রান ঈশ্বর বলে জেনেছেন।

প্রতিটি বিষয়ের মাঝে জিব্রানের ঈশ্বর ভাবনা তাকে দান করেছে এক অপূর্ব নান্দনিকতা। ভালোবাসা বিষয়ে জিব্রান বলেছেন- ‘যখন ভালোবেসেছো তুমি, কখনো বলো না- ঈশ্বর হৃদয়ে আমার বরং বলো- ঈশ্বরের হৃদয়ে রয়েছি আমি।’ আসলে ‘ঈশ্বরের হৃদয়ে’ বিষয়টি জিব্রান বলতে চেয়েছেন মানুষের হৃদয়ে বা যাকে মানুষ ভালোবাসে তার হৃদয়ে।

কেননা জিব্রানের এই ঈশ্বর আসলে মর্ত্যরে এই মানুষ। যখন মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া যায়, তখন ঈশ্বর স্বমহিমায়, তাকে স্থান দেয় তাঁর হৃদয়ে। সেই মানুষের যাকে মানুষ ভালোবাসে, ঈশ্বর তাকে অবশ্যই তার ভালোবাসা দান করেন।

‘দ্য প্রফেট’-এ জিব্রান মানুষের কথা বলেছেন, আলোকময় মানুষের কথা কিন্তু কবিতার সুরে। ছন্দোবদ্ধ রীতিতে তিনি রচনা করেননি তার এই বানী, গীতল বাক্যের সুষমায় মানুষের একেবারে পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন দ্ব্যর্থহীন ভাবে। প্রবক্তার ভাষনের মতো মানুষকে শুনিয়েছেন তার উত্তরণের পথ, মুখ ফেরাতে বলেছেন তার অন্তর্হিত শক্তির দিকে।

‘দ্য প্রফেট’ রচনায় জিব্রান এমন এক ভারসাম্য বজায় রেখেছেন যা এই রচনাকে ধর্মদ্বেষনার গাম্ভীর্য থেকে রেখেছে দূরে কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুপ্ত ইচ্ছাটি প্রকাশিত হয়েছে কবিতার পরতে পরতে কিন্তু দায়হীন নির্ভার কবিতার শরীর যেমন তাঁর কাম্য ছিল না, তেমনি চাননি ধর্মের অনুশাসনের লৌহবেড়ি যা তাঁর রচনার চলনকে করবে মন্থর।

ফলে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঢঙে নতুন মাত্রার জন্ম দিলেন তিনি, যা কবিতার মতো হয়ে মানুষের হৃদয়ের একেবারে বন্ধ আলোকহীন জন্মতেও প্রবেশ করতে সফল। এইখানেই জিব্রানের কৃতিত্ব, চিরঞ্জীবিতা।

জিব্রানের এই রচনার সার কথা এই যে- তিনি মানবাত্মায় বিশ্বাসী, মানুষই তার একমাত্র অনুধ্যানের বিষয়। মানুষের মাঝেই তিনি খুঁজে ফেরেন ঈশ্বরকে। মানুষের মাঝেই তাই তিনি বার বার মানুষ হয়েই ফিরে ফিরে আসতে চান।

রচনার শিল্পকৌশল, উপস্থাপন রীতি, বিষয়বৈচিত্র্য জিব্রানকে যেমন করেছে স্বাতন্ত্র্য, তেমনি মানুষের প্রতি ভালোবাসা করেছে সার্বজনীন। তাইতো সার্বজনীন সে ভালোবাসার আলোয় তিনি হয়েছেন আরো মানবিক, আরো উজ্জ্বল যেন- আলোর বর্শে স্ফটিকটা হয়েছে জলপ্রপাত, আর তারই স্রোতে ভাসছে শিশু, ভাসছেন ঈশ্বর

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //