অন্তরের কথা কণ্ঠে ধারণ করা সংগীতজ্ঞ সঞ্জীব চৌধুরী

১৯৬৪ সাল, ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ। হবিগঞ্জের মাকালকান্দির গোপাল চৌধুরী ও প্রভাষিনী চৌধুরী দম্পতির কোল আলোকিত করে পৃথিবীর আলো দেখেছিল এক মানবশিশু। আমাদের ঠিক ঠাহর হওয়ার কথা নয়, গোপাল-প্রভাষিনী দম্পতি ভাবতে পেরেছিলেন কিনা তাদের সপ্তম সন্তানটি হবে ক্ষণজন্মা।

এটাও ভাবনার বাইরে যে, তাদের কল্পনায় খেলে গিয়েছিল কিনা তাদের সন্তানটি মানুষের হৃদয়ের গভীর তলদেশ ঘুরে ঘুরে সন্ধান করে স্বপ্নের পাখিটিকে ধরার নিমিত্তে জন্মলাভ করবেন। ভাবতে পেরেছিলেন তারা, তাদের সন্তানটি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে লিপ্ত রেখে এমনকি মানুষের অনাবাদি, ঊষর-বন্ধ্যা হৃদয়জমিনেও সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তোলার অধিকারী হবেন!

তাদের ভাবনা বহু দূরের কল্পনা হলেও বাংলা গানের অন্যতম মহাজন কমরেড সঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে লেখা কথাগুলো যে কল্পনা নয়, সত্যি; সে ব্যাপারে তার পাঠক- শ্রোতা ও পরিচিতজন জ্ঞাত। কবি, গীতিকার, গায়ক, গল্পকার, সুরকার, নাট্যকার, রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক সংগ্রামী- নিজের আত্মা বহুভাবে বাজানো সঞ্জীব ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান।

একজীবনে কত সংগীতশিল্পীর একটা গানও যেখানে শ্রোতাদের হৃদয়ভূমিকে নাড়া দেয় না, সেখানে সঞ্জীব মাত্র ৪৩ বছরের জীবনে ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘কিংবদন্তি’, ‘চল বুবাইজান’, ‘ইয়াসমিন’, ‘চাঁদের জন্য গান’, ‘কালা পাখি’সহ কত গান শ্রোতাদের উদারা, মুদারা, তারার রহস্যময় সব পর্দা ভেদ করে দিয়ে যায়।

মাত্র ৪৩ বছরের এক স্বল্পপ্রজ অথচ ঘটনাবহুল আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। যার কারণে পার্থিব জীবনে যতভাবে পেরেছেন শুধু কাজ করে গেছেন, কাজ করেছেন মানুষের জন্য। মানুষের অন্তরের কথা, স্বপ্নের কথা নিজের অন্তরাত্মায় লীন করে তার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন কথার ফল্গুধারা। মানুষের হৃদয়ের ব্যথা অনুধাবন করে তার অন্তরাত্মা উৎকণ্ঠিত হতো।

পাখির হৃদয় নিয়ে জন্মলাভ করা মানুষটির বুকের ভেতর বড় কষ্ট হতো কোনো মানুষ খুন হলে। মেনে নিতে না পেরে তিনি চিৎকার করে উঠতেন- ‘তিনটি লাশ, তিনটি লাশ। ঠাণ্ডা হিম, যাঁদের গুম করে ফেলা হবে।’ 

মানুষের অকালে চলে যাওয়াও তার বুকে বড় বেদনার মতো ক্ষত সৃষ্টি করে বাজতে থাকত। বাপ্পা মজুমদারের বন্ধু আনন্দ অকালে প্রয়াত হলে সঞ্জীব লেখেন, ‘ছিল গান, ছিল প্রাণ’ গীতিকবিতাটি। ফলে দরদি সঞ্জীব রচিত, সুর করা, গাওয়া গান পিনপতন নৈঃশব্দ্যে ছাওয়া রাতে কর্ণকুহর ভেদ করে আমাদের মস্তিষ্কে হয়ে ওঠে অমিয় সংগীত।

সুর-সংগীতের চেয়ে তার গানের কথাই মূলত ছড়িয়ে পড়ে মগজের চারদিকে, তার পর গেঁথে যায় মননে: ‘আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া, সন্ধান করিয়া/স্বপ্নের ওই পাখি ধরতে চাই/ আমার স্বপ্নের কথা বলতে চাই; আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।’

মৃত্যুচিন্তা সঞ্জীবকে শুধু বিচলিতই করতে পারেনি তা নয়, মৃত্যু নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে রসিকতা করা থেকেও তিনি রহিত থাকতেন না। বলেছিলেন, ‘টিএসসি চত্বরে কিংবা আজিজ সুপার মার্কেটে আমি থাকব না, সেটা কি কখনো কল্পনা করা যায়! গিয়ে দেখবেন, আমি সেখানে মস্ত আড্ডা জমিয়ে বসে আছি; কিন্তু মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি সত্যিই অলোকলোকবাস নিলেন!


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //