আমাদের ববিতা

ববিতা। বাংলাদেশে এমন সিনেমাপ্রেমী পাওয়া মুশকিল, যার হৃদয়ে এ নাম দোলা দেয় না। যে অস্বীকার করতে পারে তার অমোঘ আকর্ষণ। সেই স্বাধীনতার বছর দুই আগে শুরু। আজও তেমনি রয়ে গেছে তাঁর আবেদন। যেন এই বাংলার সুচিত্রা সেন। অবশ্য অনন্তযৌবনা হতে সুচিত্রা সেন গিয়েছিলেন আত্মগোপনে। তার গত যৌবনা রূপ কেউ কখনো দেখতে পায়নি। ববিতার সেসব করতে হয়নি। তিনি স্বরূপেই অতিক্রম করেছেন যৌবনের কালিক সীমারেখা। বুড়িয়ে গিয়েও যাননি। বাংলাদেশের সিনেদর্শকদের ভালোবাসায় এমনই সিক্ত তিনি। 

ববিতা অবশ্য তার নাম নয়। অন্তত বাবা-মার দেওয়া নাম নয়। তবে সেটি অস্তিত্বের সঙ্গে এমনভাবে সেঁটে গেছে, আজ আর তা অস্বীকারের জো নেই। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন পপি। ভালো নাম ফরিদা আক্তার। বাবা এএসএম নিজামুদ্দীন আতাউর ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সূত্রেই তাঁর জন্ম বাগেরহাটে। তবে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি যশোরে। বাড়ির নাম রাবেয়া মঞ্জিল। মা জাহান আরা বেগম ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। তার পদাঙ্ক অনুসরণের স্বপ্ন ছিল পপির, বড় হয়ে হবেন ডাক্তার; কিন্তু পথ বদলে দেন দুলাভাই। ভাগ্যিস!

তার বড় বোন ঢাকার আরেক কিংবদন্তি নায়িকা, সুচন্দা। সুমিতা দেবীর পরে তার মায়ায় বাঁধা পরেছিলেন জহির রায়হান। ঢাকার চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। প্রতিভায় সব্যসাচী। কিংবা দেবী দুর্গার পুরুষ অবতারও বলা চলে। যেন দশ হাতে শিল্প-সাহিত্যের দশ শাখায় সমান দক্ষতায় হাত চালিয়েছেন। গল্প-উপন্যাস থেকে শুরু করে সিনেমা- যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। সিনেমায় তার খোলতাই সবচেয়ে বেশি। প্রভাবও। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন সুচন্দাকে। পড়াশোনা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা বিভাগে। সেজন্যই বোধহয় শ্যালিকা পপিকে বাংলা পড়ানোর দায়িত্ব পরেছিল কাঁধে। প্রায়ই মজা করে বলতেন, ‘তোমাকে আমি নায়িকা বানাব।’ শেষে সত্যিই বানিয়ে ছাড়লেন। বিয়ের পরের বছরেই। 

সে ছবির নাম ‘সংসার’ (১৯৬৮)। মূল জুটি ছিল রাজ্জাক-সুচন্দা। ছবিতে তাদের এক কিশোরী মেয়ে আছে। সেই চরিত্রের জন্য শ্যালিকাকে পছন্দ করেন জহির রায়হান; কিন্তু বেঁকে বসেন পপি। সিনেমা তিনি কিছুতেই করবেন না। ততদিনে তারা সপরিবারে চলে এসেছেন ঢাকায়, সুচন্দার কল্যাণে। থাকেন গেন্ডারিয়ায়। সুচন্দার সঙ্গে একবার শুটিংয়েও গিয়েছিলেন কক্সবাজারে। নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘চাওয়া পাওয়া’য় (১৯৬৭)। দেখেছিলেন মাথার ওপর সূর্য নিয়ে বড় বোন কী কষ্ট করে শুটিং করেছেন। শটের হয়তো সব ঠিকঠাক হয়েছে। ট্রলিটা একটু নড়ে গেছে। আবার সব নতুন করে শুরু করো। আবার টকটকে সূর্য মাথায় নিয়ে সাগরপানে দৌড়াও। এত কষ্টের কাজ কেউ করে! তখনই ঠিক করে ফেলেছিলেন, আর যাই হোক, জীবনেও অভিনয় করবেন না। 

তবে সিনেমার প্রতি ভালোবাসা ছিল ঠিকই। একবার রীতিমতো আয়োজন করে স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। দলবেঁধে। সে গল্পও কম সিনেমাটিক নয়। ডাক্তার মায়ের অলিখিত অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন তিনি। মা সবাইকে বিনামূল্যে ওষুধ দিতেন। তবে তার না থাকার সুযোগ ছাড়তেন না পপি। সেই পয়সা জমিয়েই করেন সিনেমা দেখার আয়োজন। তখন গরমের সময়। স্কুলের মধ্যে এক বান্ধবী অজ্ঞান হওয়ার ভান করল। সেই অজুহাতে মিলল ছুটি। তারপর সবাই মিলে ছুটলেন নাজ সিনেমা হলে। সেখানে তখন ইংলিশ ছবি চলত। দেখেছিলেন ‘হোটেল সাহারা’ (১৯৫১)। এত পরিকল্পনাতেও অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পরে গিয়েছিলেন। পরদিন শাস্তিস্বরূপ স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কান ধরে, সদলবলে। 

কিন্তু সে ভালোবাসা তখনো এতটাও গাঢ় ছিল না যে, সিনেমায় অভিনয়ের কষ্ট করবেন। বয়স তখন কতই-বা! তের-চৌদ্দ হবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন মাত্র। জহির রায়হান তখন তারকা পরিচালক। এমন প্রস্তাব পেলে অন্যরা বর্তে যেত। পপি বসলেন বেঁকে। উল্টো বাড়ির লোকে বোঝাতে বসল, জামাই বাবুর অনুরোধ। না রাখলে কেমন দেখায়। শেষমেশ রাজি হলেন। সিনেমার জন্য তার নাম দেওয়া হলো ‘সুবর্ণা’। পর্দায় তার প্রথম নায়ক হলেন মাহমুদ সাজ্জাদ। মুক্তি পায় ১৯৬৮ সালের ১০ মার্চ। পরিচালক হিসেবে অবশ্য নিজের নাম দেননি জহির রায়হান। অনেক ছবিতেই এমনটা করেছেন তিনি। গছিয়ে দিয়েছেন সহকারীদের। এটাতে যেমন যৌথভাবে নুরুল হক [বাচ্চু], রহিম নওয়াজ ও মুস্তফা [মেহমুদ]-কে। 

ততদিনে জহির রায়হান দুই পাকিস্তানেই নাম করে ফেলেছেন। বিশেষ করে উর্দুতে ‘সংগম’ (১৯৬৪) ও ‘বাহানা’ (১৯৬৫) বানানোর পরে। প্রথমটি ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি। পরেরটি প্রথম সিনেমাস্কোপ। এরপর আবার ফিরে আসেন বাংলা ভাষায়। বানান ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) ও ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭)। তবে পশ্চিমের অভিজ্ঞতা তাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। সেখানকার পেশাদার ইন্ডাস্ট্রিকে কাজে লাগানোর চিন্তা করেন। সঙ্গী আফজাল চৌধুরী। তিনি আগে লাহোরে কাজ করতেন। ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩) বানানোর সময় তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনেছিলেন জহির রায়হান। দু’জনে মিলে পরিকল্পনা করেন লাহোরেও একটি ঘাঁটি বানানোর। মূল ভাবনা ছিল পাকিস্তানের ছবির বাজার দখল করা। তখনকার বাস্তবতায় লাহোরে না বসে তা সম্ভব ছিল না। সেটিই করবেন ঠিক করেন জহির রায়হান ও আফজাল চৌধুরী। সেখান থেকে দুই ভাষার ছবিই বানাবেন। উর্দু ও বাংলা। 

পরিকল্পনা মোতাবেক দু’জনে যান লাহোর। হাজার পঁচিশেক টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে শুরু করেন তাদের নতুন যাত্রার প্রথম ছবি। উর্দুতে। নাম ‘জ্বলতে সুরজ কি নিচে’ (১৯৭১)।১ প্রথমে ভেবেছিলেন সাদা-কালোতে করবেন। পরে হিসেব করে দেখেন, বাজেটের পার্থক্য খুব বেশি না। দুই লাখ টাকা কম-বেশি। তাই পরে রঙিনই করেন। বিষয় ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। নায়ক নাদিম। বিপরীতে নেওয়া হলো শবনমকে। তখন দু’জনেই দুই পাকিস্তানে তুমুল জনপ্রিয়; কিন্তু কোনোভাবেই শবনমের শিডিউল পাওয়া যাচ্ছিল না। নায়িকা বদলের প্রশ্ন উঠতেই আফজাল চৌধুরী বলেন পপির কথা। এর মধ্যে একটি টিভি-নাটকেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। নাম ‘একটি কলম’। সেখানেই তাকে দেখেছিলেন আফজাল চৌধুরী; কিন্তু পপি তো অভিনয় করবেন না। আবার বাসার সবাই মিলে বোঝালেন। শেষে আবার তাকে রাজি হতে হলো। আফজাল চৌধুরীর স্ত্রী সুরাইয়া আফজাল রুপালি পর্দার জন্য তাকে দিলেন নতুন আরেকটি নাম। ববিতা। 

কিন্তু সেটি ববিতার শুরু নয়। কারণ ছবিটির কাজ আটকে যায়। ছবির আরেক নায়িকা রোজিনা অ্যাক্সিডেন্ট করেন। পরে মাস খানেকের বিরতি। ওদিকে জহির রায়হানের মাথায় তখন ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) ঘুরপাক খাচ্ছে। চলে আসেন দেশে; কিন্তু শ্যালিকাকে নিয়ে একটি ছবি করলেন, সেটি বের হলো না, এ কেমন কথা! ঠিক করলেন, ববিতাকে নিয়ে বাংলায় একটি ছবি বানানোর। আবারও শুরু হলো সেই পুরনো নাটক। শেষ পর্যন্ত ‘এই শেষ’ রফায় রাজি হলেন ববিতা। ভাবলেন, একা নায়িকা হিসেবে একটি ছবি অন্তত থাকুক। শুরু হলো ‘শেষ পর্যন্ত’ (১৯৬৯)। এবার তার নায়ক রাজ্জাক। পারিশ্রমিক ছিল বারো হাজার টাকা। ছবির কাজ শেষ করে তাই দিয়ে একটি অফ হোয়াইট রঙের টয়োটা গাড়ি কেনেন। মা তখন হাসপাতালে, নিরাময় ক্লিনিকে। হার্টের সমস্যা নিয়ে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট। পরিকল্পনা ছিল সবাই মিলে আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। ববিতা, সুচন্দা, জহির রায়হান, রাজ্জাক। ববিতা ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত। মাকে দেখাবেন নিজের টাকায় কেনা গাড়ি। সবার আগে পৌঁছান হাসপাতালে। যেতে না যেতেই একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে তার কাছে। ‘আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।’ গিয়ে দেখেন, মায়ের সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। মাকে দেখানো হয় না নিজের টাকায় কেনা গাড়িটি। হয়তো স্রেফ মিনিট পাঁচেকের জন্য। ববিতা হয়ে জীবন শুরু করতে না করতেই মাকে হারান পপি। 

তবে ছবিটি তুমুল জনপ্রিয় হয়। সিনেমাপাড়ার ভাষায় সুপার-ডুপার হিট। বাড়িতে পরিচালক-প্রযোজকদের ভিড় জমে যায়। সবাই তাদের ছবিতে ববিতাকে চায়। যেটা শেষ ছবি হওয়ার কথা ছিল, সেটিই হয়ে গেল ববিতার শুরু। যে ববিতা দেশের সিনেঅঙ্গন বুঁদ করে রেখেছিলেন দশকের পর দশক। সিনেমাপ্রেমীদের বুঁদ করে রেখেছেন আজও। 

শুরুতে অবশ্য তাতেও গা করতে চাননি ববিতা। এবার বোঝান স্বয়ং জহির রায়হান। এটা আশীর্বাদ। পায়ে ঠেলা যাবে না। সিনেমা করতে হবে। ষোড়শী ববিতা শেষ পর্যন্ত সে আশীর্বাদ পায়ে ঠেলেননি। নজরুল ইসলাম তখন ভীষণ নামকরা পরিচালক। অবশ্য পশ্চিমেই ছবি করেছিলেন বেশি। তিনি এলেন ‘স্বরলিপি’র (১৯৭০) জন্য। সেই বিখ্যাত গানের ছবিটি। ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। সেটিই ছিল ঢাকার কোনো ছবির জন্য রুনা লায়লার প্রথম গান। এহতেশাম বরাবরই ঢাকার চলচ্চিত্রে ভীষণ প্রভাবশালী। এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণেরও আগে থেকে তিনি চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ভাই মুস্তাফিজকে নিয়ে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ঢাকার বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের। এমনকি জহির রায়হানের শুরুটাও হয়েছিল তার ‘এ দেশ তোমার আমার’-এ (১৯৫৯) সহকারী পরিচালক হিসেবে। যদিও পরে তাদের পথ বেঁকে যায়। তিনিও এলেন। ‘পিচ ঢালা পথ’-এর (১৯৭০) জন্য। জহির রায়হান নিজে ববিতাকে নিয়ে বানালেন ‘টাকা আনা পাই’ (১৯৭০), সুচন্দার প্রযোজনায়। পরিচালক হিসেবে অবশ্য নাম দেন বাবুল চৌধুরীর। ছবিতে ববিতা বড়লোকের পাগলাটে স্বভাবের এক মেয়ের অভিনয় করেন। চরিত্রটি বিপুল জনপ্রিয় হয়। ঢাকার চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পান ববিতা। 

এরপর জহির রায়হান ঘোষণা দেন তার ড্রিম প্রজেক্টের। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’। সে এক বিশাল আয়োজনের ছবি। বানানো হবে ৭ ভাষায়- বাংলা, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ ও রুশ। পৃথিবীর মানুষের জন্য। আগস্টে হয় মহরত। নায়ক-নায়িকা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ওমর চিশতি ও অলিভিয়া গোমেজকে। ১৫ সেপ্টেম্বরে করেন আরেকটি সংবাদ সম্মেলন। অলিভিয়ার বদলে নায়িকা হিসেবে ঘোষণা করেন ববিতার নাম। শুরু হয় তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ছবির শুটিং। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ছবিটি আলোর মুখ দেখেনি। বছর ঘুরতেই শুরু হয়ে যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশের ডাকে ভারতে পাড়ি জমান জহির রায়হান। সঙ্গে সুচন্দাও। তারা থাকতেন কায়েৎটুলির বাসায়। আর ববিতা গেণ্ডারিয়ায় বাবার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সেখানেই ছিলেন তিনি। বন্দিদশায়। ওদিকে তখন অনেক দেশলাইয়ের কারখানা ছিল। এই ব্যবসা মূলত বিহারিরাই করত। বোধহয় তাদের থেকেই খবর পেয়েছিল পাক আর্মিরা। প্রায়ই আসত জহির রায়হানের খোঁজে। বড় মেয়ে-মেয়েজামাইকে না পেয়ে অনেক সময় রাজাকাররা খোঁজ করত সুচন্দার ‘সুন্দরী’ ছোট বোনের। তাই পরের দিকে গাড়ির শব্দ পেলেই পেছনের দরজা দিয়ে পালাতেন ববিতা। আশপাশে কারো বাড়িতে গিয়ে নিতেন আশ্রয়। 

এভাবে কেটে যায় নয়টি মাস। তারপর আসে ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতা। দেশে ফেরেন জহির রায়হান; কিন্তু সে ফেরা স্রেফ মাস দেড়েকের জন্য। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘বড়দা’ শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে এক সামরিক রেইডে অংশ নিতে গিয়ে আর ফেরেন না। আড়াই যুগ পরে জানা যায়, সেদিন মারা গিয়েছিলেন তিনি। পরে অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ শেষ করার; কিন্তু জহির রায়হানের চিত্রনাট্যে এমনিতেই বিস্তারিত বিবরণ তেমন একটি থাকত না। আর এই ছবিটার কোনো চিত্রনাট্যই করেননি তিনি। পুরো গল্পটি মাথায় নিয়ে করেছিলেন শুটিং। এমনকি ক্যামেরা চালানো, লাইট- সবই করেছিলেন নিজে। কাজেই শেষটা কী হবে, তা তিনি ছাড়া জানতো না কেউই। ফলে কেউই শেষ করতে পারেনি ছবিটি। তবে ফুটেজগুলো এখনো আছে,বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে। 

স্বাধীনতার পরে আবারও কাজে নেমে পরেন ববিতা। তত দিনে তিনি রূপে-অভিনয়ে কেড়ে নিয়েছেন তরুণদের রাতের ঘুম। এর মধ্যে একদিন তাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে এলো নন্দ ভট্টাচার্যের চিঠি। সত্যজিৎ রায় নাকি তাকে দেখতে চেয়েছেন। পরের ছবিতে নেয়ার জন্য। সে জন্য তাকে যেতে হবে ভারতে। পড়ে তো হেসেই উড়িয়ে দিলেন ববিতা। নির্ঘাত কোনো বেপরোয়া ভক্তের লেখা; কিন্তু কিছুদিন পরে যখন খোদ ভারতীয় অ্যাম্বাসি থেকে ফোন এলো, টনক নড়ল তার। সুচন্দাকে নিয়ে ছুটলেন কলকাতায়। 

সে সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন নিমাই ঘোষ। ভারতের বিখ্যাত আলোকচিত্রী। কাজ করতেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। স্বাধীনতার পরপর এসেছিলেন দেশে। এফডিসিতে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলেছিলেন সবার। ববিতারও। রাজ্জাকের বাসায় তার কিছু মেকআপ ছাড়া ছবিও তুলেছিলেন। সেগুলো দেখেই তাকে পছন্দ করেছিলেন সত্যজিৎ। অথচ তার বাড়িতে যেদিন ববিতা গেলেন, চড়া মেকআপ চড়িয়ে। এত বড় পরিচালক, তাকে যদি পছন্দ না করেন! দেখে উল্টো সত্যজিৎ বলে ওঠেন, ‘ও মাই গড, তুমি এত মেকআপ করে এসেছ কেন?’ সেদিন ভয়ে-লজ্জায় একদম কাঁচুমাচু হয়ে গিয়েছিলেন ববিতা। 

পরদিন যান মেকআপ ছাড়া। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। স্ক্রিন টেস্ট দিতে। মেকআপম্যান তাকে কেবল সিঁথিতে একটু সিঁদুর দেন। একটি টিপ। পরনে আটপৌরে শাড়ি। হাতে শাখা। সেই সাজে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেন তিন-চার রকম স্ক্রিপ্টে। তারপর সত্যজিৎ রায় তার কানে ঢালেন অমৃত সুধা। ‘অপূর্ব। অপূর্ব। ইউরেকা। ইউরেকা। আমি আমার অনঙ্গ বৌকে পেয়ে গেছি।’ শুরু হয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ যাত্রা। একটি বাধা অবশ্য ছিল। ববিতা আগেই সুভাষ দত্তকে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র (১৯৭২) জন্য একই সময়ে শিডিউল দিয়ে রেখেছিলেন। তবে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করবেন শুনে তিনি নিজেই শিডিউল বদলে দেন। কারণ সুভাষ দত্ত নিজেই যে পরিচালক হতে চেয়েছেন সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) দেখে!

‘অশনি সংকেত’-এর (১৯৭৩) শুটিং হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। ববিতা গিয়েছিলেন বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। গিয়ে দেখেন, কী সুন্দর একটি গ্রাম! ঘরের চালে চালকুমড়ো। লাউ। শাক। টিয়া পাখি। উঠানে কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাশে ধানক্ষেত। আগে বুঝি কেউ থাকত বাড়িটাতে। পরে শোনেন, পুরোটাই সেট! বানানো হয়েছিল ছবিটার জন্যই। শুটিংয়ের মধ্যে একটি ঈদ পরে গিয়েছিল। সেদিন ববিতার মন একটু খারাপই ছিল। বাড়িতে ঈদের দিনে কত মজা হয়। আর এখানে বিদেশ-বিভূঁইয়ে একা। বিকেলে দেখেন তার জন্য রীতিমতো আতশবাজির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সন্ধ্যায় সেমাই-পায়েস। তবে সবচেয়ে মজা হয়েছিল দুর্গাকে নিয়ে। ছবিটিতে সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন দুর্গা দাশগুপ্ত। আর কেন্দ্রীয় তিন চরিত্রে ববিতার সঙ্গে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা রায়। তারা শুটিংয়ের মাঝে প্রায়শই বলতেন ‘দুগ্গা দুগ্গা’। অভ্যাসবশেই। আর ববিতা ভাবতেন, সাউন্ড রেকর্ডিস্টের কাজটা বুঝি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই সবাই বারবার তার নাম করছে। সেই কথা শুনে সবাই তো হেসেই খুন!

ছবিটি প্রথম দেখানো হয় ২৩তম বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। ১৯৭৩ সালে। গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, তার স্ত্রী বিজয়া রায়, প্রযোজক নন্দ ভট্টাচার্য ও তিন অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায় ও ববিতা। তখন জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত। সোভিয়েত-পন্থি পূর্ব জার্মানি আর মার্কিনপন্থি পশ্চিম জার্মানি। পূর্বের ফ্রাঙ্কফুর্টে গিয়ে আটকে যান ববিতা। জানিয়ে দেয়া হয়, বাংলাদেশের পাসপোর্টে তাকে পশ্চিম জার্মানিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। তাই নিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে চলে টানাপড়েন। সত্যজিৎ রায় উৎসব কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন, ছবির নায়িকাকে বাদ রেখে তিনি যোগ দেবেন না। শেষ পর্যন্ত মেলে অনুমতি। সেই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবে যোগ দেন ববিতা। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার জিতে নেয় ‘অশনি সংকেত’। গোল্ডেন বেয়ার। আর ববিতা পান নতুন পরিচয়। ‘রয়-এর নায়িকা’। 

‘অশনি সংকেত’ দিয়ে মানিকদা, মানে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ববিতার পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে যায়। এমনকি তাঁর বাবার সঙ্গে সত্যজিতের নিয়মিত চিঠি চালাচালি হতো। তখন ববিতা শারীরিক গড়নে রীতিমতো হ্যাংলা-পাতলা। কাব্যের ভাষায় যাকে বলে তন্বী। অনেকেরই তা নিয়ে ছিল অভিযোগ। এত শুকনো হলে চলে! শেষে ববিতা সকালে পান্তা ভাত খাওয়া শুরু করেন। একটু মোটা হওয়ার জন্য। সে কথা সত্যজিৎকে জানিয়েছিলেন চিঠিতে। মানিকদা লিখলেন, ‘খ-ব-র-দা-র!’

সেই থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ঝান্ডা ওড়াচ্ছেন ববিতা। গিয়েছেন ইতালি, মস্কো, তাসখন্দ, কায়রো, যুগোশ্লাভিয়া, দিল্লির বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ডের পত্র-পত্রিকায়। প্রস্তাব এসেছিল বলিউডে অভিনয়েরও। ওই ‘অশনি সংকেত’-এর পরপরই। বোম্বের প্রযোজকরা যোগাযোগ করেছিলেন সত্যজিতের সঙ্গে। মানিকদা তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন ববিতার। তারা আসেন বাংলাদেশে। অনেকটা এভাবেই বলিউডে গিয়েছিলেন জয়া ভাদুড়ী (বিয়ের পরে জয়া বচ্চন), শর্মিলা ঠাকুর; কিন্তু যাননি ববিতা। আর কাজ করেননি কলকাতাতেও। বিভুতি লাহাদের অগ্রদূত গোষ্ঠী, এমনকি মৃণাল সেনের প্রস্তাবেও রাজি হননি। ভাগ্যিস!

ববিতা থেকে গেছেন বাংলাদেশের হয়েই। হয়েছেন আমাদের ববিতা। জুটি বেঁধেছেন বাংলাদেশের কিংবদন্তিদের সঙ্গে। অবশ্য চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের সঙ্গে তার জুটি পর্দার বাইরেও বেশ জমে উঠেছিল। শুটিংয়ের অবসরে দু’জনে আড্ডা দিতেন। গান করতেন। ইংরেজি গান। জাফর ইকবাল নায়কের পাশাপাশি গায়কও ছিলেন। গেয়েছেন ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’র মতো জনপ্রিয় সব গান। বাজাতেন গিটার। বন্ধুদের নিয়ে তার একটি ব্যান্ড দলও ছিল। ‘রোলিং স্টোন’। সেসব ক্ষেত্রে যতই সফল হোন, ববিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক পরিণতি পায়নি। কম বয়সের প্রেমে যেমনটা হয়ে থাকে প্রায়ই। এক সময় জাফর ইকবাল বিয়ে করেন আরেকজনকে। সোনিয়া নাম। দুর্মূখরা বলেন, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’ নাকি তিনি গেয়েছিলেন ববিতাকে উদ্দেশ্য করেই!

ববিতা অবশ্য বিয়ের পথ মাড়াননি বহুদিন। হয়তো মাড়াতেও চাননি। ব্যস্ত ছিলেন অভিনয় নিয়েই; কিন্তু মৃত্যুশয্যায় থাকা বাবার অনুরোধ ফেলতে পারেননি। তাঁর পছন্দেই বিয়ে করেন ইফতেখারুল আলমকে। তিনি করতেন জাহাজের ব্যবসা। তবে ‘ব্যবসায়ী’ স্টেরিও টাইপে তাকে ফেললে বোধহয় ভুল হবে। বিয়ের পরে ববিতার অভিনয়ে মোটেও লাগাম পরাতে চাননি তিনি। বরং দিতেন উৎসাহ। পুরুষশাসিত সমাজে একজন নারী ‘ববিতা’র অর্জনকে দেখতে প্রশংসার চোখে। প্রযোজনা সংস্থা ‘ববিতা মুভিজ’ বানানোর সময়ও ছিলেন পাশে। অবশ্য সে সাহচর্য বেশিদিন পাননি ববিতা তার অকালপ্রয়াণে। এখন আছেন তাদের একমাত্র সন্তান ছেলে অনিককে নিয়ে। 

তবে পর্দায় ববিতার অধিকাংশ জুটিই হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী। জাফর ইকবালের সঙ্গে রসায়ন তো জমেছিলই। দারুণ সফল ছিলেন রাজ্জাক, ফারুক ও উজ্জ্বলের সঙ্গেও। রাজ্জাকের জুটি হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত নাম কবরী। ববিতা-জাফর ইকবালের মতো রাজ্জাক-কবরীর সম্পর্ক নিয়েও ছিল কানাঘুষা এবং সেটিও পরে পরিণতি পায়নি। তবে নিজে পরিচালনায় নেমে প্রথম ছবিতে রাজ্জাক বেছে নিয়েছিলেন ববিতাকে। ‘অনন্ত প্রেম’ (১৯৭৭)। ছবির শেষ দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল রাঙামাটিতে। একটি পাহাড়ে। পরে সেটির নামই হয়ে যায় ‘ববিতা পাহাড়’। 

কেবল দেশসেরা নায়কদের সঙ্গেই নয়, বরেণ্য পরিচালকদের সঙ্গেও জুটি বেঁধে কাজ করেছিলেন ববিতা। আমজাদ হোসেনের সঙ্গে শুরুটা অবশ্য হয়েছিল অভিনয় দিয়েই। ‘সংসার’ (১৯৬৮) ও ‘টাকা আনা পাই’- তে (১৯৭০)। তবে স্বাধীনতার আগেই তার পরিচালনায় অভিনয়ের শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে ছবিটি আলোর মুখ দেখেনি। পরে কাজ করেন ‘নয়ন মণি’তে। গল্প শুনেই ববিতার ভালো লেগে যায়। হ্যাঁ বলে দেন। মুক্তির পর রীতিমতো হৈচৈ পরে যায়। হলে চলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। আর তাদের একটি দল হয়ে যায়। আমজাদ হোসেন, রওশন জামিল, আনোয়ারা, ববিতা, আর টেকনিক্যাল কলাকুশলীরা মিলে। বানান একটির পর একটি দুর্দান্ত ছবি। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৭৮) নিয়ে তারা গিয়েছিলেন বিভিন্ন উৎসবে। মস্কোতে, তাসখন্দে। মৃণাল সেন দেখে বলেছিলেন, ‘এত সুন্দর ছবি তোমাদের ওখানে হয়!’ তারপর এক-এক করে ‘সুন্দরী’ (১৯৭৯), ‘কসাই’ (১৯৮০), ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ (১৯৮১), ‘বড় বাড়ির মেয়ে’ (১৯৮২)। 

স্বাধীনতার পরপর ববিতা জুটি বাঁধেন আরেক বরেণ্য পরিচালক সুভাষ দত্তের সঙ্গে। তার সঙ্গে অবশ্য পরিচয় আরো আগে থেকেই। বলা চলে পারিবারিক সম্পর্ক। বড় বোন সুচন্দাকে যে প্রথম সুযোগ তিনিই দিয়েছিলেন। ‘কাগজের নৌকা’য় (১৯৬৬)। ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ (১৯৭২) দিয়ে শুরু করেন ববিতার সঙ্গে কাজ। এরপর বানান ‘বসুন্ধরা’ (১৯৭৭)। আলাউদ্দিন আল আজাদের আলোচিত উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে। তাতে নেন আনকোরা নতুন এক নায়ককে। নির্দ্বিধায় সুভাষ দত্তকে ভরসা করে রাজি হয়ে যান ববিতা। সেটি ছিল ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রথম ছবি। তারপর ড. আশরাফ সিদ্দিকীর ‘গলির ধারের ছেলেটি’ গল্প থেকে ‘ডুমুরের ফুল’ (১৯৭৮)। সেটি তখন নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্য ছিল। শুটিং হয়েছিল ঢাকা মেডিকেলে। তাই ভোরবেলায় কাজ সারতে হতো। দুটো নিয়েই তারা গিয়েছিলেন বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে। মস্কোতে, তাসখন্দে। পরে আরো কতো। ১৯৮৬ সালে প্রযোজক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন ববিতা। ববিতা মুভিজের প্রথম ছবিটিই বানিয়েছিলেন সুভাষ দত্ত। ‘ফুলশয্যা’ (১৯৮৬)। পরে বানান ‘আগমন’ (১৯৮৮)। কিনে দিয়েছিলেন গাড়ি। এত বড় পরিচালক স্কুটারে যাওয়া-আসা করবে, তাই কী হয়!

নারায়ণ ঘোষ মিতার সঙ্গে প্রথম কাজ করেন ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪) দিয়ে। তখন অনেকেই ববিতাকে নিষেধ করেছিল। কারণ ছবিতে নায়ক রাজ্জাকের বিপরীতে নায়িকা সুজাতা। আর ববিতা করেন রাজ্জাকের ভাগ্নির চরিত্র। আলো। সেটি প্রথাগত বিচারে নায়িকা চরিত্র নয়। অমন চরিত্রে অভিনয় করলে বারটা বেজে যাবে ক্যারিয়ারের; কিন্তু এত দারুণ একটি গল্প। নারায়ণ ঘোষ মিতার মতো এমন গুণী পরিচালকের ছবি। ছাড়েননি ববিতা। ভাগ্যিস! আলো চরিত্রে এমন আলো আর কেউ ছড়াতে পারতেন কিনা কে জানে! আর দুর্মুখদের মুখে চুনকালি মেখে ববিতার ক্যারিয়ারেরও বারটা বাজেনি। বরং হয়েছে উল্টো। আলোর মৃত্যুর দৃশ্যে হলভর্তি দর্শক কেঁদেছিল হাউমাউ করে। আজও মানুষের মনে দাগ কেটে রয়েছে চরিত্রটি। 

পরে নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’-এও (১৯৭৫) অভিনয় করেন ববিতা। হয়তো করতেন আরো। মিতা থাকতেনও কাছেই। লোহারপুলের ওখানে; কিন্তু তিনি নিজেই যে চলে গেলেন ভারতে। সবকিছু ফেলে। নাম-যশ-খ্যাতি। বাস্তবতা মাঝে মাঝে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে মানুষকে!

বাদ পরেননি ঢাকার অন্য কিংবদন্তি পরিচালকরাও। আলমগীর কবিরের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’য় (১৯৭৩)। খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’- তে (১৯৭৩)। আবদুস সামাদের যুগল-চলচ্চিত্র [সিক্যুয়েল] ‘সূর্যগ্রহণ’ (১৯৭৬) ও ‘সূর্য্য সংগ্রাম’-এ (১৯৭৯)। আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘এখনই সময়’-তে (১৯৮০)। শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’-এ (১৯৮৫)। মোরশেদুল ইসলামের ‘দীপু নাম্বার টু’-তে (১৯৯৬)। দীপুর মায়ের চরিত্রে। বিদেশি ছবিতে আর কাজ না করলেও করেছেন যৌথ প্রযোজনায়। ‘দূরদেশ’ (১৯৮৩) ও ‘মিস লংকা’য় (১৯৮৫)। সুচন্দা ও চম্পার সঙ্গে তিন বোন মিলে করেছেন ‘তিন কন্যা’ (১৯৮৫)। এমনি কত কত ছবিতে তাঁর অভিনয় এখনো লেগে রয়েছে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের চোখে। সেগুলোর নাম ভালোবাসায় জেগে থাকে তাদের ঠোঁটের ডগায়। কখনো প্রতিভায়, কখনো রূপের ছটায়, কখনো বাঁকা হাসিতে, কখনো ভ্রুকুটিতে মাত হওয়ার স্মৃতিতে। 

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর প্রথম তিন বছরই শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার নিজের করে রেখেছিলেন ববিতা। ‘বাঁদী থেকে বেগম’ (১৯৭৫), ‘নয়নমণি’ (১৯৭৬) আর ‘বসুন্ধরা’ (১৯৭৭) দিয়ে। পরেও পেয়েছেন আরেকবার। ১৯৮৫ সালে। ‘রামের সুমতি’র (১৯৮৫) জন্য। প্রযোজক হিসেবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার বগলদাবা করেছেন ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ (১৯৯৬) দিয়ে। বুড়ো হাড়ের ভেল্কিতেও মাত করেছেন দুবার। ‘হাছন রাজা’ (২০০২) ও ‘কে আপন কে পর’ (২০১১) দিয়ে। শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেত্রী হিসেবে। ২০১৬ সালে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। 

অবশ্য তার সঙ্গে ‘বুড়ো’ শব্দটি যায় না কোনোভাবেই। বয়স হয়ে গিয়েছে হয়তো, তবু আজো তার কথা বললেই ভেসে ওঠে সেই সাদাকালো লাস্যময়ী মুখখানা। চঞ্চল দুটো চোখ। এক ভ্রুকুটিতে খুন হয়ে যায় হাজার লাখো হৃদয়। সে তার ‘বুড়িয়ে’ যাওয়া চেহারা যতবারই দেখা হোক না কেন। ববিতা নামটা শুনলেই যেন বাংলাদেশের প্রতিটা হৃদয় প্রস্তুত হয়ে যায়, প্রতি জোড়া চোখ হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে স্মৃতির মণিকোঠায়। যেন চেহারাটা আরেকবার দেখে আরেকবার খুন হতে চায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //